বইমেলা থেকে: ‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান/আমার আপনহারা প্রাণ/আমার বাঁধন ছেঁড়া প্রাণ/তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান...। ’
পরনে বাসন্তী রঙের শাড়ি, খোঁপায় হলুদ গাঁদার মালা।
শীতের শুষ্কতাকে বিদায় করে, সজীবতার আহ্বান জানিয়ে এসেছে ঋতুরাজ বসন্ত। ঋতুরাজের আগমনীতে নবরূপে সেজেছে প্রকৃতিও। বসন্তের প্রথম দিনে মেলায় লেগেছিল ফাগুনের রঙ। মেলাজুড়ে যে দিকেই চোখ গেছে শুধুই হলুদ আর বাসন্তী রঙের সমারোহ। বইমেলাজুড়েই বসেছিল রঙের মেলা। তরুণীদের পাশাপাশি পিছিয়ে ছিল না তরুণরাও। তাদের সাজসজ্জায়ও লেগেছিল বসন্তের রঙ। হলুদ, লালসহ নানা রঙের পাঞ্জাবি আর ফতুয়ায় নিজেকে সাজিয়ে তুলেছিলেন তারা।
শুক্রবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম দিনে এমন সাজ ছিল মেলায় আগত অধিকাংশ মানুষের।
বসন্ত আর ফাগুনের প্রথম দিন হওয়ায় উপচেপড়া ভিড়ই আশা করছিলেন প্রকাশকরা। তাদের আশাকে নিরাশার বালুচরে না ডুবিয়ে স্রোতের মতো মানুষ প্রবেশ করেছেন বইমেলায়। টিএসসি থেকে আণবিক শক্তি কমিশন ও দোয়েল চত্বর থেকে পুষ্টি ভবনের গেট, বইমেলায় প্রবেশের দু’টি পথেই এদিন ছিল দীর্ঘ লাইন।
হলুদ রঙে রাঙা এসব পাঠক-দর্শনার্থীকে সারিবদ্ধভাবে দেখে মনে হচ্ছিল এ যেন হলুদ কোনো ফুলের বাগান।
শুক্রবার বইমেলার দুয়ার বেলা ১১টায় খুললেও দুপুর থেকেই মূলস্রোত দেখা গেছে। দুপুর ২টা না বাজতেই সারিবদ্ধ মানুষ মেলায় প্রবেশ করেছেন। বিকেল গড়াতেই মেলা জনস্রোতে পরিণত হয়। বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেনো তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। সন্ধ্যা ৭টায়ও দেখা গেছে, স্রোতের মতো মানুষ মেলায় প্রবেশ করছে আর বের হচ্ছেন।
বসন্তের ছোঁয়া যে শুধু পাঠকদের মাঝেই লেগেছিল, তা কিন্তু নয়। ফাগুনের রঙে নিজেকে রাঙিয়ে তুলেছিলেন স্টলগুলোর বিক্রয়কর্মীরাও। শুধু উপচেপড়া ভিড়ই ছিল না, ছিল প্রকাশকদের মুখে হাসি ফোটানোর মতো বিক্রিও। মেলার প্রায় প্রতিটি স্টলেই ছিল বইপ্রেমীদের ভিড়। বইপ্রেমীরা বসন্তের রঙের সঙ্গে নিয়েছেন নতুন বইয়ের ভাঁজ খোলার মন মাতানো গন্ধ। যাচাই-বাছাই আর পরখ করে কিনে নিয়েছেন পছন্দের লেখকের নতুন বই।
এদিন বিকেলে মেলায় এসেছেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল। মেলায় প্রবেশ করতেই ভক্তরা তাকে ঘিরে ধরেন। ফটোগ্রাফ আর অটোগ্রাফে ভক্তদের সঙ্গে ব্যস্ত ছিলেন বিকেল থেকে সন্ধ্যা নাগাদ পর্য্যন্ত।
এরই ফাঁকে বললেন, বসন্তের প্রথম দিনে মেলায় এসে মনটা ভরে গেলো। এত মানুষ, খুবই ভালো লাগছে। মানুষ সব শঙ্কা কাটিয়ে এভাবেই এগিয়ে যাবে বলে আমি মনে করি।
শুক্রবার সকাল ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ছিল শিশু প্রহর। এসময় অভিবাবকদের সঙ্গে করে মেলায় এসে নিজেদের পছন্দের বই কিনে নিয়েছে শিশুরা।
মেলার সবচেয়ে খুদে লেখকের বই
মেলায় সম্ভবত সেই সবথেকে ছোট লেখক। বয়স মাত্র সাড়ে সাত। লিখেছে গল্প। এই খুদে লেখকের নাম অলীন বাসার। তার গল্পের বই ‘অন্ধকারে ভূতের ছায়া’। একাডেমির নজরুল মঞ্চে শিশুপ্রহরে বইটি মোড়ক উন্মোচন করা হয়। বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক যৌথভাবে বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন।
অন্ধকারে ভূতের ছায়া বইটিতে ১৭টি গল্প রয়েছে। প্রতিটি গল্পের সঙ্গে আছে নীতিকথা। গল্পের সঙ্গে সুন্দর ছবি। প্রতিটি গল্পের সঙ্গে রঙিন ছোটদের উপযোগী ছবি। বইটির দাম একশত টাকা। প্রকাশ করেছে সাঁকোবাড়ি প্রকাশন। বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেছেন অনন্য বাসার। এছাড়াও শুক্রবার মেলার নজরুল মঞ্চে ১৩তম দিনে আরো ২৫টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হয়েছে।
রেকড সংখ্যক বই
