ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সোভিয়েত ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে এগিয়ে চলেছে রাশিয়া

শামীম খান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫১ ঘণ্টা, জুন ১২, ২০২১
সোভিয়েত ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে এগিয়ে চলেছে রাশিয়া রাশিয়ায় লেখক

[শামীম খান। বাংলানিউজের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।

সম্প্রতি তিনি রাশিয়া ভ্রমণ করেছেন। পাঠকের জন্য তিনি তুলে ধরেছেন সেই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আর রাশিয়ার এগিয়ে চলার খণ্ড খণ্ড চিত্র। আমরা তা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করব। আজ থাকছে এর প্রথম পর্ব। ]


ছোটবেলা থেকেই রাশিয়ার প্রতি আমার একটা আকর্ষণ তৈরি হয়। এই আকর্ষণ তৈরি হওয়ার পেছনের কারণ ছিলো মূলত রাজনীতি। তবে একজন পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে অথবা সাংবাদিক হিসেবে আমার নিয়মিত কাজের সেক্টরের বাইরে অন্য একটি সেক্টের কাজের সুবাদে রাশিয়া ভ্রমণের সুযোগ তৈরি হবে সেটা নিয়ে কখনও ভাবিনি।  

শুধু রাশিয়া নয়, বিদেশ ভ্রমণের প্রতি আমার একটা আকর্ষণ ছিলো। আর রাশিয়ার প্রতি এই আকর্ষণটা একটু বেশিই ছিলো। ব্যক্তিগত উদ্যোগে আমি বিদেশে যেতে পারবো এটা ভাবা আমার পক্ষে দুরূহ। কারণ অর্থনৈতিক দিকটা আমার অনুকূলে নয়। তবে আমি দশবারের মতো ভারতে গিয়েছি। এর মধ্যে দুই বার ছাড়া প্রতিবারই ব্যক্তিগত উদ্যোগে। কারণ কম খরচ বলেই আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে। প্রথম বার আমি গিয়েছিলাম আগরতলা ২০১২ সালের জানুয়ারিতে পেশাগত কাজে। আমার অফিস (বাংলানিউজ) থেকে পাঠানো হয়েছিলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগারতলা সফরের নিউজ কাভার করার জন্য। এটা আমার প্রথম বিদেশে যাওয়া। আর অনেক পরে একবার গিয়েছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর সঙ্গী হিসেবে তার শান্তিনিকেতন সফর কাভার করতে। ভারতে ঘোরার, দেখার তো শেষ নেই। এর ২৮টি রাজ্যের প্রত্যেকটিই এক একটি দেশ। দেশটির এক একটি রাজ্যের প্রতিটিরই অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, ভাষা, সংস্কৃতি, পরিবেশ, প্রকৃতির রয়েছে নানা বৈচিত্র, স্বাতন্ত্রতা। যদিও আমি যতবার ভারতে গিয়েছি, বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরেছি কিন্তু আমার ভারতে যাওয়া মানে বিদেশ যাওয়া মনে হয়নি। তবুও বিদেশ বলতে হবে, যেহেতু সীমান্ত রেখা দিয়ে বিভক্ত দুইটি দেশের যে কোনো একটিতে কেউ যেতে চাইলে অফিসিয়াল বাধ্যবাধকতাগুলো অনুসরণ করতে হয়। আমাদের এদেশ এখনও হয়তো ৪৭ পূর্ববর্তী ভারতবর্ষ হিসেবেই থাকতে পারতো। কিন্তু ধর্মীয় উন্মাদনার ভিত্তিতেই কেবল ভারত বিভক্ত হয়েছিলো। তবে ওই অর্থে বলতে গেলে আমার প্রথম বিদেশ ভ্রমণ ভিয়েতনাম। এর পর লাওস, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া গিয়েছি। এই দেশগুলো ভ্রমণের সুযোগ হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর সঙ্গী হিসেবে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সুবাদে। আর পেশাগত কারণে এই সুযোগ না হলে হয় তো কলকাতায় গঙ্গা নদীর পাড়, হাওরা ব্রিজ, দর্জিলিংয়ে টাইগার হিল থেকে সুর্যোদয় ও কাঞ্চনজঙ্গা দেখা, কালিংপং এর ডেলো পার্ক, শিলংয়ে উপকণ্ঠের এলিফ্যান্ট ফলস, চেরাপঞ্জির নোকালিক্যাল ফলস, আসামের কামাখ্যা মন্দির প্রভৃতি স্থানে ঘোরার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো বিদেশ ভ্রমণ। হয় দেখা হতো না ভিয়েতনাম যুদ্ধের ধ্বংযজ্ঞের ইতিহাসবাহী সামরিক জাদুঘর, সিঙ্গাপুরের সান্তসা সিটি, মেরিনা গার্ডেন, অস্ট্রেলিয়ার সিডনির দৃষ্টি নন্দন অপেরা হাউজ।  

