ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

বনানী চক্রবর্তীর কবিতা

বনানী চক্রবর্তী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০২০
বনানী চক্রবর্তীর কবিতা বনানী চক্রবর্তী, ফাইল ফটো

খোজা

 

সেই সে অনেককাল ভালোলাগা জমে জমে মধু হয়ে গেলো... আমি তো সেই সে শ্রমিক, মূল অঙ্গ খোজা করে আছি... তোমার তোমার চারপাশে ভ্রম বিভ্রমে মূল অঙ্গ খোজা করে আছি... ওই ও শরীরখানি দীর্ঘ আয়না হলো, আমি ভগ্ন চোয়াল আর কোটরের চোখ আজ কোথায় লুকোবো বলো... ক্রমশ পরস্পরে গাঢ় আলিঙ্গনে ঘিরে পাঁজরে পাঁজরে জানালা ফোটাবো আর কী করে কীভাবে বলো... লালবর্ণ হৃদয়ের কাছাকাছি যাব বলে মূল অঙ্গ খোজা করে আছি...

তোমার পেটের ডিম তুমি সযতনে রাখো, ক্ষতি নেই, কিবা ক্ষতি, তার মাঝে অসংখ্য ভ্রুণ বেঁচে আছে... কে চেয়েছে ওর পরিচয়, কিবা এসে যায় বলো কীভাবে আকাশ ছুঁলো ওই ও প্রদীপ, কীভাবে সাগর ছেঁচে উঠে এলো ঝিনুকের বুক ছিঁড়ে মুক্তা কুমারী... এই দেখো আমি শিরস্ত্রাণ বর্ম ঢাল সব সব নিয়ে এই আগলে রয়েছি... তোমার কুঠুরি ভরে চাঁদ তোমার হৃদয় জুড়ে যদি কোনো চম্পা জেগে থাকে... স্মৃতি জাগানিয়া এক বাঁশির সুরের মাঝে বহু ফুল আহরিত পরাগের স্মৃতিগুলো যদি থেকে যায়, থাক থাক যেখানে যেমন... আমি হৃদয়ের উথাল পাথাল ঢেউয়ে স্থির করে করে দেখো, মূল অঙ্গ খোজা করে আছি...


চিতল হরিণ

 

হাতের শানিত ছুরি আস্তিনের নিচে রেখে বারে বারে মাখনের মিছরির গল্প কেন করে যাও বলো... আমি যে পাথর হয়ে গেছি... আমি যে পাষাণ হয়ে আছি... এই তো সেদিনও বাকলের ওপরে ওপরে ডোরা কেটে দিলে, খুদে খুদে লিখে দিলে ভালোবাসিলাম... তখনই ভেবেছো বুঝি আমিও তোমায় সেইবেলা, গাঢ় কোনো প্রণয়ীর চোখ নিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাব বলো... একমাত্র প্রেম বলে ঘোষণা দিয়েছে ঝরাপাতা... একমাত্র অধীনতা বলেছে মলিন উপত্যকা... যা বলে বলুক, যা হবার হবে হোক... এমন নিশানা নিয়ে তুমিইতো এককালে শিকার করেছো বলো চিতল হরিণ... দেওয়ালে টাঙানো আছে... পাতার মুকুট, ছাল বাকলের উপকথা শুনিয়ে শুনিয়ে তারে ডেকেছিলে বুঝি, আয়... আয়... আয়...

