কেবিন সার্ভিস যেকোনো এয়ারলাইন্সের একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ডিপার্টমেন্ট। যারা প্রতিদিন প্লেন যাত্রীদেরকে সরাসরি সেবা দেওয়ার সুযোগ পেয়ে থাকেন।
দেশ-বিদেশ ভ্রমণ, আজন্ম লালিত স্বপ্নের জাল বুনে থাকে অনেক স্মার্ট-শিক্ষিত নারীরা। যারা আকাশছোঁয়ার স্বপ্ন দেখেন, পাখির মতো আকাশে উড়ে বেড়াতে চান, সারা বিশ্বকে খুব কাছ থেকে দেখতে চান, তাদের জন্য কেবিন ক্রুর চাকরি অনেকটা সোনার হরিণের মতো। সারা বিশ্বের প্রত্যেকটি এয়ারলাইন্সের কেবিন ক্রু বা এয়ার হোস্টেজ পদটির অধিকাংশই বরাদ্দ আছে উপরোক্ত গুণাবলির নারীদের জন্য।
বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি এয়ারলাইন্সের কেবিন ক্রু পদে সবাই বাংলাদেশি এবং অনেক বিদেশি এয়ারলাইন্সও বাংলাদেশি কেবিন ক্রু নিয়োগ দিয়ে যাচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে বিশেষ কারণ, বাঙালিরা জাতি হিসেবে খুবই অতিথিপরায়ণ। শিক্ষার পেছনে নারীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কেবিন ক্রুদের এয়ারলাইন্সে চুক্তিবদ্ধ হতে হয়। পরবর্তী সময়ে তা পুনঃচুক্তি করার সুযোগ আছে।
কেবিন ক্রু প্রত্যেক এয়ারলাইন্সের গন্তব্য বিশ্বের সব বড় বড় শহরে। আকাশ কন্যার চাকরির সুবাদে সব বড় বড় শহর, চিত্তাকর্ষক সব আধুনিক বিমানবন্দর দেখা হয়ে যায়। স্বল্প সময়ের জন্য শহর দেখারও সুযোগ থাকে অনেক সময়। শুধু চোখের কিংবা মনের তৃপ্তি নয়, এখানে আর্থিক সচ্ছলতাও একটা বড় ব্যাপার। নির্দিষ্ট বেতনের বাইরে যত বেশি আকাশ ভ্রমণ তত বেশি উপার্জন। সত্যিই বিচিত্র। প্রতিটি ফ্লাইটে শতাধিক যাত্রীকে সেবা দেওয়া আর কোন প্রফেশনে আদৌ সম্ভব নয়। সংখ্যার বিচারে প্রতিমাসে হাজার হাজার যাত্রীকে সেবা দেওয়া কোন হাসপাতালেও সম্ভব নয়। প্রতি ফ্লাইটে কত বিচিত্র রকম মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়। যা তার জ্ঞান ভাণ্ডারকেও করে সমৃদ্ধি।
সাবলীল বাচনভঙ্গী। নজরকাড়া সৌন্দর্য। স্বাভাবিক গড় উচ্চতার চেয়ে একটু বেশি। কেবিন ক্রু হওয়ার জন্য যোগ্যতা হিসেবে ন্যূনতম এইচএসসি বা এ লেভেল কিংবা সমমানের হতে হয়। সাধারণত বয়স ১৮ থেকে ২৫ বছর এর মধ্যে হতে হবে। মেয়েদের জন্য কমপক্ষে পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি এবং ছেলেদের জন্য পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি উচ্চতা থাকতে হয়, আর ওজন উচ্চতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। চোখের মাপ-৬/৬ (চশমা বা কন্টাক্ট লেন্স গ্রহণযোগ্য নয়)। হাতে কোনো কাটা দাগ কিংবা শরীরে কোনো ট্যাট্টু থাকতে পারবে না, যা সহজে দেখা যায়। সাঁতার জানা আবশ্যক। কোনো কারণে প্লেন যদি পানিতে অবতরণ করতে হয় সেজন্য বিমানবালাদের কমপক্ষে ২০ মিটার সাঁতার কাটার সক্ষমতা থাকতে হয়। ইংরেজি ও বাংলায় কথা বলা ও লেখায় দক্ষ হতে হবে, অন্য ভাষা জানা অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে দেখা হয়। সাধারণত বিভিন্ন এয়ারলাইন্স কেবিন ক্রুর জন্য অবিবাহিতদের অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে।
বর্তমানে এয়ার হোস্টেজ বা কেবিন ক্রু পেশা স্মার্ট ও সম্মানজনক হওয়ায় প্রতিনিয়ত প্রবল ইচ্ছাশক্তি, আত্মবিশ্বাস ও ঝুঁকি গ্রহণের দৃঢ় মানসিকতা নিয়ে এয়ারলাইন্সগুলোতে ভিড় করছে তরুণ-তরুণীরা। এছাড়া এ পেশায় আছে অ্যাডভেঞ্চার, গ্ল্যামার ও উচ্চ আয়ের পন্থা। তাই দিন দিন ক্যারিয়ার হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এ পেশা। সঙ্গে সঙ্গে তরুণদের মধ্যে পেশাটি হয়ে উঠেছে প্রতিযোগিতামূলক।
