গ্রন্থমেলা থেকে: দেশজুড়ে চলছে পেট্রোলবোমার নারকীয় তাণ্ডব। অবুঝ শিশুটিও রক্ষা পাচ্ছে না দানবের কবল থেকে।
শনিবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) অমর একুশে গ্রন্থমেলা দিয়েছে অহিংসতার বার্তা। এখানেই হাজারো যুগল উদযাপন করেছেন ভালোবাসা দিবস। প্রিয়জন আর বইয়ের প্রতি ভালোবাসায় মুখর ভালোবাসা দিবসের বইমেলা।
এদিন সারাদিন প্রিয়জনের হাত ধরে ঘুরে বেড়িয়ে আর বিকেলে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় এসেছেন হাজারো যুগল। সময় কাটিয়েছেন বইয়ের সঙ্গে। হাতে গোলাপ নিয়ে প্রবেশ করে, বইকে সঙ্গী করে তবেই ঘরে ফিরেছেন সবাই। আর গ্রন্থমেলার নান্দনিক সব স্থাপনার সঙ্গে সেলফি তুলতে ভোলেননি কেউ-ই।
শনিবার বিকেলে মেলায় প্রবেশ করতেই দেখা গেলো জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনকে। ভালোবাসা দিবসের মেলা প্রসঙ্গে বললেন, ‘এই যে মেয়েরা লাল-হলুদ শাড়ি পরে মেলায় আসছেন, এটা দেখতে সত্যিই খুবই ভালো লাগছে। মেলায় যে কয়টি বিশেষ দিনের জন্য আমরা অপেক্ষা করি, তার একটি ভালোবাসা দিবস। সে দিনে এ ভিড়, সত্যিই খুবই ভালো লাগছে। ’
তিনি বলেন, শুক্রবার পহেলা ফাল্গুন আর আজ (শনিবার) ভালোবাসা দিবসে মানুষ সব বাধা উপেক্ষা করে মেলায় এসেছেন, এরই মধ্যে প্রমাণিত হয় মানুষের বইয়ের প্রতি ভালোবাসা কমেনি।
এদিন বিকেলে মেলায় যাত্রাবাড়ী থেকে এসেছিলেন মারুফ-শায়লা দম্পতি। এ দম্পত্তি বললেন, টানা কয়েকবছর ধরেই ভালোবাসা দিবসে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় কাটাই একুশের বইমেলাতেই।
এদিকে লোকসমাগম থাকলেও সে অনুযায়ী বিক্রি হয়নি বলে জানালেন কয়েকজন প্রকাশক।
ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশের জহিরুল আবেদিন জুয়েল বলেন, ‘পহেলা ফাল্গুন যে পরিমাণ বিক্রি ভালো হয়েছে, সে অনুযায়ী শনিবার প্রত্যাশা-প্রাপ্তির সমন্বয় হয়নি। ’
মেলায় টুকটুকি, হালুম ও ইকরি
গ্রন্থমেলার শিশু প্রহরে শিশুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে হাজির হয়েছিল সিসিমপুরের টুকটুকি, হালুম এবং ইকরির দল। তারা নজরুল মঞ্চে শিশুদের সঙ্গে খেলায় মেতে ওঠে। আড্ডায় টুকটুকি তাদের সবাইকে বই পড়তে বলে। মঞ্চে হালুম তার সব বন্ধুদের বেশি বেশি করে মাছ খেতে বলে। সে আরো বলে বন্ধুরা যদি হালুমের মতো বেশি বেশি মাছ খায় তাহলে হালুমের মতো শক্তি হবে। আর হালুম সব বন্ধুদের সঙ্গে হাত মেলায়।
প্রশ্নকর্তা ইকরি তো সবাইকে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন শুরু করে। ইকরি তার ছোট্ট বন্ধুদের বেশি বেশি করে প্রশ্ন করতে বলে। তাহলে তারা তাদের জানা অজানা বিষয় জানতে পারবে। তারপর হালুম, টুকটুকি ও ইকরি সবাইকে বন্ধুদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে বলে। সবশেষে তারা ‘সিসিমপুরের চলছে গাড়ি’ গানটি পরিবেশন করে।
১০টি সায়েন্স ফিকশন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন
বাংলাদেশ সায়েন্স ফিকশন সোসাইটির (বিএসএফএস) উদ্যোগে ১০ জন সায়েন্স ফিকশন লেখকের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে নজরুল মঞ্চে। বিএসএফএস’র সভাপতি মোশতাক আহমেদের সভাপতিত্বে মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, শিশু সাহিত্যিক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, রম্য লেখক আহসান হাবীব ও ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন।
সৃজনী থেকে প্রকাশিত আহসান হাবীবের সায়েন্স ফ্রিকশন সমগ্র, অনন্যা থেকে প্রকাশিত মোস্তফা কামালের বিমান রহস্য, ও রকিবুল ইসলাম মুকুলের স্কুল ট্রিপে নাসা অভিযান, ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত দীপু মাহমুদের কিটি ও রিকি, অনিন্দ্য প্রকাশ থেকে প্রকাশিত মোশতাক আহমেদের দ্বিতীয় পৃথিবী, ইফতেখার শিবলির অনুসন্ধান, নালন্দা থেকে প্রকাশিত হয়েছে মোশতাক আহমেদের গিটো, মুক্তদেশ থেকে প্রকাশিত মিজুনুর রহমান কল্লোলের মৃত্যুঘর, অন্বেষা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত আসিফ মেহদীর এনিমোন, শিখা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হোসাইন আছিবের ক্রিপটন ও সহস্র সুমনের অরবিট বইগুলোর মোড়ক উন্মোচিত হয়।
