রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’র নাম ঘোষণার পর বিশ্ববিদ্যালয় হাউজিং সোসাইটিতে (বিহাস) তার বাসভবন ‘উজান’-এ বাংলানিউজের কাছে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেন।
তার অগণিত পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীদের তিনি বলেছেন, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি লিখে যেতে চাই।
জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক ও মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকসহ ১২ ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠানকে এবছর স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছে সরকার।
রোববার (১০ মার্চ) দুপুরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ এই পদকপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করা হয়। আগামী ২৫ মার্চ (সোমবার) বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আনুষ্ঠানিকভাবে এ পুরস্কার তুলে দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হাসান আজিজুল হক বলেন, পুরস্কার তো জীবনে অনেক পেয়েছি। আমি মনে করি এটা আমার কাজের স্বীকৃতি। অনেকে মনে করেন লেখকদের কাজের স্বীকৃতি প্রয়োজন নেই। আমি তা মনে করি না। বাংলাদেশের মানুষকে অনেক ভালোবেসেছি। আমার মনে হয়, এ পদক তাদের ভালোবাসা হয়ে আমার কাছে এসেছে। এটাতে সাফল্য আছে বলে আমার আনন্দবোধ হয়। এটা আমার জন্য গর্বেরও বটে। আর পুরস্কারকে আমি স্বীকৃতি বলে মনে করি। পুরস্কার কাজের অনুপ্রেরণা জোগায়। পুরস্কার পেলে মনে হয়, এই লেখালেখি ছাড়া যাবে না। এটাকে চালিয়ে যেতে হবে। তবে আমি কখনো কোনো পুরস্কারের আশায় লেখালেখি করিনি।
এ সময় প্রসঙ্গ টেনে হাসান আজিজুল হক বলেন, জীবনের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। পোকা যখন মানুষের মাথায় থাকে, তখন নড়াচড়া করে। লেখাও এক ধরনের পোকা। এটাও নড়াচড়া করে। এজন্য লেখার মধ্যে আছি এটা যদি নাও বলি, তবু লেখার মধ্যেই থাকছি। বাকি জীবনটুকু লেখালেখির মধ্যে কাটিয়ে দেবো। যে ক’দিন বাচঁবো, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখে যেতে চাই। তবে এখন লেখার চেয়ে পড়া বেশি হয়। অবসর সময়ে বই পড়ি। বিশেষ করে বিদেশি সাহিত্য।
দেশের তরুণ লেখকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, তরুণদের লেখা বই আমি পড়ি। তবে তরুণরা প্রচুর কবিতা লিখছেন। কিন্তু কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ, সমালোচনা সাহিত্যে খুব একটা কাজ হচ্ছে না। কবিতা লেখা সহজ কিন্তু সাহিত্য কঠিন। মনের ভেতর প্রাচুর্য না থাকলে সাহিত্য লেখা যায় না। তাই তরুণদের মনের প্রাচুর্য দিয়ে সাহিত্য রচনা করার চেষ্টা করতে বলবো।
হাসান আজিজুল হক ১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি অবিভক্ত বাংলার বর্ধমানের যবগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা তিনি নিজের গ্রামেই করেছেন। ১৯৫৪ সালে যবগ্রাম মহারানি কাশীশ্বরী উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৫৬ সালে খুলনার দৌলতপুরের ব্রজলাল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন তিনি। যৌবনের শুরুতেই প্রগতিশীল রাজনীতি করার কারণে পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়তে হয় তাকে। পরে তিনি ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে। ১৯৫৮ সালে এই কলেজ থেকে দর্শন শাস্ত্রে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৬০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭৩ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে অধ্যাপনা করেন।
তার গল্পগ্রন্থ সমুদ্রের স্বপ্ন, শীতের অরণ্য কিংবা উপন্যাস আগুনপাখি তাকে নিয়ে গেছে অনন্য এক উচ্চতায়। হাসান আজিজুল হকের উল্লেখযোগ্য রচনাগুলো- আত্মজা ও একটি করবী গাছ, জীবন ঘষে আগুন, পাতালে হাসপাতালে, নামহীন গোত্রহীন, চলচ্চিত্রের খুঁটিনাটি, মা মেয়ের সংসার, বিধবাদের কথা ও অন্যান্য গল্প, সক্রেটিস, বৃত্তায়ন, শিউলি, আগুনপাখি, ফিরে যাই ফিরে আসি, উঁকি দিয়ে দিগন্ত, একাত্তর: করতলে ছিন্নমাথা, লাল ঘোড়া আমি প্রভৃতি।
কথাসাহিত্যে অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার, পদক ও সম্মাননা। এর মধ্যে রয়েছে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৭), বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭০), অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১), আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩), অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪), ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮), কাজী মাহবুব উল্লাহ ও বেগম জেবুন্নিসা পুরস্কার।
এছাড়া ১৯৯৯ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন হাসান আজিজুল হক। ২০১২ সালে তিনি ভারতের আসাম বিশ্ববিদ্যালয় ও ২০১৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি পান।
সম্মাননাপ্রাপ্তির বিষয়টি জানার পর পাঠকদের ভালোবাসা ও শুভেচ্ছায় সিক্ত হচ্ছেন তিনি। রোববার সন্ধ্যায় থেকেই শুভেচ্ছা জানাতে তার বাসভবনে ছুটে আসছেন কবি, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিকর্মী, বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ।
সোমবার (১১ মার্চ) দুপুরে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার নূর-উর-রহমান ও রাজশাহী জেলা প্রশাসক এস এম আব্দুল কাদের তাকে শুভেচ্ছা জানান।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫২ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০১৯
এসএস/এএটি/এএ