ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ডোম পাণ্ডুলিপি থেকে | গিরীশ গৈরিক

কবিতা ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১৮
ডোম পাণ্ডুলিপি থেকে | গিরীশ গৈরিক ডোম পাণ্ডুলিপি থেকে | গিরীশ গৈরিক

১১
রোজ ভোরে তুমি জুতা খুলে নিচে নেমে যাও
তারপর অনেক সূর্য শিশিরের বুকে উত্তাপ জমিয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়।

গোধূলিতে একটি সাদা ও কালো বিড়াল ম্যাঁও করে ডেকে ওঠে
আবার ভোরে-তোমার জুতা খোলার পূর্বেই বিড়াল দুটি পুনরায়
                                        ম্যাঁও করে ওঠে।
এভাবে তুমি ধরে নিলে ওই সাদা ও কালো বিড়ালের পার্থক্য হলো
                                              দিন ও রাত
আর এই ম্যাঁও ধ্বনি-জগতের কলরব, নিস্তব্ধতার পরমবন্ধু।


 
পৃথিবীর বুকে তোমার এই নগ্নপায়ে হেঁটে যাওয়া যেদিন থেমে যাবে
সেদিন সভ্যতা পায়ের ছাপের অঙ্ক কষে জেনে নিবে-
তোমার বয়স কত ছিলো? তুমি কতটা দুঃখ পেয়েছিলে?
তোমার সন্তানের মৃত্যুর সময়-স্ত্রীর চোখের জল
                        কেন কপালে গড়িয়ে পড়েছিল?
সেসব ইতিহাস খুঁটে খুঁটে বের করে নেবে সভ্যতা
তোমার ওই পায়ের ছাপচিত্রের অঙ্ক কষে।
 
কিন্তু যেসকল কবি সভ্যতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে
পৃথিবীর বুকে জুতা পায়ে হেঁটে চলে গেছে
তার বেলায় কী অঙ্ক কষে রাখে সভ্যতা!
  
১২
একটি ঝরা পাতার গল্প-অল্প অল্প করে সবুজ থেকে হলুদ হয়ে যায়
একটি চুলের কবিতা-ধীরে ধীরে কালো থেকে সাদা হয়ে যায়
এভাবে পাতা ও চুলের প্রেম-গল্প ও কবিতায় নিবিড় হয়ে ওঠে।
গল্প ও কবিতায় নিবিড় হয়ে ওঠে মৃতের পাশে আপনজনের হাসি
যে হাসি একদা হাঁস হয়ে উড়েছিলো আকাশে আকাশে।
আজ কেন এই হাসির মাঝে এত বেদনা! এত গান!
 
কী সেই গান-যে গান বোবা হয়ে গাইতে এসেছি পৃথিবীর পথে।
এই বোধির পৃথিবী কী জানে-এসব গানের মানে।
হয়তোবা অন্ধ-আঁতুড়ঘরে চিৎকারে গেয়েছিলাম এই গান
সেই গানখানি লাশকাটাঘরে-ডোমের সৎকারে হলো অবসান।
  
১৩
নদীর কিনারে কোষা নৌকা বাঁধা আছে
ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ-এর শব্দে দুলছে-দুলেই যাচ্ছে জলে।
 
নদীর ওপারে শ্মশানঘাট-চ-ালের হাহাকার
যেখান থেকে-থেকে থেকে বাতাসে ধ্বনিত হয় :
‘বল হরি-হরি বল, বল হরি-হরি বল’।
এই ধ্বনি মৃতের কানে আর কতটুকু পৌঁছায়
সবটুকু শ্রবণ করে জীবিতদের কান।
 
সেই ধ্বনির শব্দে তারা আকাশের দিকে তাকিয়ে কোনো একজনকে খোঁজে
আকাশে কে থাকে? সে কি মাটির পৃথিবীতে রয় না!
না। সে আকাশেও নেই, মাটিতেও নেই; নেই সে কোথাও
সে শুধু কতিপয় মানুষের হৃদয়ে রয়।
যাদের হৃদয় শেষ আশ্রয় খোঁজে-তাকে লক্ষ করে।
 
নদীর কিনারে কোষা নৌকা ভেসে যাচ্ছে-
আর দুলছে আধুনিক সতীদের চোখের জলে।
 
১৪
প্রিয়তমা মরে গেছে-তবুও তার প্রিয়স্মৃতি হৃদয়ে ঝলসায়
যেমন করে ভোররাতের সূর্য ঝাড়– হাতে অন্ধকার সরিয়ে ঝলসে ওঠে।
প্রিয়তমা-তোমাকে আর কোনো অভিবাদন নয়-নয় কোনো নয়ছয়
তুমি ভাস্বর হয়ে ওঠে সাপের ফণায় কিংবা পরবাসী কবির অভিশপ্ত জীবনে
যেন তোমাকে আর কেউ লালগোলাপ হাতে বলতে না পারে ‘ভালোবাসি’।
প্রিয়তমা তুমি জেনে গেছে-স্বদেশ একটি গরুর গোয়াল
তবুও তুমি দুধের তৃষ্ণা মেটাতে পরবাসে অভিমানে কাঁদো।
তোমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও-তৃষ্ণার্ত জননীর কাছে।
অথচ-তুমি জানো না-তোমার জননী আজ মৃত
তাই তোমার সমস্ত অভিমান তুচ্ছ-শূন্য-অতুলনীয়।
 
১৫
ভাতের থালায় চোখের জল থৈ থৈ করে
সেই জলে ভেসে যাচ্ছে আপনজনের মৃতদেহ,
কোনো মৃতদেহের পাশে বেহুলা নেই-একা লখিন্দর-একাকী নির্জন কবি।
এভাবে এক এক করে মা বাবা ভাই বোনের মৃতদেহ ভেসে যেতে দেখলাম
হঠাৎ দেখি আমারই মৃতদেহ ভেসে যাচ্ছে উবু হয়ে।
টুপ করে আমার মৃতদেহ থালা থেকে সরাতেই ঘটল-অবাক কা-
একি! থালা ভর্তি ভাতের পাহাড়-ভাতগুলো পাথরের তৈরি।
 
আমার মায়ের ভাতারের ভাত দেবার কোনো যোগ্যতা ছিলো না-
তাই মায়ের চোখের জল ভাতের থালায় জমে জমে থৈ থৈ নদী।
নদীর পাড়েই শ্মশানঘাট-এই ঘাটে প্রতিদিন ভেসে আসে-
ঈশ্বর আল্লাহ যিশু ও বুদ্ধের মৃতদেহ।
সেই প্রতিটি মৃতদেহে মানুষের রক্ত দিয়ে কেন যে লেখা থাকে-
‘হে মানবজাতি তোমরা আমাকে ক্ষমা করো
তোমাদের পরস্পরের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করার জন্য’।
 
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০১৮
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।