বইমেলা থেকে: অমর একুশে গ্রন্থমেলায় আসছে আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ, মনোরম অঙ্গসজ্জার নতুন নতুন বই। এসব বইয়ের শরীরে জড়িয়ে থাকা হরেক রকম প্রচ্ছদ ছড়াচ্ছে নতুন বার্তা।
নানা স্টলে শোভা পাচ্ছে থরে থরে সাজানো বইয়ের স্তুপ। স্টলের সামনেও সারিতে মেলে ধরা হয়েছে বই।
বাংলা একাডেমি আয়োজিত এ মেলার দ্বিতীয় দিনে সোমবার (২ ফেব্রুয়ারি) এসেছে ৩৫টি বই। একাডেমির নজরুল মঞ্চে বেশ ঘটা করেই ৬টি বইয়ের মোড়ক খোলা হয়।
গ্রন্থমেলা ঘুরে দেখা গেছে, দ্বিতীয় দিনেও গুছিয়ে উঠতে পারেনি গ্রন্থমেলা। হাতে ছয় দিনের সময় পেয়েও অনেক প্রকাশক এখনো স্টলের অবকাঠামো নির্মাণই শেষ করতে পারেননি। অন্যদিকে মেলায় হরতাল-অবরোধ উপেক্ষা করেও বইপ্রেমিদের ভিড় বাড়তে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন প্রকাশকরা।
গ্রন্থমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অংশে গিয়ে দেখা যায় অগোছালো চিত্র। বিশেষ করে এখনো বেশ কিছু স্টলের সাজসজ্জার কাজ বাকি থাকায় সন্ধ্যা নাগাদও বই ওঠেনি তাকে। কাঁচা রংয়ের গন্ধ, বাঁশে পেরেক ঠোকার আওয়াজ, ব্যানার টানানো, বই ওঠানোতেই ব্যস্ত দেখা গেছে অনেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে।
ধ্রুবপদ, বাঙলায়ন, অগ্রদূত, পাঠক সমাবেশসহ বেশ কয়েকটি স্টলে এখনও পেরেক ঠুকোনির শব্দ অব্যাহত রয়েছে। এসব স্টলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, সোমবার রাতের মধ্যে মধ্যে স্টলের নির্মান কাজ শেষ হয়ে যাবে।
বইমেলার এমন সাজগোজের মধ্যেও স্টল ঘুরে ঘুরে নতুন বইয়ের পাতা উল্টেপাল্টে দেখছেন নানা বয়সের পাঠক। কেউ পড়ছেন ভূমিকা, পছন্দ হলে কিনেও নিচ্ছেন কেউ কেউ। প্রিয় লেখকের নতুন বইয়ের তথ্য সংগ্রহে অনেকে ব্যস্ত ছিলেন।
তবে ক্রেতার চেয়ে দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল বেশি। মেলার মাঠ ছিল প্রায় ফাঁকা। কয়েকটি স্টলের সামনে জটলা দেখা গেলেও মাঠে ছিল শূন্যতার নীরবতা।
মেলার অলিগলি ঘুরে বেড়িয়েছেন নবীন-প্রবীণ কবি, লেখকরা। তারা একে অন্যের বইয়ের খোঁজ নিয়েছেন, নিজের বইয়ের খোঁজ দিয়েছেন। এরকম অবস্থার মধ্য দিয়ে কাটে প্রাণের বইমেলার দ্বিতীয় দিনটি।
ধানমণ্ডি থেকে মেলায় আসা নিশাদ সুলতানা বাংলানিউজকে বলেন, মেলার দ্বিতীয় দিনেও স্টলের কাজ চলছে। এটা মোটেও কাম্য ছিল না। এছাড়া বইমেলা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান দু’ জায়গায় হওয়ায় কিছুটা অসুবিধাও হচ্ছে।
মন্ত্রীদের মেলা দর্শন
গ্রন্থমেলার দ্বিতীয় দিনে মেলা পরিদর্শন করেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। মেলায় মুক্তিযোদ্ধা আমিনা বেগম ও শেখ আব্দুর রাজ্জাক রচিত ‘ঠিকানা ৭১’ নামের একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বাংলা একাডেমির অভ্যন্তরে বেশ কয়েকটি স্টল ঘুরে দেখেন।
দ্বিতীয় দিনে ৩৫টি বই
