ঢাকা, শুক্রবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বইমেলা

মেলা থাকলে চন্দ্রমল্লিকা, না থাকলে গোলাপ

আসাদ জামান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৫
মেলা থাকলে চন্দ্রমল্লিকা, না থাকলে গোলাপ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বইমেলা থেকে: নতুন বইয়ের ভাঁজে আলাদা একটা গন্ধ আছে। এ গন্ধ উপভোগ করতে প্রতিদিনই মেলায় আসেন অনেক বইপ্রেমী।

এ স্টল থেকে ও স্টল ঘুরে নতুন বই নেড়েচেড়ে এর ভাঁজে ভাঁজে জমে থাকা গন্ধ উপভোগ করেন তারা। এর মধ্যে রয়েছে অন্য রকম একটা মাদকতা।
 
তবে বইয়ের ভাঁজে জমে থাকা ভিন্ন স্বাদের এ গন্ধ পাঠকের নাকে পৌঁছানোর আগেই চন্দ্রমল্লিকা, জিপসি, রঙ্গন আর গোলাপের সৌরভ পৌঁছে যায় তাদের কাছে। বইমেলা উপলক্ষ করে জ্ঞানের ফেরিওয়ালারা পাঠকের হাতে পৌঁছে দিচ্ছে নতুন স্বাদের বই। আর সুঘ্রাণের ফেরিওয়ালারা পৌঁছে দিচ্ছে গোলাপ-গাঁদার সৌরভ।
 
শুক্রবার (২০ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রাচীর দরজা পেরিয়ে মেলার দিকে যাচ্ছি। হঠাৎ কানে ভেসে এলো, ‘আপা, ফুলের রিং নেবেন, ফুলের রিং?’
 
পেছন ফিরে দেখি মেলায় আসা দুই তরুণীর কাছে ফুল বিক্রির জন্য আরজি জানাচ্ছে ১১ বছর বয়সী পথশিশু সানজিদা।
 
নাছড়বান্দা সানজিদার আরজি উপেক্ষা করতে না পেরে ৬০ টাকায় ২টি ফুলের রিং কিনে বিদায় নেয় বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের ছাত্রী মালিহা ও সুমাইয়া।
 
দু’টি বিক্রির পরও সানজিদার হাতে রয়ে যায় আরো কয়েকটি ফুলের রিং। আবার তার হাক-ডাক শুরু, ‘ফুলের রিং নেবেন, ফুলের রিং?’
 
অন্য আর দশজন সাধারণ মানুষের কাছে সময় চেয়ে সহজে পাওয়া গেলেও সানজিদাদের ক্ষেত্রে সেটি দুষ্কর। কারণ, সারা বছরে যে রোজগার হয়, ভাষার এক মাসে তার চেয়ে বেশি রোজগারের সুযোগ পায় তারা। তাই কথা বলতে চাইলেও সময় দিতে নারাজ সানজিদা।
 
হাতে থাকা রিংয়ে জড়ানো ফুলগুলোর নাম জানতে চাইলে শুরু হয় সানজিদার গুরুগিরি, ‘চেনেন না! এইডা হইলো গোলাপ, এইডা চন্দ্রমল্লিকা, এইডা জিপসি আর এইডা রঙ্গন ফুল। ’
 
মেলা না থাকলে কী করো? মেলায় প্রতিদিন কী পরিমাণ বিক্রি হয়? রোজগার হয় কত?- যেহেতু সানজিদার সময় খুব মূল্যবান! তাই প্রশ্নগুলো এক সঙ্গে করে উত্তরের জন্য অপেক্ষা!
 
‘মেলা না থাকলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে জ্যামে আটকা গাড়িতে গোলাপ বিক্রি করি। দিনে এক দেড় শ’ টাকা কামাই হয়। মেলা আইলে চন্দ্রমল্লিকা, জিপসি, রঙ্গন আর গোলাপ দিয়ে ফুলের রিং বানিয়ে বিক্রি করি। প্রতিদিন ৪০/৫০ টা রিং বিক্রি হয়। কামাই হয় ৮/৯ শ’ টাকা। ’
 