তবে এই দেশগুলোতে যাওয়া আমার মধ্যে যতটুকু উৎসাহ কাজ করেছে তার চেয়ে অনেক বেশি উৎসাহ ও অনুভুতি কাজ করেছে রাশিয়ার ক্ষেত্রে। রাশিয়ায় অবস্থানের সময় এবং সেখান থেকে দেশে ফিরে বাংলানিউজে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখেছি। তবে সে লেখাগুলো ছিলো নিছকই রিপোটিং (প্রতিবেদন)। নতুন করে বিস্তারিতভাবে প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এই লেখাটি তৈরি করা।  

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বিষয়ক কাজের সূত্র ধরে আমার রাশিয়া যাওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে কিছু বলতে গেলে তার আগের কিছু কথা বলতে হয়। আমি মূলত একজন রাজনৈতিক রিপোর্টার (প্রতিবেদক)। রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম এবং প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক ঘটনাবলী, রাজনীতি সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়েই আমি কাজ (রিপোর্ট ) করি। একজন রাজনৈতিক রিপোর্টার রাজনীতির বাইরে অন্য বিষয় নিয়ে কাজ করে না বা করতে পারে না সেটা নয়। তবে সংবাদ মাধ্যমের প্রচলিত ধারায় সাধারণত নির্দিষ্ট কাজের বাইরে গিয়ে আমাদের কাজ করার আগ্রহ, সময়, সুযোগ কমই রয়েছে। বলতে গেলে এটাই বাস্তবতা। কারণ একজন রাজনৈতিক রিপোর্টারকে ভালো কিছু করতে হলে তার নির্ধারিত বিটে প্রচুর সময় ও শ্রম ব্যয় করতে হয়। এর বাইরে অন্য দিকে দৃষ্টি ঘোরানো যেমন সময় সাপেক্ষ তেমনি কর্মস্থলেরও কিছু গাইড লাইন থাকে। রাজনৈতিক বিটে কাজ করতে গিয়ে দেশের বাইরে বা অন্য দেশে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সুযোগ ও অভিজ্ঞতা আগেই হয়েছে যা ইতোমধ্যে উল্লেখ করেছি। তবে এই নির্ধারিত বিটের পাশাপাশি পারমাণবিক বিদ্যুৎ বা পরমাণু শক্তির ব্যবহার নিয়ে কাজের সূত্রে আমার রাশিয়া যাওয়ার সুযোগটি আসে। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক শক্তি করপোরেশন-রোসাটম এর আমন্ত্রণে রাশিয়া যাই।

রাজনৈতিক রিপোর্টিংয়ের পাশাপাশি পারমাণবিক বিদ্যুৎ বা পরমাণু শক্তির ব্যবহার নিয়ে কাজ করার শুরুর কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের কথা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ এ তিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। তার আগে থেকেই দীর্ঘ দিন তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির (কার্যনির্বাহী সংসদ) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদকের দায়িত্বে। অর্থাৎ এই সুবাদেই মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব পাওয়ার আগে থেকেই তার সঙ্গে পেশাগত কারণে আমার একটা সখ্যতা ছিলো। বিশেষ করে ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা কারাবন্দি হওয়ার আগের ও পরে সময়টায় প্রায় প্রতিনিয়তই ইয়াফেস ওসমানের সঙ্গে দেখা হতো। তখন দলটির অনেক নেতাই জেলে ও আত্মগোপনে। আবার নেতাদের কেউ কেউ প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। ওই সময় শেখ হাসিনার ধানমন্ডির বাসভবন সুধা সদনে নেতাকর্মীদের যাতায়াতও নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তখন আমরা সাংবাদিকরা সুধা সদনের সামনে কড়া পুলিশ ব্যারিকেড বাইরে দিনের পর দিন কাটিয়েছি। এর পর শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে সংসদ ভবনের পাশে বিশেষ করাগারে রাখা হলে সেখানেও আমাদের দিনের পর দিন কেটেছে। ওই সময় সুধা সদন এবং সংসদ ভবনের বিশেষ কারাগারের সামনে ইয়াফেস ওসমানের নিয়মিত আসা যাওয়া ছিলো। রাজনীতির ওই প্রতিকুল সময়গুলোতে তার সঙ্গে আমার প্রায়ই দেখা হতো, কথা হতো। এর পর দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন আসে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিশাল বিজয় নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে।  