একাডেমির সমন্বয় ও জনসংযোগ উপ-বিভাগের প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, মেলার দ্বিতীয় দিন প্রকাশিত হয়েছে ৩৫টি নতুন বই। এর মধ্যে গল্পগ্রন্থ ৩টি, কবিতাগ্রন্থ ১১টি, প্রবন্ধগ্রন্থ ৪টি, উপন্যাসগ্রন্থ ৬টি, ছড়াগ্রন্থ ১টি, জীবনীগ্রন্থ ১টি, নাট্যগ্রন্থ ১টি, শিশুসাহিত্য ১টি, ভ্রমণকাহিনী ১টি এবং অন্যান্য বিষয়ের ওপর ৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
অনুপম প্রকাশনী থেকে এসেছে ড. মাহবুব সাদিকের ‘সাহিত্যের শিল্প প্রতিমা’, প্ল্যাটফর্ম প্রকাশনী থেকে হাসান শান্তনুর ‘৪৩ বছরে গণমাধ্যমের অর্জন বিসর্জন’, দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘সাকিব আল হাসান: আপন চোখে ভিন্ন চোখে’, সাহস পাবলিকেশন্স থেকে সাযযাদ কাদিরের ‘এই সময়ের কবিতা’ ও সাহস রতনের ‘ক্যামনে কি!’, বাংলাপ্রকাশ এনেছে বুলবুল ওসমানের ‘শিল্পাচার্যের ছবি ব্রক্ষ্মপুত্রের জলে বির্জন দেওয়া হোক’, ঐতিহ্য থেকে শারমিন আহমেদের ‘তাজউদ্দিন আহমদ: নেতা ও পিতা’, আসাদুল ইসলামের ‘দ্য ম্যাড’, চন্দ্রদীপ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে বুলবন ওসমানের ‘একটি গ্রামোফোনের রেকর্ড’, সাহস পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত হলো রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতার বই ‘দ্রোহের কবিতা’ ইত্যাদি।
মোড়ক উন্মোচন
দ্বিতীয় দিনে একাডেমির নজরুল মঞ্চে ছয়টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে। মোড়ক উন্মোচন করা বইগুলো হলো ‘ঠিকানা ৭১’, ‘তোল শান্তির ডাক’, ‘স্বপ্ন দিশারী’, ‘নারী শিক্ষার অগ্রদূত নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী’, ‘সোনামনিদের বর্ণ ও ছড়া ও পেন্টকল্প’।
আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের ২য় দিন
দ্বিতীয় দিন সাহিত্য সম্মেলনের প্রথম কর্ম অধিবেশনের শুরুতে সকাল ১০টায় ‘এই সময়ের সাহিত্য’ শীর্ষক সম্মেলনের ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন সৈয়দ শামসুল হক। ধারণাপত্রে তিনি বলেন, সাহিত্য সত্যকে ধারণ করে। মানবীয় অভিজ্ঞতায় জীবনকে ঋদ্ধ করার যে পন্থা সাহিত্য নির্দেশ করে এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে আমরা তার রূপরেখার সন্ধান পেতে পারি।
এরপর ‘এই সময়ের কথাসাহিত্য’ শীর্ষক দিনব্যাপী অধিবেশনের প্রথম পর্বে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন কথাসাহিত্যিক জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, নবনীতা দেব সেন এবং বিহার থেকে আসা সাহিত্যিক দিলীপ সিনহা।
আলোচকরা বলেন, বাংলা এখন শুধু রাষ্ট্রীয় ভাষা নয়, আন্তর্জাতিক ভাষাও বটে। এ ভাষার কথাসাহিত্যিকরা যেমন শিল্পমান সম্পর্কে সচেতন তেমনি মানুষের অধিকারের কথা নতুনতর গদ্যরীতিতে পরিস্ফুট করছেন। তবে বাংলা ভাষা চর্চা নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভোগার কোনো সুযোগ নেই। কারণ বিশ্বায়নের ঢালাও প্রভাবে ভাষাও আজ এক জটিল পরিস্থিতিতে উপনীত। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কথাসাহিত্য-পরিসরে দলিত সাহিত্য, নারীস্বর ইত্যাদি প্রপঞ্চকে গুরুত্ব দিতে হবে।
