ঢাকা, শুক্রবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বইমেলা

বইমেলায় গিয়ে বইমেলা প্রসঙ্গে লিখিত রচনা

আহমেদ স্বপন মাহমুদ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১৪
বইমেলায় গিয়ে বইমেলা প্রসঙ্গে লিখিত রচনা

গতকালই প্রথম মেলায় গেছিলাম। কেন জানি খুব টানে নাই এই বছর।

গত বছরও, খেয়াল আছে, প্রথম দিন থিকা সরব ছিলাম। এইবার মেলাকেন্দ্রিক নানা হাবভাব দেইখা ভালো লাগে নাই। তবে গতকাল মেলায় গিয়া মেলা বন্ধু কবি লেখকদের সাথে দেখা হইছে। এইটা নগদ লাভ। আড্ডা দিলাম, বই কিনলাম এইটাও লাভের মধ্যে ধরা যায়, তবে শর্তসাপেক্ষ, কারণ বইগুলি পড়া হয় নাই। পইড়া ভালো না হইলে সেইটা লাভের চেয়ে ক্ষতি বলা যায়। বই যাদের এখনো আসি আসি করছে তাদের গুলাও কিনবো। আর এইবার যাদের প্রথম কবিতার বই বের হইছে তাদের বইগুলাও কিনতে চাই। ইচ্ছার কাছে লাভালাভের হিসাব আপাতত বাদ।

কিন্তু কিছু বিষয় বাদ দিলে চলবে না। সিরিয়াস না, আবার নন-সিরিয়াস মনে করলেও বিপদ। তবে দুয়ের মাঝামাঝি মনে করলেও চলবে, সমস্যা নাই। যেমন, ভাবতাছি, মেলা দুই ভাগ হয়া গেল। সমস্যা না। আমাদের মন-মগজ, বিদ্যা-বুদ্ধি, হাত পা গুলা কী ঠিকঠাক আছে; নাই মনে হয়। কেন মনে হয় সেইটাও ভাবনার বিষয়। এই ঠিকঠাক ব্যাপারাটা অনেক কিছুর সাথে জড়িত। পকেটে টাকা থাকলে মন ভালো লাগে। দেশ ভালো থাকলে কাজকর্ম করা যায়। দেশের অসুখ হইলে সবার অসুখ হয় এইটা স্বাভাবিক। তবে কোনো কোনো শ্রেণি-গোষ্ঠীর অসুখ হয় না, তারা সুখে থাকে। এই মেলা নিয়া তাই বহুজন সুখে আছে। এইটা ভালো। একাডেমির পুরস্কার নিয়া অনুষ্ঠান হয়া গেল রীতির বাইরে, তাতে অনেকে খুশি। কেউ দিয়া কেউ পাইয়া। যেখানে সেখানে  হুকুমসমেত মনমর্জি মতো, দেনাপাওয়ার এই সুখ মজাদারই বটে! মাশাল্লাহ! একাডেমি এগিয়ে চল।

মেলায় গিয়া আমার চোখের বিপদ হয়। রঙের বাহারটা আমার সইতে কষ্ট হয়। মনে হয় চোখের ওপর হামলা করছে কেউ। যাচ্ছেতাই। এই রেওয়াজ কবে থিকা শুরু হইলো যে চার রঙা কভারসহ বই বের হবে। ভালো, এখানে একটা ব্যবসা আছে। রং তামাশার দুনিয়ায় রঙের খেলা হইবোই। কাল দেখলাম, কথিত লিটলম্যাগ বা সাহিত্যের কাগজগুলাও রংচং নিয়া বাজারে নামছে। ভালো! তারা বাদ থাকবে ক্যান? যেদেশে বিচার অচারের বালাই নাই সেইখানে রঙের বাছবিচার কইরা কী লাভ।

প্রকাশকরা মাশাল্লাহ সুখেই আছে, তবে তারা অসুখ বইল্লা চিল্লায় অনেক সময়; কেউ  কেউ অসুখে থাকে সেইটা মনে কইরা নিলাম। এই দেশে না প্রকাশক না লেখক কেউই আর পেশাদার হইতে পারে নাই। দুঃখজনক। মেলা আসলে কাবজাব পড়ে যায় বই প্রকাশের, ধর্না দেয়ার, ছাপাছাপির, চাপাচাপির। চাপা মারাও কম হয় নাই। দেখেন টিভিপত্রিকাওয়অলারাও রেগুলার মেলা কভার করে। সারা বছর বইপত্র নিয়া একটা কথাও শোনা যায় না। আহা! মেলা আসলে লেখক-প্রকাশকের সম্পর্কটা দারুণ হয়। প্রকাশকরা মোটামুটি পাইয়া বসে। লেখকরাও ছাইড়া দেয় না। কষাকষি চলতে থাকে। আচ্ছা, সারা বছর এই লেখক প্রকাশকরা কী করেন আল্লাহ মালুম! ইদমেলা আর বইমেলার পার্থক্যটা কবি লেখকরা বুঝতে পারলে ভালো।

