ঢাকা: সময়োপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন, সাশ্রয়ী জ্বালানি তেলের যোগান, যৌক্তিক সারচার্জ নির্ধারণসহ ফের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির কাছে লিখিত দাবি জানিয়েছে এভিয়েশন অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এওএবি)।
মঙ্গলবার (২০ ডিসেম্বর) বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি র আ ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপির বরাবর লিখিতভাবে এই দাবি জানানো হয়।
এওএবির মহাসচিব ও নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান ও ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এওএবির সহ-সভাপতি আবদুল্লাহ আল মামুন স্বাক্ষরিত ওই দাবিতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বেসরকারি এয়ারলাইন্স শিল্পের যাত্রা ও বিকাশ। তিনিই অভ্যন্তরীণ রুটে একচেটিয়া আধিপত্য ভেঙে ১৯৯৬-২০০১ সময়ে বেসরকারি এয়ারলাইন্স সেবার দ্বার উন্মুক্ত করেন। এই শিল্প প্রায় সিকি শতাব্দীর পথ পরিক্রময়ায় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছে। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বেসরকারি এয়ারলাইন্সই আকাশপথে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল। বর্তমানেও অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের শতকরা ৮০ ভাগই বেসরকারি এয়ারলাইন্স অবদান রাখছে। দেশে ব্যবসা বাণিজ্যের সম্প্রসারণ, অতি উচ্চ কারিগরী জ্ঞান সম্পন্ন মানব সম্পদ সৃষ্টি, জাতীয় কোষাগার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব দেওয়ার মাধ্যমে এই খাত জাতীয় পর্যায়ে এক অনন্য কৃতিত্বের অধিকারী।
এছাড়া আরও বলা হয়, বেসরকারি এয়ারলাইন্স খাত শুরু থেকেই নানাবিধ প্রতিকূলতার সম্মুখীন। সেই সঙ্গে দীর্ঘ কোভিড-১৯ অভিঘাত এবং বর্তমানে বিরাজিত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রেক্ষাপট, অতি মূল্যায়িত জ্বালানি তেল এই শিল্পকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। দেশের অর্থনীতির চাকা সচলকারী বেসরকারি এয়ারলাইন্সকে রক্ষায় ইতোপূর্বে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে এওএবির পক্ষ থেকে আবেদন জানানো হলেও এ পর্যন্ত কোনোন ফলপ্রসূ সমাধান মেলেনি। এয়ারলাইন্স খাত প্রকারান্তরে বাংলাদেশের জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত বাংলাদেশেরই সম্পদ, তাই এই খাতের বিরাজিত সমস্যা নিরসনের জন্য জনগনের প্রতিনিধিদের কাছে সমস্যার চিত্র ও সমাধানে সুপারিশ রাখছি। সেগুরো হচ্ছে-
১. আইন ও আদেশমালা: অত্যন্ত দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমার পর ২০১৭ সালে জাতীয় সংসদে বেসামরিক বিমান চলাচল আইন প্রণীত হয়। কিন্তু সেই আইনের আলোকে প্রয়োজনীয় নীতি এবং সিভিল এভিয়েশন আদেশমালা অপর্যাপ্ত এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এই সবকিছু উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল রেখে যথা শিগগিরই সম্ভব প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি।
২. জ্বালানি তেলের উচ্চ মূল্য: বাংলাদেশে অতি মূল্যায়িত জেট ফুয়েলের কারণে অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত। একটি এয়ারলাইনের পরিচালনা ব্যয়ের প্রায় ৫০ ভাগই খরচ হয় জেট ফুয়েলে। জেট ফুয়েল অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের জন্য বাংলাদেশে প্রায়ই আন্তর্জাতিক বাজার দরের তুলনায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেশি দাম কিনতে হয়। এছাড়াও অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করতে প্রায় ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ বেশি দামে তেল কিনতে হচ্ছে, আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার তুলনায়। বিশ্ব বাজারে যখন তেলের দাম বেড়ে যায়, তখন আমাদের দেশেও তা বাড়ানো হয়। কিন্তু বিশ্ব বাজারে যখন দাম কমে, তখন আমাদের এখানে তা কমানো হয় না। জেট ফুয়েল আমরা শুধুমাত্র পদ্মা অয়েলের কাছ থেকেই তেল কিনতে বাধ্য। আপনার অবগতির জানাচ্ছি যে, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) প্রতি মাসেই জেট ফুয়েলের দাম বাড়ায়।