সে যাহাই হবে হোক, ওই রাজা বনের হরিণ খোঁজে, ওই রাজা আঁধার গহ্বর... বহুবিধ ক্রিয়া বিক্রিয়া নিয়ে রথ থেকে মাটিতে লুটায়... আমি কেন হাতে হাত দেব, আমি কেন গাগরির জলে আজও লালসা মেশাবো... আমি যে তোমারে জানি, জানি দূর নালন্দার ধ্বংস উপকথা... এও যে আমার জানা তুমি আজো জানো নাই বলো... বহুদিন পার করে শিকারি যখন লোকালয়ে শাঁস মাস বেঁচে, সকলেই হাত ভরে নেয়... নিষিদ্ধ মাংসের, আর বাসি মাংসের স্বাদ নিয়ে যাবতীয় আলোচনা থাক, আজ তবে থাক... ডালপালা শিং নিয়ে নিরাপদ স্থান খুঁজে কোথায় লুকোবো বলো, গ্রহ উপগ্রহ আদি সিন্ধু, অগ্নি শলাকা সবই যে কেমন কেমন চোখের অপর পারে বিদ্ধ করে দিয়ে চলে যায়...


ছায়াযুদ্ধ


এইবারও বুঝেছি কি, একখানি বাসগৃহ কতখানি বহুমূল্য হয়ে যেতে পারে... ধাতব পদার্থের মতো অধরাই থেকে যাবে যেন... বিনিময়ে তুমি যদি তুলে দাও একখানি যুদ্ধ পরবর্তী গ্রাম, ভস্মীভূত চারপায়ী কঙ্কাল কিছু... আমি দিশেহারা হব... আমার যে কমণ্ডলু রক্তাম্বর রুদ্রাক্ষমালা মন্ত্রহারা হয়ে গেছে... অথচ কেমন দেখো, ওদের কী করণীয় ছিল, আমরা আমরাই একে অপরের মুখ কালো করে দেব বলে বারুদ কিনেছি... আমরাই ঠেসে ঠেসে মেখে মেখে এই মুখ এই বুকে বারুদ ভরেছি... ছুঁড়ে দেব, আমার দিকেতে যদি প্রশ্নচিহ্ন ছুটে আসে, তক্ষুণি ছুঁড়ে দেব... এ জীবন প্রশ্ন নেবে না... যাবতীয় প্রশ্নহীন আনুগত্য আশা করে করে এ জীবন প্রশ্ন নেবে না... মাঝে মাঝে আমরা বরং এইসব কণাগুলো ছিটিয়ে ছিটিয়ে যাব উভয়ত:... ফোস্কা জীবন নিয়ে দিন শেষে গোপনে গোপনে দাওয়াই এর কাছে যাব... দরোজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে বড় আয়নার কাছে বসব গোপনে... খোলা অঙ্গ গোপনাঙ্গ চেয়ে চেয়ে দেখে নেব... কোথায় কিজানি ক্ষত...

আবার কোমর বেঁধে লেগে পড়া এ জীবন... সকাল হলেই দেখো আবার আবার আমাদের এ কেমন লড়াই জীবন... গাছেদের পাতাগুলি ঝরকে ঝরকে ঝরে... একটাও ছুঁয়ে নেই দেখো... হাড়ের গায়ের থেকে মাংস মাংস খসে যায়... যায় যাক... তোমার আমার মাঝে জয় পরাজয় জারি থেকে যাক... তাই হোক তাই হোক না হয় এবার...


বিজয় পতাকা


যুদ্ধ পরবর্তী চূর্ণ বিচূর্ণ সব সব পড়ে আছে...খণ্ড অখণ্ড সব... তুমি যে তোমার আঙুলের ইশারায় যুদ্ধ শান্তি যুদ্ধ শান্তি, স্থাপনার কথা বলো, আমি দিশেহারা আমি বেদনায় হলুদ গোলাপ... ওই ও হাতের বিস্তার কতদূর হতে পারে, নদী গিরি গ্রস্থ মেদিনী আর আর কত মরুভূমি পার হয়ে যেতে পারে ঘোড়ার খুরের শব্দ, যাবতীয় বল বীর্যকথা... আমার কানের মাঝে অবিরাম বিউগল বাজে, কাড়া নাকাড়ার ধ্বনি দ্রিম দ্রিম দ্রিম দ্রিম, বুক কেঁপে যায়... তাহলে কীভাবে বলো এ শতাব্দী সভ্যতা পেয়েছে... আধুনিক মানুষেও যুদ্ধ ভালোবাসে এত... ভিতর বাহির ভিতর বাহির এইভাবে এইভাবে যুদ্ধে যুদ্ধে ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়ে যায়, পড়ে থাকে ছিন্ন হাত, ছিন্ন ভিন্ন ওই ও নিতম্ব ভার... পুড়ে পুড়ে খাক কিছু চেনা ও অচেনা মুখ...

