গ্রন্থমেলা থেকে: এমনিতেই প্রকাশনা শিল্পে চলছে নাজুক অবস্থা। অমর একুশের বইমেলা তাই প্রকাশকদের কাছে ‘মরা গাঙে বান’ আসার মতো।
বুধবার মধ্যরাতের ঝড়ে মাথায় হাত পড়েছে শতাধিক স্টল মালিকের। গ্রন্থমেলার প্যাভিলিয়ন ছাড়া শতাধিক স্টলের বই বৃষ্টিতে কম-বেশি ভিজেছে।
বৃহস্পতিবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কমপক্ষে হাজার দেড়েক বই ভিজে পুরোপুরি নষ্ট হয়েছে। এছাড়া হাজার তিনেক বই দশ থেকে বিশ ভাগ ভিজেছে। যেগুলো অর্ধেকেরও কম দামে বিক্রি করতে হবে বলে।
মেলা ঘুরে দেখা যায়, বৃষ্টিতে অধিকাংশ প্রকাশনা সংস্থার স্টলে পানি ঢুকে হয়েছে বড় ধরনের ক্ষতি। বৃষ্টিস্নাত মেলার ১৯তম দিনের পুরোটাই ছিলো ম্লান।
রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে মেলার অবস্থা এমনিতেই নাজুক, তার উপর বৃষ্টির প্রকোপে প্রকাশকদের মধ্যে বিরাজ করছে চরম হতাশা। তাদের বক্তব্য, মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ অঙ্গসজ্জার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা স্টেপ মিডিয়ার উদাসীনতায় এমনটি ঘটেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, ‘বৃষ্টি একটি প্রাকৃতিক বিষয়, এতে আমাদের কারো কোনো হাত নেই। আমরা সঠিকভাবেই স্টল সজ্জা করেছি। একই সঙ্গে আমরা স্টল বরাদ্দ দেওয়ার সময়ই বলে দিয়েছিলাম, প্রকাশকরা যেন রাতের বেলা নিজেদের বই ট্র্যাঙ্কে ভরে রাখেন। একই সঙ্গে যেন পলিথিন দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয় ট্র্যাঙ্কটি। কিন্তু তারা তেমনটি করেন নি। ’
এছাড়া বৃষ্টিতে মেলার ছন্দপতন ঘটবে না বলেও জানান তিনি।
এদিকে, মেলার বাংলা একাডেমি অংশে থাকা কোনো সংস্থার স্টলে পানি ঢোকেনি। তবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে দেখা যায় উল্টো চিত্র। মেলা শুরুর আগে বিক্রকর্মীরা স্টল খুলতে গিয়ে পড়েন বেকায়দায়। ভেতরটা পানিতে জবজবা। উপরে ত্রিপলের ফুটো দিয়ে পানি পড়ে বই ভিজে একাকার। সবাইকেই পানি সরিয়ে বসতে হয়েছে বইয়ের পসরা সাজিয়ে। বেশিরভাগ স্টলের বই ভিজে যাওয়ায় তারা মেলা প্রাঙ্গণে শুকাতে দেন।
ক্ষতিগ্রস্ত প্রকাশনা সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে- অন্যপ্রকাশ, মূর্ধণ্য, বিভাষ, অন্বেষা, অন্যধারা, ইত্যাদি, গ্রন্থপ্রকাশ, হাওলাদার পাবলিকেশন, শিকড়, উৎস প্রকাশন, কালি ও কলম প্রকাশন, চারুলিপি, নালন্দা, আদি প্রকাশন, কথাপ্রকাশ, অবসর, জাগৃতি, আলপনা, সাহিত্যদেশ, চন্দ্রাবতী একাডেমি, ফেয়ার পাবলিশিং হাউজ, শ্রাবণ, প্রিয়মুখ, আগুন্তুক, শিখা প্রকাশনী, মনন, আলেয়া বুক ডিপো, ধ্রুবপদ, আদর্শ, আহমদ পাবলিশিং, উত্তরণ, কাগজ প্রকাশন, সিদ্দিকিয়া পাবলিশিং হাউস, বিজয় প্রকাশ, টুম্পা প্রকাশনী, মিজান পাবলিশিং হাউস, অঙ্কুর, জোনাকী, প্রান্ত, মেলা, গতিধারা প্রভৃতি।
চারুলিপি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী হুমায়ুন কবীর বলেন, আমাদের শতাধিক বই ভিজে গেছে। অধিকাংশই নামিদামি লেখকের। ভিজে যাওয়া বইগুলো বিক্রির অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। প্রতিবছরেই মেলা ঝড়-বৃষ্টির কবলে পড়ে। সঠিকভাবে স্টল নির্মাণ করা হলে এ থেকে রক্ষা পাওয়া যেত। অবকাঠামো দুর্বলতায় মেলা কমিটি দায়ী।
আলাপন প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী এম আর কমল বলেন, আমাদের তিন শতাধিক বই ভিজে গেছে। এরমধ্যে একটিও বিক্রির উপযোগী নয়। স্টলগুলোর অবকাঠামো দুর্বল থাকায় এ ক্ষতি হয়েছে।
একই কথা জানান, আহমদ পাবলিশিং হাউজের ব্যবস্থাপক শাহ আলম।
তিনি বলেন, আমাদের প্রায় দেড় শতাধিক বই সম্পূর্ণ ভিজে গেজে। আংশিক ভিজে যাওয়া বইগুলো তারা পাটি বিছিয়ে রোদে শুকানোর চেষ্টা করছি।
এদিকে, বৃহস্পতিবার মেলায় পাঠক-দর্শকের উপস্থিতিও ছিল কম। মাঠ কর্দমাক্ত হয়ে পড়ায় ভেতরে ঢুকে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরতে পারেননি অনেকেই। অনেকে মেলায় এলেও বৃষ্টি ও কাদার কারণে ভেতরে না ঢুকে ফিরে গেছেন। অনেকেই আবার সামান্য ঘুরে ফিরে গেছেন। বিক্রিবাট্টা হয়েছে একেবারেই কম।