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে জেট ফুয়েলের দাম প্রতি লিটার ৪৬ টাকা ছিল। ক্রমান্বয়ে বেড়ে তা সর্বশেষ ডিসেম্বরে প্রতি লিটার ১২৩ টাকা হয়েছে। জেট ফুয়েল কেনার প্রক্রিয়াটি যদি আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের জন্য উন্মুক্ত থাকত তাহলে বিমান সংস্থাগুলো তাদের পছন্দ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান থেকে তা কিনতে পারত। অভ্যন্তরীণ জ্বালানির অতিমূল্যায়নের ফলে উড়োজাহাজের টিকিটের দাম যাত্রীদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। ফলে যাত্রী সংখ্যা হ্রাস ব্যাপক লক্ষণীয়, যা সাধারণ চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ কম।
৩. সিভিল এভিয়েশন কর্তৃক নির্ধারিত উচ্চহারে চার্জ ও সারচার্জ: সিভিল এভিয়েশনের নির্ধারিত চার্জগুলো (অ্যারোনটিক্যাল ও নন-অ্যারোটিক্যাল) বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক মানদণ্ডের প্রেক্ষিতে অনেক বেশি। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, সাধারণত: জ্বালানি তেল, গ্যাস বা অন্যকিছুর দাম বাড়ানোর আগে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। কিন্তু এভিয়েশনের ক্ষেত্রে সেই নিয়ম অনুপস্থিত। এছাড়া বকেয়া পাওনার ওপর নির্ধারিত সারচার্জও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। কোনো এয়ারলাইন্স সময়মত বিল পরিশোধ না করতে পারলে বকেয়া বিলের ওপর সারচার্জ দিতে হবে এই ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। তবে তার হার যৌক্তিক ও পরিশোধযোগ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ তার বিভিন্ন পাওনার ওপর মাসিক ৬% অর্থাৎ বছরে ৭২% হারে সারচার্জ আরোপ এবং তা চক্রবৃদ্ধি হারে নির্ধারণের মাধ্যমে মোট পাওনা আদায় করে। এই মাত্রাতিরিক্ত হার এয়ারলাইন্সকে বিরাট দেনার চাপে ফেলে দিচ্ছে।
৪. উচ্চ করহার ও বিদ্যমান বিধান: এয়ারলাইন সংস্থাগুলোকে (বাংলাদেশ বিমান ছাড়া) যন্ত্রাংশ আমদানিতে অনেক বেশি ট্যাক্স দিতে হয়। কাগজে কলমে উড়োজাহাজের খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানিতে শূণ্য শতাংশ ট্যাক্সের উল্লেখ থাকলেও ক্ষেত্র বিশেষে ১৫ থেকে ১৫০ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হয়। যন্ত্রাংশ কাষ্টমস ছাড় করণে হয়রানির স্বীকার হতে হয় এবং অযৌক্তিকভাবে বিরাট কর দিতে বাধ্য করা হয়। এমনিতেই উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশের দাম অনেক, তার মধ্যে উচ্চ হারে ট্যাক্স দেওয়ার ফলে তা দেশের এভিয়েশন খাতে নীরব ঘাতকের ভূমিকা পালন করছে। উড়োজাহাজগুলোকে সচল রাখতে অনেক সময় স্বল্প সময়ের মধ্যে দাম পরিশোধ করে খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি করতে হয়। কিন্তু এখানেও সমস্যা রয়েছে। খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি করতে হয় এলসির মাধ্যমে যা বিশ্বে কোথাও গ্রহণযোগ্য নয়।
৫. অসম প্রতিযোগিতা: প্রতি মাসেই জেট ফুয়েলের দাম বৃদ্ধির ফলে পরিচালনা ব্যয় মেটাতে সম্প্রতি বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো ভাড়া বাড়াতে বাধ্য হয়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, অভ্যন্তরীণ গন্তব্যে সরকার প্রদত্ত সহায়তায় বিমান বাংলাদেশ এয়ালাইন্স যাত্রী পরিবহনের ফলে বেসরকারি এয়ারলাইন্স এক অকল্পনীয় অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে। বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলোর চাইতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স অভ্যন্তরীণ সব রুটেই কম ভাড়া নির্ধারণ করেছে। যা কোনোভাবেই ব্যবসায়িকভাবে লাভজনক নয়।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স জাতীয় পতাকাবাহী সংস্থা হিসেবে আমাদের সবার গর্বের বিষয়। বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া এবং তার সুযোগ্য কন্যার হাতে পুনঃগঠিত বিমানকে আমরা প্রতিযোগী হিসেবে বিবেচনায় না নিয়ে অনুযোগী হিসেবে বিবেচনা করতে চাই। পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা একটি টেকসই ও সুস্থ এয়ারলাইন্স খাত গঠনে আমরা সংকল্পবদ্ধ।
চিঠিতে উপরোক্ত বিষয়ের আলোকে সংসদীয় কমিটির সভাপতিকে সুচিন্তিত এবং সুচারু পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০২২
এমকে/এমএমজেড