ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

‘পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন’ রঙচটা জীবনের রকমারি আখ্যান

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৪৯ ঘণ্টা, জুলাই ২২, ২০১৮
‘পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন’ রঙচটা জীবনের রকমারি আখ্যান ‘পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন’

কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকা পড়া হতো নিয়মিত। এক সংখ্যায় খেয়াল করলাম (১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭) মাসউদ আহমাদের গল্প ‘পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন’।

গল্পটি পড়ে আমি অনেকটা ঘোরের মধ্যে পড়ে যাই। ঝিম মেরে বসে থাকি।

এমন নয় যে, মাসউদের লেখার সঙ্গে আমার পূর্বপরিচয় নেই। তার গল্প, গল্পের আয়োজন, ব্যক্তিমানস সম্পর্কেও কিছুটা ধারণা আছে। কিন্তু কবি জীবনানন্দ দাশের জন্মদিন উপলক্ষ করে লেখা এই গল্পটি একেবারেই আলাদা। গল্পটি আমার কাছে কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে এক ধরনের গবেষণাকর্ম মনে হয়েছে। অনুভব করি, এই গল্প কেবল কল্পরাজ্যের স্বল্পবিস্তার স্বপ্নীল সারিন্দা নয়, বাস্তবতার বিপুলায়তন সাধনা। বুঝতে পারি, এমন সাহিত্যকর্ম সৃষ্টির জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি, ফলিত ফিল্ডওয়ার্ক ও আনুষঙ্গিক অভিজ্ঞতায় কতটা সমৃদ্ধ হতে হয়।  

নতুন ধারার গল্পগায়কী নিয়ে ২০১৮ বইমেলায় ভিন্ন ভিন্ন দশটি কাহিনীচিত্রের সংকলিত সংস্করণ ‘পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন’। মলাটবদ্ধ এই একগুচ্ছ আয়োজনে দেখা মেলে কবি জীবনানন্দ দাশ, তার স্ত্রী লাবণ্য দাশ, বুদ্ধদেব বসু, হুমায়ুন আহমেদের রূপা-হিমু এবং আরও কিছু রঙ ও রেখা। চরিত্রগুলোর ভেতর দিয়ে কিংবা তাদের উপর ভর করে লেখক রূপ দিয়েছেন তার নিজস্ব নির্মাণ, সুড়ঙ্গ বা সেতু। প্রশ্ন জাগতে পারে, একেকটি গল্পে একেকজন বাস্তব ব্যক্তি কী করে ঢুকে পড়েছেন? অথবা লেখক তাদের টেনে এনেছেন কেন? আলোচিত সম্মোহিত চরিত্রগুলোও কেন ভেসে উঠেছে কাহিনীর ক্যানভাসে? এখানেই ধরা পড়ে মুগ্ধতা ও কৌতূহল। অনুভব ও অস্বস্তি। বিস্ময় কিংবা বিরক্তি।  

একটু খোলাসা করা যাক।  
কিছু কিছু মুখ থাকে, যাদের নিয়ে খুব উৎসুক থাকে জনতা। থাকে কিছু চরিত্র, যারা চলচ্চিত্র হয়ে পাঠকের মনে ঘুরে বেড়ায় অথবা স্থিরচিত্র হয়ে লেপ্টে থাকে অনুভূতির আকাশে। সহাস্য রহস্য, দোদুল্যমান দ্বিধা কিংবা ছায়াবৃত্তের মায়া নিয়ে তারা মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায়। গল্পকার মাসউদ আহমাদ চেয়েছেন সেসব রহস্যমণ্ডিত ও দ্বিধান্বিত দৃশ্যপটের আলোচনা হোক। তাদের সঙ্গে কথোপকথনে কেটে যাক জমে থাকা জড়তা। কিন্তু কী আশ্চর্য! প্রতিষ্ঠিত প্রচ্ছন্নতার ঘোর কাটাতে এই পথ ধরে এগুতে গিয়ে পাঠক নিজেই আরেকটি ঘোরের মধ্যে পড়ে যায়। এই ঘোর হচ্ছে, মাসউদের গল্পভঙ্গিমার ঘোর। এই ঘোর তৈরি হয় কোনো শোরগোল ছাড়াই। ঘটনায় টান টান উত্তেজনা হয়ত আছে, কিন্তু লোমহর্ষক অ্যাডভেঞ্চার নেই, বিপ্লবী কোনো থিম নেই, তবুও গল্প শেষে মাথাটা ঝিম ধরে যায়। বলতে গেলে লেখকের সাফল্য হয়ত সেখানেই। পাঠককে মোহগ্রস্ত করতে পারা সে-তো সামান্যতর ব্যাপার নয়।