আওয়ামী লীগ বিট কাভার করার কারণে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও নেতৃত্ব পর্যায়ের যারা মন্ত্রী তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখাটা আমার কাজের অংশ, প্রধান কাজও বলা যায়। সচিবালয়ে অনেকের মতোই ইয়াফেস ওসমানের দপ্তরেও মাঝে মধ্যে আমার যাওয়া হতো। কিন্তু রাজনৈতিক রিপোর্টের জন্য তার কাছে গিয়ে উল্লেখ্যযোগ্য কোনো তথ্য পাইনি। আলাপচারিতায় তিনি প্রায়ই বলতেন, আমরা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রণালয়কে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। রাশিয়ার আর্থিক, প্রযুক্তিসহ সব ধরণের সহায়তা দিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। তার কাছে গেলেই এই বিষয়টি নিয়ে সরকারের পদক্ষেপগুলো ও এ বিষয়ে অগ্রগতি এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ ও পরমাণু শক্তির ব্যবহার নিয়ে কথা বলতেন। তার কথা বলার মধ্যে দিয়ে যে সব তথ্য পেতাম এর ভিত্তিতেই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে মাঝে মধ্যে রিপোর্ট করতে থাকি। সব ধরনের প্রস্তুতির পর ২০১৩ সালের ২১ মে বাংলাদেশ সরকার এবং রাশান ফেডারেশনের মধ্যে (জি টু জি) চুক্তি হয় পাবনার ইশ্বরদীতে রূপপপুর পামাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের। এর পর রাশিয়ার সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, আর্থিক ও কারিগরিসহ সার্বিক সহযোগিতায় দেশটির রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক শক্তি করপোরেশন-রোসাটম এই প্রকল্পটি বাস্তায়ন করছে। এই প্রকল্পের কাজ শুরুর আগে রাজনৈতিক বিটে কাজের পাশাপাশি পরমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও এ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমার রিপোর্টিং চলতে থাকে। এর পর প্রকল্পের কাজ শুরু হলে এই বিষয়ে রিপোর্টিং আমার নিয়মিত কাজের অংশ হয়ে যায়।
 
এই রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে যে ধরনের রিয়্যাক্টর (মূল যাত্রাংশ) ব্যবহার করা হচ্ছে সেটি (ভিভিইআর-১২০০) রাশিয়ার উদ্ভাবিত বিশ্বে এ সংক্রান্ত সর্বশেষ প্রযুক্তির থ্রি জি(+)। রাশিয়ার পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোতে বর্তমানে ৩৬টি ইউনিট চালু আছে। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র দুইটি প্রকল্পে ২০১৯ সালে এই ভিভিইআর-১২০০ মডেলের রিয়্যাক্টর স্থাপন করা হয়েছে। এই ভিভিইআর-১২০০ মডেলের রিয়্যাক্টরের ইউনিটটি দেখাতেই রোসাটমের পক্ষ থেকে আমাদেরকে (৫ জন সাংবাদিক) রাশিয়া নিয়ে যাওয়া হয়। এ প্রকল্পের যন্ত্রাংশও রশিয়া থেকে তৈরি করে আনা হচ্ছে। গত বছর (২০২০ সাল) নভেম্বরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের ভিভিইআর-১২০০ রিয়্যাক্টরটি রূপপুর প্রকল্পে এসে পৌঁছেছে। চলবে...

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫০ ঘণ্টা, জুন ১২, ২০২১
নিউজ ডেস্ক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।