নজরুল মঞ্চের চিত্র
শনিবার মেলার নজরুল মঞ্চে আরো ১২টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচিত হয়। এর মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান উন্মোচন করেন ড মো. শফিকুল ইসলামের ‘পরমাণু শক্তির জানা অজানা’, আহসান হাবীব উন্মোচন করেন কবিতা সংকলন ‘শতরূপে ভালোবাসা’, কবি আসাদ চৌধুরী উন্মোচন করেন কানিজ ফাতেমা খুশীর ‘চোখের তারায় সমুদ্র’ উল্লেখযোগ্য।
১৪৭ বই
মেলার ১৪তম দিনে প্রকাশিত হয়েছে ১৪৭টি নতুন বই। এর মধ্যে গল্প ২৯টি, উপন্যাস ৩৬টি, প্রবন্ধ ৩টি, কবিতা ৩৬টি, গবেষণা ২টি, ছড়া ৫টি, জীবনী ৩টি, মুক্তিযুদ্ধ ১টি, নাটক ৩টি, বিজ্ঞান ১টি, ভ্রমণ ৪টি, ইতিহাস ১টি, চিকিৎসা ৪টি, ধর্মীয় ১টি, অনুবাদ ২টি এবং অন্যান্য বিষয়ের উপর এসেছে ১৬টি নতুন বই।
মাওলা ব্রাদার্স থেকে এসেছে মুনতাসীর মামুনের ‘ঢাকা স্মৃতি’ ১৫’, ভূঁইয়া সফিকুল ইসলামের ‘অশ্রু, অন্ধ ও তলোয়ার’, একুশে বাংলা প্রকাশন থেকে এসেছে ইমদাদুল হক মিলনের ‘মধুরাত’, পাঠক সমাবেশ থেকে এসেছে মাসরুর আরেফিন অনূদিত ‘হোমার : ইলিয়াড’, প্রথমা থেকে এসেছে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের ‘নাগরিকদের জানা ভালো’, এ বি এম মূসার ‘আমার বেলা যে যায়’, শাহনাজ মুন্নীর ‘দ্বিতীয় খুনের কাহিনী’, হরিশংকর জলদাসের ‘তলকুটঠুরির গান’, আনিসুল হকের ‘ভয়ংকর দ্বীপে বোকা গোয়েন্দা’, অনন্যা থেকে এসেছে দন্তস্য রওশনের ‘গাছটিতে কোনো ফ্যান নেই’, শুদ্ধস্বর থেকে এসেছে তারেক রহিমের ‘যে মাঝপথেই’, তানিম কবিরের ‘সকলই সকল’, আগামী থেকে এসেছে ফারুক ওয়াসিফের ‘জল জবা জয়তুন’. জাগৃতি থেকে এসেছে পিয়াস মজিদের ‘আলাপন অষ্টমী’, স্বকৃত নোমানের ‘কালকেউটের সুখ’, জুয়েল আহসান কামরুলের ‘সহস্য অন্ধকার পেরিয়ে’ উল্লেখযোগ্য।
মেলামঞ্চের আয়োজন
শনিবার বিকেলে মেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘জাতীয় অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রায়হান রাইন। আলোচনায় অংশ নেন অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম এবং অধ্যাপক জিয়া রহমান। সভাপতিত্ব করেন এমিরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সুলতানা হায়দারের পরিচালনায় নৃত্য সংগঠন ‘সুকন্যা নৃত্যাঙ্গন’ নৃত্য পরিবেশন করেন। সংগীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী খুরশিদ আলম, আঞ্জুমান আরা শিমুল, নবীন কিশোর, হাসান মাসুদ, সুমনা হক, খালেদ মুন্না, সোমা হক, মাহবুব আর বিপাশা এবং এস.এম. মেজবা উদ্দীন।
এর আগে সকালে মেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় শিশু-কিশোরদের সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব। প্রতিযোগিতায় ক-শাখায় সাধারণ জ্ঞান বিভাগে ১ম হয়েছেন দীপান্বিতা বিশ্বাস শৈলী, ২য় হোসাইন এবং ৩য় হয়েছেন আকিবা আফরোজ। খ-শাখায় উপস্থিত বক্তৃতা বিভাগে ১ম হয়েছেন ফারিয়া তাসনিম, ২য় নামিরা রহমান অন্তনা এবং ৩য় হয়েছেন আনাম আবরার। এতে বিচারক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন খায়রুল আলম সবুজ, অধ্যাপক আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন এবং শাহিদা খাতুন। প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন একাডেমির উপপরিচালক মুর্শিদুদ্দিন আহম্মদ।
রোববারের বইমেলা
এদিন বইমেলার দুয়ার খুলবে বেলা ৩টায়। চলবে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত। রোববার বিকেলে মেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহ্মদ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ড. ফিরোজ মাহমুদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন শামসুল হোসাইন, মোহাম্মদ জাহিদুর রহমান, নিশাত জাহান রানা এবং মৃত্তিকা সহিতা। সভাপতিত্ব করবেন অধ্যাপক মাহমুদ শাহ কোরেশী।
বাংলাদেশ সময়: ২১৫৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৫
** একসূত্রে গাঁথা ভালোবাসা-বই
** মেলা মাতালো সিসিমপুর
** হাসান শান্তনুর ‘৪৩ বছরে গণমাধ্যমের অর্জন-বিসর্জন’
** উদ্যানে লোক কম, প্রাঙ্গণে ভিড়