প্রথম গল্পটি কবি জীবনানন্দকে নিয়ে ‘পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন’। আবদুল মান্নান সৈয়দ যেমন করে উচ্চারণ করেছিলেন ‘জীবনানন্দকে মাঝে মাঝে দেখি রাস্তায়’, তেমন করেই আবিদের সঙ্গে কবির দেখা হয়ে যায়, হঠাৎ। জাদুবাস্তবতার মতোই জীবন্ত জীবনানন্দকে পেয়ে আবিদ উগরে দেয় জমে থাকা জিজ্ঞাসার স্তূপ। কবির ব্যক্তিজীবন আর লেখকসত্তা নিয়ে তার কৌতূহল মেটাতে রচিত হয় একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সাক্ষাৎসিনেমা। মাসউদের মুন্সিয়ানায় তাতে আমরা দেখতে পাই সেকাল-একালের সুসংহত সংযোগ, স্মৃতির নান্দনিকতা। সবুজে আচ্ছাদিত নদীবেষ্টিত বরিশাল শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জীবনানন্দের বোন সুচরিতা দাশ-বর্ণিত তেমন শান্ত-স্নিগ্ধ রূপ, ব্রাহ্মসমাজভবন, কালীদাস রোড, আদর্শ প্রেস, বিএম কলেজ, ডায়েরিতে লেখা সেই রাখাল বাবুর পুকুর সবকিছুই লেখক তুলে এনেছেন স্ন্যাপশটের মতো।  

‘আয়না ভাঙার পর’ শীর্ষক দ্বিতীয় গল্পে পেয়ে যাই লাবণ্য দাশকে। কবির দাম্পত্য সম্পর্ক, জীবিকা ও লেখালেখির টানাপোড়েন কীভাবে দেখতেন স্ত্রী লাবণ্য? কলকাতায় বসবাস, ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যু, স্বপ্ন ও হাহাকার এসব প্রসঙ্গে সরাসরি তার মুখ থেকেই শোনার চেষ্টা করা হয়েছে। এখানেও দেখা মেলে সেসব স্মৃতিময় ও পরিবর্তিত দৃশ্যপট দেশপ্রিয় পার্ক, শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল...। কবি ও কবির স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করে মূলত জীবনানন্দকেই নতুনরূপে জীবন্ত করে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন মাসউদ আহমাদ। কেন এত রূঢ় নিয়তি, অভিঘাতে ভরা বাস্তবতা, সাধ ও সাধ্যের ফারাক? কে ছিল বনলতা সেন? সবকিছু সম্পর্কে সওয়াল-সংলাপ অত্যন্ত সহজ ও আন্তরিক আনন্দময় হলেও রহস্য কিন্তু রহস্যই থেকে গেছে। তৎকালীন পারিপার্শ্বিকতা ও তাদের সাংসরিক মানসিকতার স্বরূপ জানা গেলেও কাব্য-কলমিলতার অবগাহন আবছায়াই রয়ে গেছে। কারণ, গল্পকার চরিত্রগুলোর সংলাপ সঞ্চয়নে অত্যন্ত সতর্কতার পরিচয় দিয়েছেন, নিখুঁত তথ্যপরিক্রমার সুষম সংযোজন ঘটিয়েছেন।  

এই একই ভাবধারার দৃশ্যায়ন ও অনুসন্ধান দেখতে পাই ‘নগর ঢাকায় বুদ্ধদেব বসু’ ও ‘হুমায়ূন আহমেদের গল্প থেকে বেরিয়ে’ আখ্যানে।  

‘অটোগ্রাফ’ গল্পটি অন্য মাত্রার। লেখকের বয়ে বেড়ানো বেদনা ও শহুরে শোভায় নাগরিক প্রেমের পরিণতি কোনটা বড় হয়ে ওঠে বোঝা যায় না। পাঠকের প্রণয়পাঠে আগ্রহী হয়ে লেখক নিজেই কি আশাহত হয়ে ওঠেন না? স্বপ্নদেখা আশ্বাস, কিংবা স্বপ্নভঙ্গের দীর্ঘশ্বাস এমনসব দীর্ঘ পথপরিক্রমার পর সবাই তো একা। নয় কি? ‘আলো-অন্ধকারে যাই’, ‘মেঘভাঙা রোদ’, ‘জুনিয়র আর্টিস্ট’, ‘রূপচানের আশ্চর্য কান্না’ এসব গল্পের প্লাটফরম আলাদা হলেও সেই একই বিষণ্নতা ও একাকীত্বের সুরই সর্বোচ্চ রাগ হয়ে বাজে।

