বইমেলা থেকে: মেলা শুরুর ঠিক এক ঘণ্টা আগে সোমবার দুপুর ২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) পৌঁছাতেই দরাজ কণ্ঠের আবৃত্তি কানে ভেসে এলো, ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি, আমি আমার পূর্ব পুরুষের কথা বলছি। ..... যে কবিতা শুনতে জানে না, সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে।
ফাগুনের মধ্যদুপুর। হিম হাওয়ার দিন শেষ। বইছে কিছু গরম হাওয়া। তাই মেলার এক ঘণ্টা আগেই যারা এসে পড়েছেন তারা সবাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বেঞ্চিতে বসে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ’র কবিতা শুনছেন। কারণ, যারা কবিতা শুনতে জানে তারাই মেলাতে আসে। যারা ঝড়ের আর্তনাদ শুনতে চায়, তারা নিশ্চয় নয়!
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যে অংশটুকু অমর একুশে গ্রন্থমেলার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে তার পাশে উন্মুক্ত মঞ্চে বসে আছেন মিরপুর থেকে আসা মো. মঞ্জুর কাদের। সঙ্গে মেয়ে মাইশা কাদের।
জিজ্ঞেস করতেই বললেন, একটু আগে ভাগেই মেলায় চলে এসেছি। মাইকে কবিতা আবৃত্তি শুনে এখানেই বসে পড়লাম। গাছের ছায়ায় বসে কবিতা শুনতে ভালোই লাগছে।
ভিকারুননিসা স্কুলের ৮ম শ্রেণির ছাত্রী মাইশা কাদের অবশ্য বাবার মতো কবিতার মায়াজালে বন্দি নয়। তাকে টানছে মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘গ্রামের নাম কাকনপুর’ ও সায়েন্স ফিকশন ‘সেরিনা’।
ঈশ্বরচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্র, নজরুল, শরৎচন্দ্র, অথবা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হুমায়ুন আজাদ, শহিদুল জহির, আহমেদ ছফার বই ভারি লাগে। নিখাদ আনন্দের জন্য পড়ি বলেই পছন্দের তালিকায় সব সময় থাকে হুমায়ূন আহমদ ও মুহম্মদ জাফর ইকবালের বই- ‘ছোট’ মাইশা কাদেরের ‘বড়’ মাপের মূল্যায়ন!
মেলার দরজা খুলতে তখন আরো ১৫ মিনিট বাকি। ততক্ষণে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ’র কবিতা শেষ হয়ে হেলাল হাফিজের ‘এখন তুমি কোথায় আছো? কেমন আছো? পত্র দিও। ’.... বেজে চলছে উদ্যানমুখী শব্দযন্ত্রে।
উঠি উঠি ভাব। এমন সময় বাংলানিউজের লোগো লাগানো নোটবুক নিয়ে বসে থাকতে দেখে এক ভদ্রলোক এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি বাংলানিউজে কাজ করেন?-আমার নাম প্রত্যয় জসীম। আমি লেখা-লেখি করি।
গত কয়েকদিন ধরে একটি জিনিস লক্ষ্য করছি। মনে মনে যা চাই, ঠিক সেই বস্তুটিই অনায়াসে এসে হাজির হয় সামনে।
আজ শুরুতেই ভেবেছিলাম, মেলা শুরুর লেখাটির বিষয়বস্তু কবিতা হলে কেমন হয়? কারণ, ‘এখন রূপের কাল নয়/রূপিয়ার কাল/এখন আর কবিতা নয়/ শুধু কোলাহল/’’-এই কোলাহলের মধ্যে কবিতার সন্ধান করে দেখি না একটু।
এই যখন ভাবনা, ঠিক সেই সময় নব্বই দশকের ব্যস্ততম কবি প্রত্যয় জসীম এসে হাজির। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি।
বইমেলার প্রসঙ্গ তুলতেই কবি প্রত্যয় জসীম বলেন, বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাঙালির সৃজনযজ্ঞের এক মহাউৎসব। মেলায় আসা হাজার হাজার বইয়ের মাঝে কিছু ভালো বই আমরা পেয়ে যাই। কারণ, সব প্রকাশক যেমন ভালো বই প্রকাশ করেন না। ঠিক তেমনি সব লেখক ভালো বই লেখেন না।
বইমেলাকে অতিমাত্রায় বাণ্যিজিকীকরণ থেকে মুক্ত রাখতে কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক বোধ তৈরিতে বইমেলার ভূমিকা থাকা দরকার। বইমেলা আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশের চেয়ে বিনাশের কারণ যেন না হয়।
কবিতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কবিতার আবেদন চিরকালীন। কোনো সৃজনশীল ও বোধসম্পন্ন মানুষ কবিতা গণ্ডির বাইরে যেতে পারেন না। বারবার তাকে কবিতার কাছে ফিরতে হয়, করতে হয় অসহায় আত্মসমর্পণ।
প্রতিদিনের মতো সোমবারও (১৬ ফেব্রুয়ারি) মেলার দরজা খোলে বিকেল ৩টায়। এর আগেই বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলা গেটের সামনে পাঠক ও দর্শনার্থীরা ভিড় জমান। মেলার দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে লাইন দিয়ে ভেতরে ঢোকেন তারা। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে মানুষ।
অপরদিকে মেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা অনুষ্ঠান। সন্ধ্যায় থাকছে সংস্কৃতি অনুষ্ঠান। মেলা চলবে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৫
** বইমেলায় ডিএমপি কমিশনার