বইমেলা থেকে: একুশে বইমেলাকে কেন্দ্র করে এদেশের লেখক, কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রকাশক এবং বইপ্রেমীদের ভেতর গড়ে উঠেছে ভিন্ন মাত্রার এক আবেগ। মেধা-মননশীলতার সাথে দেশাত্ববোধের অনন্য এক মিশেলে এ মেলা চলে পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে।
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের বর্ধমান হাউস আর বহেরা তলাকে কেন্দ্র করে গত ৪২ বছরে গড়ে ওঠা মেলা প্রতিবছরই ছাড়িয়ে গেছে বিগত বছরের আয়োজনকে।
২০১৪ সালে এসে ঘটলো তার বেশ কিছু ব্যতিক্রম। আয়োজন সম্প্রসারিত হলেও সঙ্কুচিত হয়েছে মেলার বাহ্যিক সৌন্দর্য। ফলে বইমেলা হারিয়েছে তার চিরচেনা নান্দনিকতা।
তাড়াহুড়া করে সাজানো নিরস স্টলগুলো ছাড়া মেলার সৌন্দর্যে আর কিছুই যুক্ত হয়নি এবার। এমনকি উদ্বোধনী দিন ছাড়া মেলার ষষ্ঠ দিনেও সেই সুর বাজেনি কোথাও। যে সুর ব্যথা-ভালবাসা, দ্রোহ-ক্ষোভে জাগিয়ে তুলে অন্যরকম এক ব্যঞ্জনা।
আর এ কারণেই গতানুগতিক প্রায় সবকিছু থাকলেও মেলায় কি যেন নেই! বইমেলার একুশে মঞ্চে চলছে প্রতিদিনের সূচিবদ্ধ অনুষ্ঠান। বক্তারা বুদ্ধিবৃত্তিক, জ্ঞান-গম্ভীর আলোচনা করছেন। শিল্পীরা গান-কবিতা, পরিবেশন করছেন। কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে শুনছেন অনুষ্ঠান।
কিন্তু নেই বইমেলায় উৎসবের চিরায়ত সেই সুর, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...। ’
নেই আরো অনেক কিছু। একুশের চেতনায় প্রাঞ্জল অমর একুশে গ্রন্থমেলা এবার অনেকটাই অনুজ্জ্বল সাজসজ্জায়।
প্রতিবছর যেখানে মেলার শুরুর দিন থেকেই বর্ধমান হাউজের স্থাপন করা হতো স্টলপ্ল্যানার, এবার ষষ্ঠদিনেও তার দেখা নেই। একাডেমি প্রাঙ্গণে ভাষা শহীদদের আবক্ষ ভাস্কর্যের নিচে গাঁদা ফুলগুলো ফুটে না থাকলে মেলার উজ্জ্বলতা চোখেই পড়ত না।
একাডেমি প্রাঙ্গণের ভেতরে মেলায় প্রতিবছরের মতো এবারো ভাষা শহীদ, বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, লেখকদের নামে চত্বর করা হয়েছে। কিন্তু এসব চত্বরে প্যানাফ্লেক্সে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ছাপানো প্রতিমূর্তি ছাড়া আর কিছুই নেই। দৃষ্টিনন্দন তো দূরের কথা দৃষ্টিগ্রাহ্যও হয়নি তা। আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অংশে মেলায় তার ছিটেফোঁটাও নেই।
প্রতিবছর যেখানে বড় পর্দায় প্রদর্শন করা হতো বাঙালির ধারাবাহিক সংগ্রামের ইতিহাসভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র, এবারের মেলায় বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তাটিতে যান চলাচল ঠিক রাখতে গিয়ে সেটিও করা হয়নি। যদিও মেলা চলাকালে একরকম বন্ধই থাকে যেকোনো ধরনের যান চলাচল।
এদিকে বাংলা একাডেমি দায় সারছে মেলা সম্প্রসারণের কথা বলে। অথচ মেলা শুরুর কয়েকদিন আগে মেলা পরিচালনা পরিষদের সদস্য সচিব সাহিদা খাতুন বাংলানিউজকে জানিয়েছিলেন, দুই অংশের মেলার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে রমনা কালিমন্দিরের গেট বরাবর রাস্তায় বড় করে তোরণ নির্মাণ করা হবে। যেন পাঠক-ক্রেতা, দর্শনার্থীরা বিভ্রান্ত না হন।