মাসউদ আহমাদের গল্প বলার ঢঙটা কেমন? আমার কাছে মনে হয়েছে, তার গতিটা ধীর, মতিটা পরিমিত। চরিত্রগুলো চিন্তাকাতর। ঘটনার ঘূর্ণির চেয়ে ভাবনার গাঢ়তা বেশি। জীবনের বোধ, যাপনের উপলব্ধি যত গভীর হয়ে ওঠে, অহেতুক উত্তেজনা তত কমে আসে। লেখকের বর্ণনাভঙ্গিতে তাই উচ্ছ্বাসের পরিবর্তে দীর্ঘশ্বাস প্রধান হয়ে উঠেছে। সভ্যতা ঝলমল করলেও প্রকৃতপক্ষে তা আলোকিত নয়। তিনি দেখতে পান, অন্ধকারের আধিপত্য আর আলোর উচ্ছিষ্ট। সংবেদনশীলতার এই সংকটকে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন তার লেখায়। ফিরে ফিরে তাকিয়েছেন ফ্ল্যাশব্যাকে। এই প্রেক্ষাপটে ‘মেঘভাঙা রোদ’ গল্পটা আমাকে খুব ভাবিয়েছে।

লেখকের বর্ণনা ও বাক্যবিন্যাস বংশীবাদকের মতো। শব্দচয়নে সুর ও সৌন্দর্য আছে। শ্রুতিমধুর ও দৃষ্টিমদির। সুস্থির সংগঠনের সঙ্গে ধীর তালের উঠানামা। পড়তে ভালো লাগে। হ্যাঁ, খরস্রোতা নদীর মতো হয়ত টেনে নিয়ে যাবে না, তবে ভাবে বিভোর হওয়া যাবে। লেখক সেটারই সাধনা করেছেন। এখানে একটা ব্যাপার লক্ষণীয়, কিছু কিছু শব্দ লেখকের খুব কাছের। অনুভূতি প্রকাশে কতক উচ্চারণে তিনি সকাতর সমর্পিত। কিছু উপমা ও বাগব্যঞ্জনায় অবচেতন অভ্যস্ত। তাই অনেক কথার পুনরাবৃত্তি চোখে পড়ার মতো। চার-পাঁচ জায়গায় একই ধরনের বর্ণনা এসেছে। ‘আকাশের সিঁড়ি ভেঙে গাঢ় ভঙিতে রাত নামতে থাকে’ দুটো গল্প শেষ হয়েছে এই একই বাক্য দিয়ে। কথার মাঝখানে ‘বিরতি’ কিংবা ‘নীরবতা’ বোঝাতে ইংরেজি ‘পজ’ শব্দ লাগিয়েছেন কয়েক জায়গায়। ইন্টারনেট কিংবা অডিও ভিডিও কন্টেন্ট ব্যবহারে আমরা ‘পজ’ শব্দটির সঙ্গে পরিচিত, কিন্তু ‘কথায় খানিকটা পজ এসে যায়’ বললে বাক্যের মাধুর্য ম্লান মনে হয় আমার কাছে। বানান ভুল তুলনামূলক কম।  

পুরো বই পাঠের পর এটুকু বলতে পারি, মাসউদ তার নিজস্বতায় মৌলিক। সংবেদী সাধনা তাকে এভাবেই নির্মাণ করে চলেছে। মোদ্দাকথা, সরল প্রেমের গল্প লেখার চর্চা না করে মাসউদ আহমাদ গল্পের ভুবনে নূতন বা অন্যপথে হাঁটার সাধনা করে চলেছেন, যা আমাদের কৌতূহলী করে। নতুন গল্প পাঠের প্রতীক্ষায় রাখে। এখানে তার আলাদা হয়ে ওঠাটা টের পাওয়া যায়।  

পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন ॥ মাসউদ আহমাদ
প্রকাশনী: সময় প্রকাশন, প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ, প্রকাশকাল: বইমেলা ২১০৮, মূল্য: ২০০ টাকা।

তানিম ইশতিয়াক
প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
পাটুয়াখালি সরকারি কলেজ, পটুয়াখালি।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।