অন্যদিকে, শুক্রবার ও পরের দিন শনিবার একুশে ফেব্রুয়ারি মেলা পাঠক ক্রেতাদের আগমনে জনসমুদ্রে পরিণত হওয়ার আশা করছেন প্রকাশকরা। যার কারণেই প্রাকৃতিক বিপর্যের মধ্যে বহু প্রকাশকদের দেখা গেলো নানা আয়োজনের প্রস্তুতি তোড়জোড়।
নজরুল মঞ্চের চিত্র
বৃহস্পতিবার মেলার নজরুল মঞ্চে ১৯টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচিত হয়েছে। এর মধ্যে- সিজন নাহিয়ানের ‘তাল না মেলানোর ছন্দ’র মোড়ক উন্মোচন করেন মফিদুল ইসলাম। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু উন্মোচন করেন সৈয়দা রাশিদা বারীর ‘সুস্থ শরীর সুন্দর’, ‘যদি সুস্থ থাকতে চান’ ও ‘ঝংকৃত কথামালা’, মোহম্মদ সোহেল হোসেনের ‘সে আলোয় তোমায় দেখি না’। কবি ও রাজনীতিবিদ নূহ-উল-আলম লেনিন উন্মোচন করেন আয়েশা হকের ‘মক্কা মদিনায় ৩৩ দিন’, ফারহান জাহাঙ্গীরের ‘লিজেন্ডস’ এবং দর্পণ কবীরের ‘এক মলাটে ৮ উপন্যাস’।
১৭তম দিনে ৭৭ বই
বৃহস্পতিবার মেলার ১৯তম দিনে নতুন ৭৭টি বই এসেছে। এর মধ্যে গল্প ১১, উপন্যাস ৮, প্রবন্ধ ২, কবিতা ২৫, ছড়া ২, শিশুসাহিত্য ৮, জীবনী ২, মুক্তিযুদ্ধ ১, বিজ্ঞান ১, ভ্রমণ ২, সায়েন্স ফিকশন ২ এবং অন্যান্য বিষয়ের উপর ১৩টি নতুন বই এসেছে।
এর মধ্যে পবিত্র সরকারের ‘বানান-বোধিনী: একটি অভিনব বানান অভিধান’ এনেছে বাংলা প্রকাশ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘কিশোরসমগ্র’, ফরিদুর রেজা সাগরের ‘ছোটদের জন্য কিছু লেখা’, মাহবুব রেজার ‘এই গল্পটা বঙ্গবন্ধুর’, ফজল-এ খুদার ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’, আনজীর লিটনের ‘ছোটদের গল্পসমগ্র ১’ এনেছে অনিন্দ্যপ্রকাশ, আতোয়ার রহমানের ‘যাপিত জীবন’ এনেছে বিভাস, প্রয়াত কবি সুরাইয়া খানমের ‘নাচের শব্দ’ এনেছে চারুলিপি, দিপংকর দীপকের ‘ঈশ^রের সঙ্গে লড়াই’ এনেছে কলি প্রকাশনী, মহীবুল আজিজের ‘উপনিবেশ-বিরোধিতার মাগিদ্য ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ এনেছে গ্রন্থকুটির, ড. শাহজাহার তপনের ‘বাঘংরিলা’ এনেছে পাঞ্জেরি, মুনির আহমেদ শ্রাবণের ‘ইবোলা-নদীর তীরে’, হুমায়ুন কবিরের ‘সুন্দরের সন্ধানে’ এনেছে আগামী, রফিকুল হকের ‘মজার পড়া ১০ ছড়া’, নভেরা হোসেনের ‘একটু একটু করে বোবা হয়ে যাচ্ছ তুমি’ এনেছে আগামী প্রভৃতি।
মেলামঞ্চের আয়োজন
বৃহস্পতিবার মেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শামসুদ্দিন আহমদ। আলোচনায় অংশ নেন কামালউদ্দিন, ড. ফেরদৌসী বেগম এবং নূরুন্নাহার মুক্তা। সভাপতিত্ব করেন মো. শাহ-ই-আলম।
সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মো. মোশাররফ হোসেনের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘দৃষ্টি’, এম আর মনজুর পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘শুভজন’, শেখ উজ্জ্বলের পরিচালনায় আওয়ামী সাংস্কৃতিক ফোরাম এবং বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করে।
শুক্রবারের আয়োজন
শুক্রবার বইমেলার দুয়ার খুলবে বেলা ১১টায়। চলবে যথারীতি রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত। বিকেলে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘ভাষাসংগ্রামী আবদুল মতিন’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন আহমাদ মাযহার। আলোচনায় অংশ নেবেন মাসুদা ভাট্টি ও মোহাম্মদ আলী। সভাপতিত্ব করবেন লেখক-গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ।
এর আগে সকালে অমর একুশে উদযাপন উপলক্ষে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হবে। অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিচারক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন আবৃত্তিজন আশরাফুল আলম, ডালিয়া আহমেদ এবং মাহিদুল ইসলাম। প্রতিযোগিতায় সভাপতিত্ব করবেন একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান।
** মেলায় ঝড়ের আর্তনাদ!
বাংলাদেশ সময়: ২০০৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৫