এই যে এত জ্ঞানগরিমা নিয়া বেই বের হয় কারা পাঠক-ভোক্তা তাও বিস্ময়ের ব্যাপার। গতকাল মেলা ঢোকার আগে দেখলাম ইংরেজি শিক্ষার বিজ্ঞাপনসমেত দোকান, ফিতা চুড়ি চা-পান আর খাবারের দোকানের কমতি নাই। দরকার আছে! শত শত মানুষ যারা বের হইতাছে মেলা থিকা তাদের হাত খোলা। কারো হাতে প্রথমে নজরে এলো না যে বই আছে। প্রথম যারে দেখলাম, ভদ্রলোক ষাটোর্ধ, হাতে বই। তারপরে আরো কয়েকজন তরুণের হাতে, শিশুদের হাতে বই দেখলাম। কিন্তু এক শতাংশও না।

বইমেলা যদি মানুষের মেলা হয়, মন্দ কী! আজ কিনে নাই তো কাল কিনবে। না, কালও কিনবে না, এইটাই সমস্যা। আবার কিনবেই বা কেন? কেনার বই কয়টা থাকে? কেনার টাকা কই? বই কেনার কোনো প্রেরণা প্রণোদনা আছে সমাজে, সরকারে, বেসরকারে? নাই। প্রকাশকদের কোনো কর্মসূচি, নাই। পত্রিকাওয়ালাদের বুদ্ধিওয়ালাদের, এমনকি আমার আপনার কারো কোনো কথাবার্তা কর্মসূচি নাই। স্কুল কলেজে ইউনিভার্সিটিতে নাই। অফিস আদালতে নাই। তো, বই কিনবে কেন। যারা কিনে ফ্যাশন, রীতি, অভ্যাস, আগ্রহে, সংখ্যায় কম।

এর বিহিত আছে। একটা কর্মসূচি হাতে নেয়া যায়, সবই মিলে, কেউ কেউ মিলে। বই কেনার বই পড়ার একটা অভ্যাস গড়ে তোলা যায়। লেখকরা পেশাদার হইলে সমস্যাটা কমতো, প্রকাশকরা পেশাদার হইলে সমস্যাটা কমতো। মেলার জন্য বইসা থাকা ছাড়া তারা এই কাজটা করতে পারে।

ঢাকা বইমেলা কেন সফল হয় না? কারণ ফেব্রুয়ারির বইমেলা। এক মাস ধইরা মেলা করেতে হইবো ক্যান? ঢাকা বইমেলা সফল করেন। মার্চে স্বাধীনতা বই মেলা করেন, জুন-জুলাইয়ে আরেকটা মেলা করেন। জেলাগুলোতে মেলা করেন, বিভাগগুলোতে মেলা করেন। স্কুল কলেজে বই পড়ানোর অভ্যাস গড়ে তোলেন। কাজের কাজ হইতে পারে। যেভাবে মেধাবুদ্ধিশূন্য হয়া যাইতাছে পুরা জাতি তার ভবিষ্যত কী। দেশ কোনদিকে যাইতাছে?

তো, মেলায় গিয়া আড্ডা হইলো। কুমার চক্রবর্তী, রায়হান রাইন, সাখাওয়াত টিপু, রেজা ঘটক, বিধান সাহা, তানিম কবির, মামুন খান, সজল সমুদ্র, মহিম সন্নাসী, বিজয় আহমেদ, হিজল জোবায়ের, আল ইমরান সিদ্দিকী, কিশোর মাহমুদ, রহিমা আফরোজ মুন্নী, ফয়সাল আদনান, আন্দালীব, ডাল্টন সৌভাত হীরা, কুতুব হিলালী, মনজুর কাদেরসহ আরো অনেকের সাথে। ছবি তোলা হইলো গ্রুপে। মন্দ না। অর্বাক-এর চরটি বই কিনলাম। মহিম সন্নাসী, সূয্যমুখী, সঞ্জয় ঘোষ ও সিলভিয়া নাজনীন— চার কবির প্রথম বই। আগ্রহ আছে পড়বো। সজল সমুদ্রের বইটিও কাল এসেছে, নিয়ে নিলাম। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মেলায় যাওয়া হয় নাই, আগ্রহ পাই নাই খুব। একাডেমি প্রাঙ্গণের লিটলম্যাগ মেলায়ই চলে গেল সময়টা, গল্পে, আড্ডায়।

(লেখকের নিজস্ব ভাষারীতি অনুসরণ করা হয়েছে)   

লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক

বাংলাদেশ সময়: ১২৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।