বইমেলা থেকে: বাঙালির প্রাণের উৎসব অমর একুশের বইমেলার দ্বিতীয় দিনের শুরু থেকেই ক্রেতা-দর্শনার্থীদের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে।
সোমবার (২ ফেব্রুয়ারি) বেলা তিনটা থেকে শুরু হয় মেলার দ্বিতীয় দিনের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম।
মেলার বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি স্টলেই ক্রেতা-দর্শনার্থী রয়েছেন। ঘুরে ঘুরে পছন্দের বই খুঁজছেন তারা। পছন্দ হলে কিনেও নিচ্ছেন কেউ কেউ।
প্রকাশকরা বলছেন, ক্রেতাদের উপস্থিতি ভালো। তবে তাদের বেশিরভাগই এখনো বই কেনা শুরু করেননি। কেবল পছন্দের বই খুঁজছেন। তবে কয়েকদিন পর বই বিক্রি বাড়বে বলে আশা তাদের।
মিরপুর এলাকা থেকে বইমেলায় এসেছেন মাহমুদা পুষ্পিতা। বাংলানিউজকে তিনি বললেন, শুরুর দিকে মেলায় কিছুটা ভিড় কম থাকে। যার ফলে বিভিন্ন স্টলে গিয়ে বই পছন্দ করতে সুবিধা হয়। পছন্দের বই পেলে বই কেনার ইচ্ছা রয়েছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে বেলা তিনটা আট মিনিটে শুরু হয় তথ্যকেন্দ্রের আনু্ষ্ঠানিক কার্যক্রম। মোড়ক উন্মোচনের জন্য নজরুল মঞ্চও পুরোপুরি প্রস্তুত। সংবাদকর্মীদের জন্য বর্ধমান হাউজের উত্তর পাশে প্রস্তুত করা হয়েছে মিডিয়া সেন্টারও।
আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকবে মেলা। ছুটির দিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এবং একুশে ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মেলা চলবে।
বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং একাডেমির সামনের ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। গ্রন্থমেলায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে (৯২টি প্রতিষ্ঠানকে ১২৮টি ইউনিট) এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান (২৫৯টি প্রতিষ্ঠানকে ৪৩৭টি ইউনিট) মিলিয়ে মোট ৩৫১টি প্রতিষ্ঠানকে সর্বমোট ৫৬৫টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এবারই প্রথমবারের মতো বাংলা একাডেমিসহ মোট ১১টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে গ্রন্থমেলায় প্রতিটির জন্য ৪০০ বর্গফুটের প্যাভিলিয়ন প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ১০৬টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ১টি করে ইউনিট, ৯৬টি প্রতিষ্ঠানকে ২ ইউনিট, ৪৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৩টি ইউনিট এবং ১টি প্রতিষ্ঠানকে ৪ ইউনিটের স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বাংলা একাডেমির অভ্যন্তরীণ অংশে ৩২টি শিশু-কিশোর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ৪২টি ইউনিট, ২৫টি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে ৪৪টি ইউনিট, ১৯টি মিডিয়া ও আইটি প্রতিষ্ঠানকে ২০টি ইউনিট এবং ১৭টি অন্যান্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ২২টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এবার উন্মুক্ত জায়গাসহ ৭২টি লিটল ম্যাগাজিনকে বর্ধমান হাউজের দক্ষিণ পাশে লিটল ম্যাগাজিন কর্নারে জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র প্রকাশনা সংস্থা এবং ব্যক্তি উদ্যোগে যারা বই প্রকাশ করেছেন তাদের বই বিক্রি বা প্রদর্শনের জন্য জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের স্টলে রাখা যাবে।
বইমেলায় বাংলা একাডেমি তাদের প্রকাশিত বই ৩০ শতাংশ কমিশনে ও ২০০০ সালের আগে পর্যন্ত প্রকাশিত একাডেমির বই ৭০ শতাংশ কমিশনে এবং মেলায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ২৫ শতাংশ কমিশনে বই বিক্রি করবে। একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মিলে বাংলা একাডেমির ৫টি বিক্রয় কেন্দ্র থাকবে। এর একটি সম্পূর্ণ সাজানো হবে একাডেমি প্রকাশিত শিশু-কিশোর গ্রন্থ দিয়ে।
অমর একুশে গ্রন্থমেলা প্রাঙ্গণে গত বছর থেকে এ পর্যন্ত প্রয়াত দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের ১৩ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব কবি আবুল হোসেন, দার্শনিক সরদার ফজলুল করিম, ভাষা সংগ্রামী ও লেখক বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ইতিহাসবিদ সালাহ্উদ্দীন আহমেদ, চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, শিক্ষাবিদ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগম, ভাষা সংগ্রামী আবদুল মতিন, জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন, সাংবাদিক এবিএম মূসা, শিশুসাহিত্যিক এখলাসউদ্দিন আহমেদ, মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণাদায়ী গানের রচয়িতা গোবিন্দ হালদার, জিনবিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম স্মরণে স্মৃতি-স্মারক স্থাপন করা হয়েছে।
এছাড়া মেলায় আসা মানুষের বসার স্থানসহ নান্দনিক ফুলের বাগানও নির্মাণ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই কর্তৃপক্ষ গ্রন্থমেলায় তাদের নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি এবার গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন, তথ্যকেন্দ্রের সর্বশেষ খবরা-খবর এবং মেলার মূল মঞ্চের সেমিনার প্রচারের ব্যবস্থা করেছে। ওয়াইফাই সুবিধা রয়েছে মেলার উভয় অংশে।