ক্রু দীর্ঘ প্রস্তুতি না থাকলেও কিছু প্রশিক্ষণ কোর্স করে দেশি ও বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোতে চাকরির সুযোগ নেওয়া যায়। সাফল্যের সঙ্গে এ ক্যারিয়ারে যুক্ত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীরা। বর্তমানে কেবিন ক্রু প্রশিক্ষণের জন্য কিছু একাডেমি আছে যেখানে প্রাথমিক ধারণা দিয়ে থাকে। এর মধ্যে এভিয়েশন কলেজ অব ইউনাইটেড, বাংলাদেশ বিমান ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, জবস এ-ওয়ান উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে এখন প্রতিবছর বিভিন্ন এয়ারলাইন্সে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কেবিন ক্রু নিয়োগ দিতে হয়। কারণ একটাই বেসরকারি এয়ারলাইন্সের অগ্রগতি।
স্মার্টনেস ও ভালো ইংরেজি বলার দক্ষতা আপনাকে এগিয়ে রাখবে এয়ার হোস্টেজ বা কেবিন ক্রু হওয়ার প্রতিযোগিতায়। কেবিন ক্রু বা এয়ার হোস্টেজ হতে চাইলে অধিক সুন্দর বা সুন্দরী হতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যোগ্যতাই হল আসল কথা। যেকোনো ধর্মের ছেলেমেয়েরা আবেদন করতে পারবে। প্রার্থীকে পরিচ্ছন্ন রুচি, মিষ্টি হাসি, অনেকক্ষণ এককভাবে কাজ করার ক্ষমতা, বিরক্তিকর পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক থাকা, উপস্থিত বুদ্ধিজ্ঞান, ধৈর্য ও সহনশীলতা, বিপদে সাবলীল মানসিকতা ও সবার সঙ্গে আন্তরিকতার সাথে মিশতে পারার ক্ষমতা এ চাকরিতে সফলতা এনে দেবে। আমাদের দেশের শত শত ছেলে-মেয়ে প্রতিদিন উড়ে চলেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে।
আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সগুলো কেবিন ক্রুদের বিভিন্ন দেশের বিলাসবহুল হোটেলগুলোয় থাকার ব্যবস্থা করে থাকে, যেখানে থাকা এবং খাওয়া সম্পূর্ণ ফ্রি। শুধু একজন ক্রু’র নিজের জন্যই নয়, তার পরিবারের সদস্যদের জন্যও আছে নানা ধরনের সুবিধা। পরিবারসহ বিভিন্ন দেশে কাজ করার সুযোগ হরহামেশাই পাওয়া যায় এ পেশায়।
বিশ্বের বেশিরভাগ এয়ারলাইনসের কেবিন ক্রু সদস্যদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। যাত্রীদের খাবার পরিবেশন ছাড়াও তাদের নির্দিষ্ট আসন খুঁজে পেতে সহায়তা করা, ওভারহেডে মালপত্র ওঠানামায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া, যাত্রীদের কেউ অসুস্থ হলে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা দেওয়ার মতো অনেক দায়িত্ব পালন করেন তারা। সব মিলিয়ে ফ্লাইটের অভ্যন্তরে বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের সময় যাত্রীদের নিরাপদে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে তাদের।
কেবিন ক্রুদের মাথার চুল অবশ্যই কাঁধের ওপর পর্যন্ত ছোট রাখা আবশ্যক। চুল লম্বা হলেও সেভাবে সাজিয়ে রাখতে হবে। আর চুলের রং হতে হবে স্বাভাবিক। প্রত্যেক ক্রুর হাত ও পায়ের নখ ছোট রাখা বাধ্যতামূলক। অনেক বিদেশি এয়ারলাইন্সে কেবিন ক্রুদের সুন্দর পা থাকাও বাধ্যতামূলক।
আপনার পরিচিত কিংবা আপনার বন্ধুই হয়ত কোনো না কোন এয়ারলাইন্সের কেবিন ক্রু তার কাছ থেকেও বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারেন, জেনে নিতে পারেন অনেক কিছু। উপর্যুক্ত গুণাবলি আর অদম্য ইচ্ছা থাকলেই সুদূর পরাহত নয়, আপনিও হয়ে যেতে পারেন কোন এয়ারলাইন্সের আকাশ কন্যা।
আজ ৩১ মে আন্তর্জাতিক কেবিন ক্রু দিবস। কানাডা ইউনিয়নের উদ্যোগে ২০১৫ সালে বিশ্বে প্রথম কেবিন ক্রু দিবস পালন করা হয়। প্রথম ৪৮০ জন কেবিন ক্রু নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দিবসটি উদযাপন করা হয়।
কেবিন ক্রু দিবসে বিশ্বের সব কেবিন ক্রুদের আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা। আপনাদের সেবায় হয়ে উঠুক বিশ্বের আকাশ পরিবহন অনন্য, যেখানে প্রতি পরতে পরতে বিছিয়ে থাকুক শান্তির পরশ।
লেখক: মো. কামরুল ইসলাম মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৫ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০২৩
এএটি