নির্বিকার চেয়ে চেয়ে কী ভেবেছো, কীভাবে সেজেছে আজো মেঘের আড়াল... এই গান এই সুর ভেরী দামামার মতো বেজে গেলে, আমি তানপুরা তুলে রেখে দেব... ওড়াও ওড়াও যে কোনো মূল্যে ওই গোলাপি পতাকা... রক্ত ধুয়ে ধুয়ে ফিকে হয়ে যাওয়া ওই গোলাপি পতাকা... দীর্ঘ শালতরু যত পাতা দান করেছিল কোনো পুরাণের কাল থেকে, আজ দেখো ভূমিতে লোটায়... এই জয় চেয়েছিলে বুঝি... গাঢ় গোলাপি এক জয়ের পতাকা... ফিকে হয়ে যাওয়া এক জয়ের বিস্ময়...


বোধন


একটা কথার কাছে দাঁড়াবে কি তুমি বলো, সামনে নদীর বাঁক, বটগাছ ছাওয়া পথে দাঁড়িয়ে রয়েছি... খাঁজে খাঁজে কাশফুল, দেবীর বোধন... এইখানে ছায়া, এইখানে তৃণহীন প্রান্তর ধুলো ধুলো ভয় নিয়ে মুখ বুজে আছে... বুক ভরে অনেক জিজ্ঞাসা... তালের পাতায় ঝুলে ঝুলে বেচেঁ আছে অনেক জিজ্ঞাসা... গোবর মাটিতে গাঁথা জোনাকি বিস্ময়...

তুমি এসো, বসবে আমার পাশে... স্বভাবসিদ্ধ ওই হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিলে ধরে নেব অধীনতা মিত্রতা নাকি একে অপরের আধিপত্য ভোগ করে যাই... বহুবিধ রাসায়নিক ক্রিয়া বিক্রিয়ার মাঝে তাপ বিকিরণকারী হয়ে আজো রয়ে গেছি... প্রকৃতপ্রস্তাবে কী গো আমাদের মাঝখানে সবটাই হতে পারে ফাঁকির কাহিনি... তোমার মণিতে দেখি বাদামি বাহার, আমার মণি কি কালো... আরও কিছু ঘন হয়ে এসো, বলো আমার মণি কি কালো... আমার গায়ের রঙ... তোমার চুলের ওই কুঞ্চিত বাহার, কোন কথা বলে দেবে ভেবেছো কখনো...

থাক না এসব কথা, তোমার কথাই বলো... তুমি এইখানে যদি দীর্ঘ স্নান পরবর্তী কোনো স্মৃতি নিয়ে এসে থাকো, আমি বলো দাঁড়াবো কোথায়... গলার মাঝের ওই উদাসীন আঁকা বাঁকা কথা যদি দীর্ঘ দীর্ঘ এক নদী হয়ে যায়... আমি ভাসবো কোথায়... শরীরের প্রতি রোমকূপ কলসপত্রী হয়ে ওই ঘ্রাণ নিয়ে নিয়ে পাতাল প্রবেশ হলে... বলো বলো এই আমি নামব কোথায়...

 

বনানী চক্রবর্তী
অধ্যাপক, বিদ্যানগর কলেজ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত। ভ্রমণ সাহিত্যে ডক্টরেট ডিগ্রি।

নাটক বিষয়ে একাধিক গবেষণা ও বহু বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশ হয়েছে। কবিতার বই, ছিন্ন খঞ্জনার মতো, ক্রমাগত চরকার ঘ্রাণ ও সংক্রমিত মেহগনি গাছ।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।