গ্রন্থমেলার প্রবেশপথে আর্চওয়ে দিয়ে মেলায় প্রবেশের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। মেলার সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবে বাংলাদেশ পুলিশ, র্যাব, আনসার, বিজিবি, গোয়েন্দা সংস্থার নিরাপত্তাকর্মীরা। পাশাপাশি নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার জন্য মেলা প্রাঙ্গণে রয়েছে ৭৫টি ক্লোজসার্কিট ক্যামেরা।
মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশের একটি পথ এবং টিএসসি ও ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন দিয়ে মেলা থেকে বের হওয়ার দু’টি পথ রয়েছে। গ্রন্থমেলা সম্পূর্ণ পলিথিন ও ধূমপানমুক্ত থাকার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। দুই স্টলপ্রতি একটি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র এবং প্রশিক্ষিত অগ্নিনির্বাপক কর্মী থাকবেন। ইতোমধ্যে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে স্টলের কর্মীদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
দর্শনার্থীদের স্বচ্ছন্দে চলাফেরার সুবিধার্থে স্টলের সামনের চলাচল পথে কমপক্ষে ২০ ফুট করে উন্মুক্ত স্থান রাখা হয়েছে।
ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অবস্থিত স্বাধীনতা স্তম্ভ ও এর পাশ্ববর্তী জলাধারকে নান্দনিকভাবে গ্রন্থমেলার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে, যাতে স্বাধীনতার স্তম্ভের আলোক-বিচ্ছুরণে মেলা প্রাঙ্গণ আলোকিত হয়ে ওঠে। এছাড়া ইতোমধ্যে বাংলা বর্ণমালা ও ভাষা শহীদদের প্রতিকৃতি ও মহান ভাষা আন্দোলনের তথ্য সম্বলিত নানা স্মারকে মেলা প্রাঙ্গণকে একুশের চেতনায় সজ্জিত করা হয়েছে।
এদিকে বাংলা একাডেমির ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন সোমবার সকালের অধিবেশনে সৈয়দ শামসুল হক সাহিত্য সম্মেলনের ‘ধারণাপত্র’ উপস্থাপন করেন।
এ সম্মেলনে সৃষ্টিশীল সাহিত্যের তিনটি বিষয়ে তিন দিনব্যাপী দু’টি করে অধিবেশনে আলোচনা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সকাল ১০টা থেকে ১টা পর্যন্ত প্রথম অধিবেশন এবং বিকেল আড়াইটা থেকে সাড়ে ৫টা পর্যন্ত দ্বিতীয় অধিবেশন।
প্রতিটি অধিবেশনই অনুষ্ঠিত হচ্ছে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে।
সাহিত্য সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইডেন, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, মালয়েশিয়া, ইকুয়েডরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও ভাষার প্রায় পঞ্চাশজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কবি, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও সাহিত্য-সমালোচক অংশগ্রহণ করছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন ফ্রাঁস ভট্টাচার্য, হান্স হার্ডার, ফাদার দ্যতিয়েন, মারিয়া বারেরা হেলেনা, তবিয়াস বিয়ানওনে, দাতু ড. আহমেদ কামাল আবদুল্লাহ, জার্মেইন ড্রুগেনব্রুট, সিন্ডিলি ব্রাউন, পিটার নাইবার্স, জামি ঝু, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, নবনীতা দেবসেন, উদয় নারায়ণ সিংহ, কবি উৎপল কুমার বসু, কবি সুবোধ সরকার প্রমুখ।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের পাশাপাশি ত্রিপুরা, আসাম এবং বিহারের মৈথিলি ও ভোজপুরি ভাষার বেশ কয়েকজন সাহিত্যিকও এ সাহিত্য সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন।
এ ছাড়া মাসব্যাপী প্রতিদিন সন্ধ্যায় থাকছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে বাংলা একাডেমি শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, সাধারণ জ্ঞান, আবৃত্তি এবং উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে।
অমর একুশে গ্রন্থমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ২০১৪ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণগতমান বিচারে সেরা গ্রন্থের জন্য প্রকাশককে ‘চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার’ এবং শৈল্পিক বিচারে সেরা গ্রন্থ প্রকাশের জন্য ৩টি প্রতিষ্ঠানকে ‘মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ দেওয়া হবে। এছাড়া ২০১৪ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণগত মান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থের জন্য ১টি প্রতিষ্ঠানকে প্রথমবারের মতো ‘রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার’ এবং এ বছরের মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে স্টলের নান্দনিক সাজসজ্জায় শ্রেষ্ঠ বিবেচিত প্রতিষ্ঠানকে ‘কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ প্রদান করা হবে।
মাসব্যাপী গ্রন্থমেলায় এবার ৪ দিন শিশুপ্রহর ঘোষণা করা হবে।
এবারের মেলার পৃষ্ঠপোষক টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেড আর আইটি সহায়তায় রয়েছে স্টেপ মিডিয়া।
বাংলাদেশ সময়: ১৮০৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০১৫