ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

চার্লি'র পূর্ণতায় মানে খুঁজে পাওয়া যাবে জীবনের

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর, ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০১৮
চার্লি'র পূর্ণতায় মানে খুঁজে পাওয়া যাবে জীবনের চার্লি নাটকের একটি অংশ। ছবি- বাংলানিউজ

ঢাকা: বিশ্বময় অত্যন্ত সুপরিচিত কিছু মুখের মধ্যে 'চার্লি চ্যাপলিন' একটি কৌতুকমাখা বিনোদন চরিত্র। প্রায় সব মানুষের দৃষ্টিতেই চার্লি মানে 'সঙ'! হাস্যরসের ভাণ্ডার! যে মুখ কান্না করলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট আর বো-টাই পরা হিটলারি গোঁফ। সঙ্গে আছে মাথায় জ্যাক ক্যাপ, ছড়ি হাতে পেঙ্গুইন পায়ে হেলেদুলে হেঁটে যাওয়া মাইম শিল্পীর মুখের মতো শুভ্রতা।

রোববার (৪ নভেম্বর) ঢাকার নাটকের দল 'নাট্যধারা' শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষন থিয়েটার হলে মঞ্চায়ন করলো সেই চার্লি চ্যাপলিনকে নিয়ে তাদের প্রযোজনা ‘চার্লি’। নাটকটি রচনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন লিটু সাখাওয়াত।

চলচ্চিত্রে যে চার্লিকে দেখে সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে, নাট্যধারার মঞ্চনাটকে সেই ‘চার্লি’র দর্শনগত দিকটাই আলোকপাত করা হয়েছে। এ নাটকে মূলত প্রকৃত চার্লি চ্যাপলিনের হাস্যরস তেমন কিছুই পাওয়া যাবে না। এখানে চার্লি যেন একটি রূপক মাত্র। চার্লি যেনো সারা বিশ্বের মানুষের মৌলিক চাহিদা, নৈতিকতার স্খলন, মানবতাবোধ, আত্মদ্বন্দ্ব, প্রেম, দ্রোহ, প্রাত্যহিক অভাব, টানাপোড়েন, ঘৃণা, বিদ্বেষ, সংঘর্ষ, বিপ্লব, প্রথাগত পচনশীল জীর্ণ সমাজ ব্যবস্থা ভাঙার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ।

'প্রথাগত নিয়ম অনুযায়ী মঞ্চনাটক যেভাবে শুরু হয়, চার্লির শুরুটাতেও এর বিশেষ কোনো ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু কয়েক মিনিট পরেই চিরচেনা সেই পোশাকী চার্লি চ্যাপলিনকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। মঞ্চের চার্লি শাখা-প্রশাখা মেলতে লাগল জীবনযুদ্ধে লিপ্ত চারদিকের সব সহযাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে। একেবারেই নতুন বাঁকে, ভিন্ন আঙ্গিকে, নতুন রূপ ও গল্প হয়ে চার্লি এগোতে থাকে সমসাময়িক জীবন স্রোতের প্রবল টানে। ' নাটক শেষে এমনটাই বলছিলেন নাটক ভালোবাসা মানুষগুলো।  

দর্শক গ্যালারি কানায় কানায় টইটম্বুর হলে সেখান থেকেই শোনা গেছে চার্লি নাটক নিয়ে বিভিন্ন অভিমত। নাটক শেষে নাট্যকর্মী ও দর্শনার্থী রুবেল আহমেদ বলেন, নাটকে 'চার্লি' যেনো মানব সভ্যতার পথিকৃৎ। সে আমাদের পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া সংস্কার, দর্শন, দিকনির্দেশনা, ভাববাদ, আধ্যাত্মিক চিন্তা ও চেতনার ঐতিহাসিক স্বাক্ষরসহ একেবারে অধুনা জীবনধারায় প্রবাহমান জ্বলন্ত অভিজ্ঞতায় বিমূর্ত। অথচ স্পষ্ট প্রতীক হয়েই সে চিত্রায়িত হলো পুরো নাটক জুড়ে।

দর্শনার্থী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী সাইফুল আনাম বলেন, এই চার্লি, এমন এক চার্লি। যার সুনির্দিষ্ট কোনো অস্তিত্বই নেই। আবার তার ভেতরেই আমাদের সবার বাস। এই চার্লির নিজস্ব কোনো সংলাপ নেই। আপনার, আমার, তার ও তাদের হয়ে, কোটি মানুষের প্রতিদিনের ন্যায্য কিন্তু অতিশয় জটিল সব প্রশ্ন, অত্যন্ত স্বাভাবিক অভিযোগ, না পাওয়ার আর্তি, মূল্যবোধের অবক্ষয়, বিবেক শূন্যতার আহাজারি হয়ে একে একে ফুটে উঠেছিল এ চার্লির উপস্থাপনায়। কখনও কৌতুকে, কখনওবা কঠোর যুক্তিতে চার্লি মুক্তির নেশায় মাতাল হয়ে উদ্ভাসিত হচ্ছিল সাধারণ থেকে অসাধারণ সব চরিত্রে।

নাটকটিতে দেখা যায়, ভূলোকে, ইথারে, অন্তরীক্ষে, সঙ্গীতে, দর্শনে, ধ্যানে, প্রার্থনায় মুক্তি ও শান্তির অন্বেষণ চার্লির। ক্ষমতাবান স্বার্থান্বেষীদের ঋজু কব্জায় বন্দি স্বাধিকার আদায়ের শান্তিকামী সংগ্রামে অক্লান্ত যোদ্ধা সে। এখানে চার্লি সর্বত্র। সৎ পথে বেঁচে থাকার নিমিত্ত প্রচেষ্টায় চার্লির দুই টাকার হিসাব, কিছুতেই মেলে না। সে হিসাব মেলাতে গিয়ে চার্লি '৫২ '৭১ ও '৭৫ কে একাকার করে মিলিয়ে আনে সব...! কিন্তু যোগফল মেলে না।

ক্রুদ্ধ, জিঘাংসু, আত্মবিশ্নেষণকারী চার্লি জনস্রোতে মিশে যায়। নিত্যকার কোলাহলমুখর আম-জনতার কিলবিল করা জরাজীর্ণ গড্ডালিকার ভিড়ে হাজারো জনকে প্রশ্ন ছুড়ে সদুত্তর না পেয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় ক্ষণিকের জন্য চার্লি। কিন্তু দমে যায় না।

নাটক সম্পর্কে নাটকের নাট্যকার ও নির্দেশক লিটু সাখাওয়াত জানান, আমাদের চার্লি আসলে এক অপূর্ণতা; যার পূর্ণতায় জীবনের মানে খুঁজে পাওয়া যাবে। আট আনার অর্থনৈতিক মুক্তি, আট আনার সাংস্কৃতিক মুক্তি, আট আনার সাম্প্রদায়িক মুক্তি আর আট আনার মানবিক মুক্তি। মোট দুই টাকা। দুই টাকার প্রাপ্তিতে জীবনের মানে মিলবে। তাই তো পুরো নাটক জুড়ে আমরা চার্লিকে দেখি সদা ব্যস্ত দুই টাকার সন্ধানে।

চার্লি নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন লিটু সাখাওয়াত, দীপান্বিতা ইতি, নাসির উদ্দিন ভুইয়া, সব্যসাচী চঞ্চল, কামাল হোসেন, রফিকুল ইসলাম, গাজী রহিসুল ইসলাম তমাল, হাফসা আক্তার, রবিন, মিরাজ প্রমুখ।

বাংলাদেশ সময়: ০৮০১ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৫, ২০১৮
এইচএমএস/এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।