মেলার ১৩তম দিনে রেকর্ডসংখ্যক বই এসেছে। যা ১৩দিন পর্য্যন্ত সর্বাধিক। একাডেমির সমন্বয় ও জনসংযোগ উপবিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, শুক্রবার মেলার ১৩তম দিনে ৩১১টি নতুন বই এসেছে। এর মধ্যে গল্প ৫৬টি, উপন্যাস ৭২টি, প্রবন্ধ ১৫টি, কবিতা ৬১টি, গবেষণা ৭টি, ছড়া ১১টি, শিশুতোষ ৬টি, জীবনী ৪টি, মুক্তিযুদ্ধ ৫টি, নাটক ১টি, বিজ্ঞান ৫টি, ভ্রমণ ৭টি, ইতিহাস ৬টি, স্বাস্থ্য ২টি, কম্পিউটার ১টি, ধর্মীয় ৫টি, অনুবাদ ১টি, সায়েন্স ফিকশন ৪টি, অভিধান ১টি ও অন্যান্য বিষয়ের উপর এসেছে ৪১টি নতুন বই।
উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে মহাকাল থেকে প্রকাশিত আবদুল গাফফার চৌধুরীর ‘বিলাতের রাধা’, বাঁধন পাবলিকেশন্স থেকে ওবায়দুল কাদেরের ‘মেঘে মেঘে অনেক বেলা’, ঝিনুক প্রকাশনী থেকে সেলিনা হোসেনের ‘মুক্তিযুদ্ধের দু’টি উপন্যাস’, সৃজনী থেকে বিপ্রদাস বড়ুয়ার ‘কাছের নদী দূরের সাগর’, মঈনুল আহসান সাবেরের ‘কয়েকজন অপরাধী’, নন্দিত পাবলিকেশন্স থেকে যতীন সরকারের ‘ব্যাকরণের ভয় অকারণ’, জাগৃতি প্রকাশনী থেকে জাকির তালুকদারের ‘গোরস্থানের জ্যোৎস্না, বলাকা প্রকাশন থেকে চন্দন চৌধুরীর ‘পাণ্ডবজন্ম’ ও ‘ঢাকা সিরিজ’, চৈতন্য থেকে জিনাত জাহান খানের কাব্যগ্রন্থ ‘কথা বলা মাছ’ প্রভৃতি।
মোড়ক উন্মোচন
বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে শুক্রবার মোট ২৫টি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হয়েছে। শারমিন রহমানের প্রথম কবিতার বই ‘অপ্রাকৃত কবচ’-এর মোড়ক উন্মোচন করেন এমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
মূলমঞ্চের আয়োজন
শুক্রবার বিকেলে মেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘কবি আবুল হোসেন’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. তারেক রেজা। আলোচনায় অংশ নেন বায়তুল্লাহ কাদেরী, অনু হোসেন ও হিমেল বরকত। সভাপতিত্ব করেন মনজুরে মওলা।
সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ও আয়েশা হক শিমু। সংগীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী বাংলাদেশ একাডেমি অব ফাইন আর্টসের কণ্ঠশিল্পীরা, শিল্পী দীনাত জাহান মুন্নী, নাসিমা শাহীন ফেন্সি, জয় শাহরিয়ার, দিপক দে, রাজু আহমেদ, শামীমা সুলতানা ও সঞ্জয় দাস।
এর আগে, অমর একুশে উদ্যাপন উপলক্ষে সকালে মেলার মূলমঞ্চে শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতার প্রাথমিক পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে ‘দেশাত্মবোধক, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা-আন্দোলন’ বিষয়ে ক-শাখায় ১৭৯জন ও খ-শাখায় ১৩০ জন প্রতিযোগী অংশ নেয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শমী কায়সার। বিচারকমণ্ডলিতে ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব এস. এম. মহসীন, আবৃত্তিশিল্পী বেলায়েত হোসেন ও রেজিনা ওয়ালী লীনা।
শনিবারের আয়োজন
শনিবার শিশু প্রহরের শেষ দিন। বেলা ১১টায় দুয়ার খুলবে মেলার। শিশু প্রহর চলবে সকাল ১১টা থেকে ২টা পর্য্যন্ত। শিশুদের বইয়ের প্রতি আগ্রহের জন্যই মূলত বাংলা একাডেমি এটা ঘোষণা করেছে। এদিন মেলা ১১টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত চলবে।
এর আগে, বাংলা একাডেমি আয়োজিত শিশুকিশোরদের সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বক্তৃতার চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা সকাল ১০টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে। অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ।
এদিন বিকেলে মেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘জাতীয় অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন রায়হান রাইন। আলোচনায় অংশ নেবেন অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম ও জিয়া রহমান। সভাপতিত্ব করবেন অ্যামিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
** বইমেলা জুড়ে বসেছে রঙের মেলা
** ‘খালেদার হৃদয়ে শান্তির কপোত উড়ুক’
** কিশোরদের ভিড় এখনো ‘সেবা’য়
** আহ! বাসন্তী প্রহর…
বাংলাদেশ সময়: ২০৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৫