কিন্তু বাস্তব চিত্র হলো তোরণ নির্মাণ করা হয়নি। কেন হয়নি তার একটি উত্তর বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে দেওয়া হয়। আরা তা হলো এবার মেলার স্পন্সর পাওয়া যায়নি।
অথচ নাম গোপন রাখার শর্তে বাংলা একাডেমির এক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, স্পন্সরের জন্য বাংলা একাডেমির থেকে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে মাত্র দুদিন আগে। ফলে কোনো পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসেনি।
এ কর্মকর্তা জানান, এর ফলে সরকারের এক কোটি টাকারও বেশি বাড়তি খরচ হচ্ছে। তিনি মনে করেন মেলা অনুষ্ঠানের স্থান নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা বা সিদ্ধান্তহীনতাই এর জন্য দায়ী।
এদিকে যতই দিন গড়াচ্ছে, মেলায় ক্রেতা, পাঠক, দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়ছে। বরাবরের মতো বর্ধমান হাউজের সিঁড়িতে স্থাপন করা হয়েছে বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্র। এখান থেকেই ঘোষণা করা হয় প্রতিদিনের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা, বইয়ের মোড়ক উন্মোচনসহ মেলাসংশ্লিষ্ট নানা তথ্য।
কিন্তু এই তথ্যকেন্দ্রের পাশেই স্থাপিত মিডিয়া সেন্টারে এসে ভিড় করছেন মেলায় আগতরা। তারা খোঁজ করছেন কাঙ্ক্ষিত স্টলের। আর এতে কিছুটা বিরক্ত হচ্ছেন সাংবাদমাধ্যমের কর্মীরা। একাডেমির ভেতরে বহেরাতলায় লিটলম্যাগ চত্বরের অবস্থা সব মিলিয়ে আরো সঙ্গিন। লেখকদের বাধভাঙা আড্ডা এবার যেন কিছুতেই জমে উঠছে না।
লিটলম্যাগ প্রকাশক বা সম্পাদকদের দাবি মূল মেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়াতেই এমনটা ঘটছে। তাদের অভিযোগ, এমনিতেই লিটলম্যাগের পাঠক সীমিত। তার উপর মূল মেলা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় এদিকটায় ক্রেতা বা পাঠক খুব একটা আসছেন না।
কোনো কোনো সম্পাদক বাংলানিউজকে বলেছেন, আর কয়েকদিন দেখবো, পরিস্থিতি খারাপ বুঝলে গুটিয়ে চলে যাব।
লিটলম্যাগ চত্বরে গিয়ে দেখা গেছে, এখনো অনেকগুলো স্টল ফাঁকা পড়ে আছে। আবার কয়কজন লিটলম্যাগ তরুণ সম্পাদক জানিয়েছেন, এবার পরীক্ষামূলকভাবে মেলা দুই অংশে হচ্ছে। আমরাও দেখতে চেয়েছিলাম, পুরো মেলাই আমরা থাকব। এরপর সিদ্ধান্ত নেব আমরা।
মেলায় আসা লেখক-পাঠক, দর্শনার্র্থীদের সাথে কথা হলে তারা জানান, মেলায় আসার উদ্দেশ্য কেবল বইকেনা নয়। তাহলে তো দোকান থেকেই কেনা যায়। মেলায় মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রিয় বইটি কেনার পাশাপাশি প্রাণের সাথে প্রাণ মেলানো। কিন্তু এবার সেই প্রাণটাই পাচ্ছি না।
তাদের কেউ কেউ মনে করছেন, দীর্ঘ ৪২ বছরের অভ্যস্ততার বাইরে এবারের মেলা। তাই কিছুটা ছন্দহীন মনে হচ্ছে হয়তো। কিন্তু সবমিলিয়ে স্পন্দনহীন মনে হচ্ছে এবারের মেলাটাকে।
বাংলাদেশ সময়: ২০৫৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৬, ২১০৪