গ্রন্থমেলা থেকে: কী অদ্ভুত সুর! এমন সুর আর কোথায় আছে। কান্না জড়ানো সুর, আবেগে আপ্লুত হওয়া সুর।
বায়ান্নর চেতনাকে লালন করে এগিয়ে চলা গ্রন্থমেলার ২০তম দিনেও লক্ষ্য করা গেছে একুশের আবহ। রংতুলির ছোঁয়ায় শরীরে ২১ ফেব্রুয়ারি অঙ্কিত করে, কেউবা গালে চিত্রিত করেছেন বর্ণমালা অ আ ক খ। আবার কারো টি-শার্টের বুক বরাবর ছিল ভাষা শহীদ সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরের প্রতিকৃতি।
শুক্রবার দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মেলায় নেমেছিলো মানুষের উপচেপড়া ঢল। দোয়েল চত্বর থেকে টিএসসি, বাংলা একাডেমি থেকে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান- সর্বত্রই ছিলো জনস্রোত।
এদিন দর্শনার্থী, বইপ্রেমীদের পদচারণায় গ্রন্থমেলা চিরচেনারূপে ফিরে যায়। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অধীর অপেক্ষায় মেলায় প্রবেশে দর্শনার্থীদের মাঝে ফুটে উঠেছিল ভাষা আন্দোলনে উদ্দীপনা।
মায়ের ভাষার জন্য শহীদদের স্মৃতির এই মেলা নতুন করে উজ্জীবিত করে। শুধু বইয়ের টানেই নয়, ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও তাদের স্মরণেই অমর একুশে গ্রন্থমেলা প্রতিবছর প্রাণ ফিরে পায়।
বেলা ১১টায় মেলার দ্বার খোলা হয়। শুরুর কয়েক ঘণ্টা লোকসমাগম কম হলেও দুপুরের পর দলবেঁধে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে বইপ্রেমীরা ভিড় জমিয়েছেন মেলায়। অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়েই মেলায় এসেছিলেন। মেলার প্রায় প্রতিটি স্টলে সববয়সী দর্শনার্থী ও ক্রেতাদের উপস্থিতি দেখা যায়। কেউ বই কিনছেন আবার কেউ নতুন বই দেখছেন। আবার অনেকেই বিভিন্ন স্টল ও কবি-লেখকদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ক্যামেরায় ছবি তুলছেন।
এদিনও মেলায় এসেছেন জনপ্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। অটোগ্রাফ আর সেলফিতে তিনি ভক্তদের সঙ্গে কাটিয়েছেন ব্যস্ত সময়।
প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এদিন প্রতিটি স্টলেই বইয়ের বিক্রি বেড়েছে আগের যে কোনো দিনের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। প্রকাশকরা জানিয়েছেন আগামী একটি সপ্তাহ বই বিক্রি হবে কয়েকগুণ বেশি।
এ প্রসঙ্গে প্রকাশনা সংস্থা বাংলা প্রকাশ এর প্রধান নির্বাহী হুমায়ূন কবির ঢালী বলেন, এবারের বইমেলা অন্য বারের চেয়ে দৃষ্টিনন্দন ও পরিপাটি। পাঠকরা মেলায় এসে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। তবে রাজনৈতিক একের পর এক কর্মসূচির কারণে মাঝে মধ্যে কিছুটা ছন্দ পতন হচ্ছে। ঢাকার বাইরের বইয়ের ক্রেতাদের অনেকেই এবার মেলায় আসতে পারছে না।
তবে শুক্রবার বইয়ের বিক্রি অনেক ভালো হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকাশকরা। তারা মনে করছেন, একুশে ফেব্রুয়ারির পর থেকে আগামী একটি সপ্তাহ মেলায় বই বিক্রি বাড়বে।
২০তম দিনে ২৬৪ বই
বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্র এবং সমন্বয় ও জনসংযোগ উপবিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, শুক্রবার মেলার ২০তম দিনে নতুন ২৬৪টি বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে উপন্যাস ৩১টি, গল্পের বই ৪৮টি, কবিতার বই ৬২টি, গবেষণা ৬টি, ছড়া ১৬টি, শিশুসাহিত্য ১১টি, জীবনী ৫টি, মুক্তিযুদ্ধ ৬টি, নাটক একটি, বিজ্ঞান ৩টি, ভ্রমণকাহিনি ২টি, ইতিহাস ৬টি, স্বাস্থ্য বিষয়ক বই ৩টি, রম্য ২টি, ধর্মীয় ৩টি, অনুবাদের বই একটি, অভিধান একটি, সায়েন্স ফিকশন ৫টি এবং অন্যান্য বিষয়ের বই ৪৬টি।
উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে সাহস পাবলিকেশন থেকে আল মাহমুদের ‘তোমার গন্ধে ফুল ফুটেছে’, কলি প্রকাশনী থেকে করুণাময় গোস্বামীর ‘বুদ্ধদেব বসু ও অন্যান্য’, অনার্য প্রকাশনী থেকে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর ‘তিন দাগে ঘেরা বাংলাদেশ’, কথাপ্রকাশ থেকে লুৎফর রহমান রিটনের ‘স্মৃতির জোনাকিরা’, শুদ্ধস্বর থেকে জুয়েল মাজহারের ‘মেগাস্থিনিসের হাসি’, ত্রয়ী প্রকাশনী থেকে রেজা ঘটকের ‘বঙ্গবন্ধুর সংক্ষিপ্ত জীবনী মুজিব দ্য গ্রেট’ প্রভৃতি।
শনিবার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের নজরুল মঞ্চে মোট ২৭টি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হয়েছে।
মূলমঞ্চের আয়োজন
শুক্রবার বিকেলে মেলার মূলমঞ্চে ছিল ‘ভাষাসংগ্রামী আবদুল মতিন’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ছড়াকার আহমাদ মাযহার। আলোচনায় অংশ নেন মাসুদা ভাট্টি ও মোহাম্মদ আলী। সভাপতিত্ব করেন লেখক-গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ।
এর আগে সকালে অমর একুশে উদযাপন উপলক্ষে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। এতে অতিথি ছিলেন আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। বিচারক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আবৃত্তিজন আশরাফুল আলম, ডালিয়া আহমেদ এবং মাহিদুল ইসলাম। প্রতিযোগিতায় সভাপতিত্ব করেন একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান।
একুশের আয়োজন
শনিবার সকাল ৮টায় সর্বসাধারণের জন্য খুলবে বইমেলার দুয়ার। চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। অমর একুশে উপলক্ষে বাংলা একাডেমির আয়োজনে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত চলবে বিরতিহীন স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর। এই পর্বটির সভাপতিত্ব করবেন কবি অসীম সাহা।
মেলা মঞ্চে বিকেল চারটায় ‘ভদ্রলোক-রাজনীতি ও শ্রেণিচেতনার আলোকে ভাষা-আন্দোলন’ শীর্ষক একুশে স্মারক বক্তব্য রাখবেন ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক। সভাপত্বি করবেন একাডেমির সভাপতি এমিরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান।
বাংলাদেশ সময়: ২১৩২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৫
** বিশ’র বিকেলে একুশের ভিড়
** মধুসূদনকে বিকৃত উপস্থাপন বাংলা একাডেমির!