সানজিদার মূল্যবান কিছু সময় নষ্ট হওয়ায় একটি রিংয়ের মূল্য পরিশোধ করে সামনে আগাই। পেছনে পড়ে থাকে ১১ বছর বয়সী পথশিশু সানজিদার চিকচিকে হাসি।
 
বামে একটু মোড় নিতেই দেখা হয় দুই সহোদর রাসেল ও হৃদয়ের সঙ্গে। কাঠির মাথায় লটকানো চন্দ্রমল্লিকা ফুল প্লাস্টিকের বোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটির মূল্য ১৫ টাকা।
 
একটু দূরেই ওদের মা পারুল বেগম। ডালাভর্তি চন্দ্রমল্লিকা, গোলাপ, গাদা ও জিপসি ফুল নিয়ে বসে আছেন। দুই ছেলেকে পাঠিয়েছেন ফেরি করতে।
 
রাসেল-হৃদয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে পারুল বেগম এগিয়ে এসে বলেন, ‘কি কইবেন আমারে কন’। বেচা-বিক্রি সম্পর্কে কইবেন তো। মাশাল্লাহ খারাপ না। দুই পোলাই মিলে প্রতিদিন ২ হাজার টাকার ফুল বিক্রি করে। হাজার-বারো শ’ টাকা লাভ থাকে। মেলা আইলে আমাদের কিছু রোজগার হয়। কইলে তো নিয়ে যাবেন না..। ’
 
শুধু ফুল নয়, অমর একুশে গ্রন্থমেলায় পাখি, প্রজাপতি, চাবি রিং, ম্যাজিক পেন, ইলেক্ট্রিক স্নেক  (বৈদ্যুতিক সাপ), সিল্কিডল (রেশমি পুতুল), ওয়াটার বাঁশিসহ ছোট্ট সোনামনিদের আকর্ষণ করার মতো অনেক জিনিসই ফেরি করে বিক্রি হচ্ছে বইমেলায়।
 
শিশুদের জন্য শিশুতোষ বইয়ের পাশাপাশি এসব খেলনা কিনে দিচ্ছেন অভিভাবকরা। ফলে নিয়মিত কাজের পাশাপাশি খণ্ডকালীন কাজ হিসেবে মেলায় ফেরি করে খেলনা বিক্রি করছেন অনেকেই।
 
এর আগে বুধবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় বাংলানিউজের স্টলের সামনে কথা হয় পাখি, ম্যাজিক পেন ও চাবি রিংয়ের ফেরিওয়ালা মো. রিপন মিয়ার সঙ্গে।
 
বাগেরহাটের রিপন ঢাকায় একটি ইলেক্ট্রনিকসের দোকানে কাজ করেন। দোকানের ডিউটি শেষ করে বিকেল ৫টা নাগাদ মেলায় আসেন তিনি। থাকেন রাত ৯টা পর্যন্ত। এ ৪ ঘণ্টায় তার বিক্রি হয় দেড় থেকে ২ হাজার টাকা। লাভ থাকে ১ হাজার টাকার মতো।
 
তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর-ই মেলা থেকে ১৫/২০ হাজার টাকা কামাই করি। মেলা শেষে খেলনাগুলো যেখান থেকে আনি সেখানে ফিরিয়ে দেই। ’
 
সানজিদা, রাসেল, হৃদয় ও রিপন মিয়ার খণ্ডকালীন কাজ এবং তাদের আয়-রোজগার ও ঠোঁটেরে কোণে লেগে থাকা হাসির ঝিলিক দেখার পর এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মেলায় কেবল জ্ঞানের আলোর মশাল-ই জ্বলে না; খেঁটে খাওয়া অসংখ্য মানুষের খুন্নিবৃত্তির ব্যবস্থাও হয়।
 
তবে মেলার ঘাড়ে আরেক মেলা (বিস্তৃত পরিসরে খাবারের দোকান অথবা ফুটপথে পাইরেসি বইয়ের পসরা) বসিয়ে দিয়ে সুযোগসন্ধানী যে মানুষগুলো পকেট ভারি করছেন, তাদের কোনো দলেই রাখা যাচ্ছে না! না জ্ঞানের আলোর মশাল জ্বালানোদের দলে; না ফুল-পাখি ও প্রজাপতির ফেরিওয়ালাদের দলে।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৫

** ছুটির দিন মানেই মেলার দুই চিত্র

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।