ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

যাদের সঙ্গে কবিতার যোগ, তারা আত্মীয়: মুনমুন মুখার্জী

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর, ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০২০
যাদের সঙ্গে কবিতার যোগ, তারা আত্মীয়: মুনমুন মুখার্জী মুনমুন মুখার্জী

ঢাকা: কলাপাতা রঙের শাড়ি পরে বসে আছেন তিনি। ঠোঁটের কোণে চিরচেনা মিষ্টি হাসি। এ হাসি দেখলে বিশ্বাস হয় না, তিনি কবিতাকে ভেঙেচুরে একাকার করেন; নতুন করে কণ্ঠে গড়ে প্রাণ সঞ্চার করেন আরণ্যক বসুর ‘মনে থাকবে’, সৃজা ঘোষের ‘বছর চারেক পর’ অথবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ভালবাসি, ভালবাসি’র মতো অসংখ্য কবিতা। তিনি মুনমুন মুখার্জী।

খোলা চুলে গোলাপ গোঁজা দেখলেই বোঝা যায়, তিনি ভালোবাসতে পারেন, ভালোবাসায় বেঁধে রাখতে পারেন। আর সে বাঁধনেই বেঁধে রাখেন নিজের আবৃত্তিকে।

তার মতে, ‘যতক্ষণ ভালোবাসা রয়েছে, ততক্ষণ কোনো বিভাজন-ভেদাভেদ থাকে না। ’ তাই তো মৃদু হাসির সঙ্গে ভালোবাসা মিলিয়ে নরম গলায় কুশল জানালেন। আন্তরিকতায় শুরু করলেন আলাপ।

প্রথমেই কথা ওঠে ব্যক্তি মুনমুনকে একটু জানার জন্য। সে প্রশ্নের উত্তরে কণ্ঠে উচ্ছ্বাস নিয়ে বলেন, ব্যক্তি মুনমুনের শুরুটা একদম ছোটবেলা থেকে। চার বছর বয়স থেকে শুরু। তারপর চলতে থাকা এবং চলতে চলতে আজকে এখানে।

‘মাঝখানে একটা ছোট্ট বিরতি ছিল!’ বলতেই তিনি আবার শুরু করেন, হ্যাঁ, আসলে আমার মাঝখানে একটা বিরতি ছিল। আমি খুব ছোট থেকেই টেলিভিশনের সঙ্গে যুক্ত। চার বছর বয়স থেকে আবৃত্তি করি। আবৃত্তি সবসময়ই আমার সঙ্গে থেকেছে। বিয়ের পর কিছুটা সময় আমি দেশের বাইরে ছিলাম। সে সময় আমার সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে একটা বিরতি আসে। তবে সেটা শুধু অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিরতি। কেননা কবিতার সঙ্গে আমার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি, বরং সেটা আরও দৃঢ় হয়েছে। ওই বিরতির মধ্যে কবিতাকে আরও বেশি করে পেয়েছি। শুধু মঞ্চ মানেই কিন্তু কবিতার সঙ্গে সংযোগ নয়। কবিতার সঙ্গে সংযোগটা হচ্ছে প্রাণের যোগ। সেটা নানা রকমভাবে হতে পারে। সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় বিরতি হয়তো ছিল না, বরং আরও বেশি করে জড়িয়েছি।

শুধু যে কবিতার সঙ্গেই জড়িয়েছেন তা নয়! কবিতার সঙ্গে তো তার দৈনন্দিন ঘরকন্না। তার আবৃত্তির বিশেষ ঘরানা আলাদা করেই মুগ্ধ করে শ্রোতাদের। যেখানেই নিজের কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন কবিতার পংক্তি, পেয়েছেন দর্শক-শ্রোতার অফুরান ভালোবাসা, অভিনন্দন। সে হিসেবে কবিতার সঙ্গে যেমন নিজেকে জড়িয়েছেন, তেমনি ওপার বাংলার দর্শক-শ্রোতাদের সঙ্গে জড়িয়েছেন এপার বাংলার দর্শক-শ্রোতাদেরও। তাই জানতে চাওয়া, এপার বাংলার দর্শকদের কেমন লাগে তার?