বেলা ১১টায় দ্বিতীয় অধিবেশনে ‘Chronicles of our time the contemporary fiction Bangladesh’’ শীর্ষক সমকালীন কথাসাহিত্য বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কথাশিল্পী সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, সাহিত্যের লিখিত রীতির পাশাপাশি মৌখিক কথকতার রূপরীতিকে সাম্প্রতিক সাহিত্যে আমরা অঙ্গীকৃত দেখতে চাই। এর মধ্য দিয়ে সাহিত্যের সর্বব্যাপ্ত অবয়বের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পথ পাওয়া যেতে পারে।
দুপুর ১২টায় তৃতীয় অধিবেশনে ভারতের প্রখ্যাত বাঙালি কথাশিল্পী শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এবং বাংলাদেশের সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে আলাপচারিতায় মিলিত হন কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন। আলাপনে অংশ নিয়ে কথাসাহিত্যিকরা বলেন, সাহিত্যিককে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে নবায়ন করে নিতে হয়। চারপাশের মুহুমূর্হু পরির্বতনকে আত্মস্থ করতে হয় এবং ইতিবাচক দৃষ্টিতে জীবনকে অবলোকন করতে হয়। জীবনরসের সন্ধান না পেলে সাহিত্য মানুষের সঙ্গে সংযোগহীন হতে শুরু করে। তবে প্রকৃত লেখক লেখেন নিজেরই জন্য।
বিকেল ৩টায় চতুর্থ অধিবেশনের সূচনা হয় পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট কবি শ্রীজাতের কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে। ইংরেজি পর্বে কথাশিল্পী মনজু ইসলাম এবং কাজী আনিস আহমেদের সঙ্গে আলাপচারিতায় মিলিত হন ড. নিয়াজ জামান।
এ আলাপনে লেখকরা বলেন, বাঙালি লেখকদের ইংরেজি কথাসাহিত্যে প্রান্তীয় মানুষের স্বর যেমন উঠে আসে, তেমনি নতুন এক সাহিত্যরীতিরও তারা জন্ম দিয়ে চলেন। যার মধ্যে সময়-দেশ ও মানুষের মহাস্বরই প্রতিধ্বনিত হয়ে চলে। মনজু ইসলাম এবং কাজী আনিস আহমেদ তাদের উপন্যাসের নির্বাচিত অংশ পাঠ করে শোনান।
বিকেল ৪টায় পঞ্চম অধিবেশনে ছিল সাহিত্য থেকে পাঠ ও আলোচনা। এতে অংশ নেন পূরবী বসু, আনোয়ারা সৈয়দ হক, আনিসুল হক, জাকির তালুকদার, ইমানুল হক। এ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক উদয় নারায়ণ সিংহ।
মূলমঞ্চের আয়োজন
বিকেল ৪টায় মেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘প্রমিত বাংলা ভাষা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক স্বরোচিষ সরকার। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ফিরোজা ইয়াসমীন, ড. মনিরুজ্জামান, অধ্যাপক গোলাম মুরশিদ এবং অধ্যাপক জিনাত ইমতিয়াজ আলী। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক পবিত্র সরকার।
সন্ধ্যায় ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০১৫
** বইমেলার কোথায় কি…
** বাংলা একাডেমি এনেছে নতুন ৯৫ বই
** বইমেলায় ডোরেমন-পোকেমন-মিস্টার বিন নিষিদ্ধ
** বইমেলায় ক্রেতা-দর্শনার্থীদের ভিড়