জবাবে মুনমুন মুখার্জী বলেন, আমি দর্শক-শ্রোতাদের কখনো এখানকার, ওখানকার বা অন্য কোনো জায়গার বলে ভাবিনি। যারা সঙ্গে থেকেছেন, যারা শুরু থেকে ভালোবাসেন, আমি তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হই বা না হই, তারা পরম বন্ধু। যাদের সঙ্গে কবিতার যোগ, তারা আত্মীয়।

এ আত্মীয়ের জায়গা থেকেই এপার বাংলা বা ওপার বাংলা বলতে নারাজ তিনি। হিংসে করার মতো দারাজ কণ্ঠে তিনি বলে ওঠেন, এপার বাংলা-ওপার বাংলা কী করে হয়! ওপার বাংলাতে আমি যখন ‘ভালবাসি’ বলেছিলাম, তখন এপার বাংলাও একই রকমভাবে আমাকে ভালোবাসাটা ফিরিয়ে দিয়েছে। তাহলে এপার ওপার বিভাজনটা আর কোথায় থাকলো! কোথাও যেন বাংলা মিলে যায় ভালোবাসায়। সেই ভালবাসাটা সবসময়ই রয়েছে, থাকবে। আর যতক্ষণ ভালবাসা রয়েছে, ততক্ষণ কোনো বিভাজন-ভেদাভেদ থাকে না।

পেশাগতভাবে টেলিভিশনে কাজ করা এ উপস্থাপিকা ভেদাভেদ দেখেন না বাংলার ভাষা আন্দোলন, সাহিত্যচর্চা বা বর্তমান সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্যেও। সে ধারায় কথা ওঠে দুই বাংলার আবৃত্তিচর্চা নিয়েও। আবৃত্তির কথায় তার স্বপ্ন জাগে। নতুন স্বপ্ন নিয়ে তিনি বলতে শুরু করেন, প্রথম থেকেই এপার বাংলায় আবৃত্তিচর্চা চলছে। শুধু আবৃত্তি নয়, বাংলা সংস্কৃতির যে চর্চা, সব সময় সেটার অন্যতম ধারক ছিল এপার বাংলা। এ চর্চা একটি চলমান কার্যক্রম।

‘আবৃত্তিও এক ধরনের ভাষা আন্দোলন’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের যে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল, তার মধ্য দিয়ে নিজেদের ভাষার যে স্বীকৃতিটা আদায় করা হয়েছিল, সে আন্দোলনটা এখনো আবৃত্তি ও সংস্কৃতিচর্চার মধ্য দিয়ে চলছে। উত্তর প্রজন্মের কাছে আরও বেশি করে যেন বাংলা ভাষা, কবিতা ও সংস্কৃতি পৌঁছায়, সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এপার বাংলা। শুধু এপার বাংলায় নয়, দুই বাংলায় আমরা এটা করছি। মানুষের যে পরিমাণ আন্তরিকতা এক্ষেত্রে রয়েছে, তা আমাদের আরও অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।

আবৃত্তির কণ্ঠের মতো আন্তরিকতায়ও তিনি ভালোই বশ করতে জানেন। তাই প্রশ্ন ওঠে, আপনার আবৃত্তি মানুষের হৃদয় যেভাবে স্পর্শ করে, তা অন্য অনেক শিল্পীর ক্ষেত্রেই হয় না। এর পেছনের রহস্যটা কী?

এবার অনেকক্ষণ মৃদু হাসলেন তিনি। তাকালেন চারপাশে। তারপর বললেন, মানুষের আবেগ, ভালোবাসা বা কোনো আন্তরিকতা; এগুলো তো কখনো কোনো সূত্র দিয়ে গাঁথা যায় না। আমি তখনই একজনকে বুঝতে পারবো যখন সে আবেগ বা আন্তরিকতা আমার মধ্যেও থাকবে। সেটা কী নিয়ম মেনে হয় কখনো! সেটা নিয়ম মেনে হয় না বলেই হয়তো এত হৃদয়স্পর্শী হয়।

কথা শেষ করে আবারও চেনা হাসিটা হাসলেন মুনমুন মুখার্জী। চোখ তুলে তাকালেন দৃষ্টির সীমানায়। রাজধানীর শাহবাগের গণগ্রন্থাগারে ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমেছে। সন্ধ্যার সে মুখরতা ভাঙেন একদল মঞ্চকর্মী। জানান, এবার তার আবৃত্তি শোনানোর পালা। সে কথা শুনেই তিনি মিষ্টি হেসে বিদায় নেন। মঞ্চে উঠে জানান দেন, ‘ভালবাসি, ভালবাসি’।

বাংলাদশে সময়: ১০২৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০২০
এইচএমএস/এফএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।