বইমেলা থেকে: বাংলা একাডেমির তিন নম্বর গেট দিয়ে বের হতেই সুজন-মৌসুমী দম্পতির সঙ্গে দেখা। আজকের দিনটি তাদের কাছে সবচেয়ে বড় আনন্দের।
টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত বাংলা একাডেমির সামনের সড়কে অমর একুশে গ্রন্থমেলার জন্য স্টল বরাদ্দ দিলে পাঠক, লেখক, প্রকাশক সর্বোপরি জনসাধারণের চলাচলে বিঘ্ন ঘটে- এ যুক্তিতে ২০১৪ সাল থেকে মাঝের সড়কটা ফাঁকা রেখে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলা আয়োজন করা হচ্ছে।
কিন্তু একাডেমি আঙ্গিনা থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলার বিস্তৃতি ঘটলেও স্বস্তি মিলছে না পাঠক লেখক প্রকাশক ও দর্শনার্থীদের। কারণ, বাংলা একাডেমির সামনের সড়ক ‘বইমুক্ত’ করে অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে অমর একুশে ‘বারোয়ারি মেলা’য় রূপান্তরিত করা হয়েছে।
চুড়ি দোকানি সুজন-মৌসুমী দম্পতি তাদের চুড়ির পসরা একাডেমি গেটের সামনে বসিয়ে যেমন খুশি, তেমনি এর একটু দূরে আংটি আর কানের দুলের পসরা সাজিয়ে যারপরনাই খুশি মো. সুজন মিয়া।
নিউমার্কেটের সামনে নিয়মিত আংটি-কানের দুল বিক্রি করা মো. রুবেলও অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে ‘অমর একুশে বারোয়ারি মেলায়’ রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করছেন। তিনিও বাংলা একাডেমির দেয়ালঘেঁষে তার পসরা সাজিয়েছেন।
ক্লিপ, খোঁপা, চুলের ব্যান্ড, চুলের কাটা, বেবি ক্লিপ, প্রজাপতি বিক্রির জন্য একাডেমির সামনের সড়কের ডিভাইডারের ওপর দোকান বিছিয়েছেন স্বপন মিয়া।
বই মেলায় এসে কেবল বই-ই কেনে না। প্রয়োজনীয় জিসিনপত্রও কেনে কেউ কেউ-এ বিশ্বাস থেকে থ্রি-পিচ নিয়ে মেলায় হাজির হয়েছেন মো. নাছির। রাস্তার মধ্যে থ্রি-পিচগুলো মেলে ধরে অব্যাহতভাবে ডেকে চলছেন, এই তিন শ’! একদাম একরেট তিন শ’...।
যদিও বৃষ্টির মৌসুম নয়, তারপরও ‘মেলায় অনেক লোকের আগমন, একেক জনের একেক জিনিস প্রয়োজন..’- এ ধারণা থেকে মেলায় ছাতা বিক্রি করছেন মো. শরিফ।
গন্ধ না থাকলেও কাগজের ফুলে কিন্তু ‘চমক’ কম থাকে না। সে কারণেই হয়তো প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যেই কাগজের ফুলের পসরা সাজিয়ে বসে আছেন সাগর। বেচা-বিক্রিও মোটামুটি।
বাচ্চাদের জন্য চীন থেকে আমদানি করা নতুন খেলনা ‘পরী পুতুল’ একাডেমির সামনের সড়কের অনেকটা জায়গা দখল করে নিয়েছে। মো. সুমনের মুখে তৃপ্তির হাসি- ‘এবার এ পুতুলটা বিক্রি হচ্ছে বেশ!’ পাশে বসেই ফেব্রিক্সের তৈরি পান্ডা, ক্যাঙ্গারু, বেড়াল, খরগোশ বিক্রি করছেন মো. হাফেজ।
মেলায় আসা পাঠক-দর্শনার্থীদের একটি বড় অংশ নারী। এ কথা একেবারই ভুলে যাননি হানিফত্রয়! কাকতালীয়ভাবে তিন তিন জন হানিফ পাশাপাশি তাদের পসরা সাজিয়েছেন। প্রথমজন বিক্রি করছেন স্টিলের তৈজসপত্র। দ্বিতীয়জন বিক্রি করছেন স্ক্রুবার, ওয়াটার বোটল, এয়ারলক, আইসপট, ছাকনি, বিডার ব্রাশ। তৃতীয়জন বিক্রি করছেন, পাট আর বাঁশ দিয়ে তৈরি বাচ্চাদের দোলনা।
বই মেলায় সাধারণত সৃজনশীল নরম হৃদয়ের মানুষগুলোরই আনা গোনা। যাদের অনেকেই দেশজপণ্য’র প্রতি দুর্বল। সে বিষয়টি মাথায় রেখে মো. রাজু মেলায় এনেছেন পাটের ব্যাগ। বিক্রিও ভালো। ১০০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে রাজুর পাটের ব্যাগ।
মলাটবদ্ধ অনেক চরিত্রই মিলবে যারা ঘুঙুর পরে, খঞ্জনা অথবা ঘণ্টা বাজিয়ে হাজির হবে পাঠকদের কাছে। কিন্তু বাস্তবে যারা ঘুঙুর-খঞ্জনা বা পিতলের ঘণ্টা দেখেনি, তাদের জন্য সেন্টু মিয়ার চিন্তার শেষ নেই। বাংলা একাডেমির সামনের সড়কে এগুলোর পসরা সাজিয়েছেন তিনি।
শুধু কী তাই! হ্যান্ডপার্স, সিরামিকসের জিনিসপত্র, টেবিলের কাভার, সোফার কুশন, ঘরের পাপোষ, শীতল পাটি-কী নেই অমর একুশে গ্রন্থমেলায়!
তবে রাস্তা বন্ধ করে আয়োজক ও পুলিশের নাকের ডোগায় কীভাবে বসল বারোয়ারি দোকান, তার উত্তর খুঁজতে গিয়ে ফিরতে হলো শায়েস্তা খানের আমলে!
মাত্র ১০/২০ টাকা উৎকোচ দিয়ে রাস্তা ওপর দোকান দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন মোরশেদ সেলিম, সফিক ও নূর মোহাম্মদরা।
তারা জানান, দিন শেষে দোকানপ্রতি পুলিশকে ২০ টাকা, লাইনম্যান ও সুইপারদের ১০ টাকা করে দিতে হয়।
অর্থাৎ ৪০ টাকা দিয়ে অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে অমর একুশে ‘বারোয়ারি মেলা’ বানানোর সুবর্ণ সুযোগ পাচ্ছেন ফুটপথের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৫
** বাংলা একাডেমির গুণীজন স্মৃতি পুরস্কার ঘোষণা
** একুশের চেতনায় বইমেলায় বাঁধভাঙা জোয়ার
** শহীদ মিনার থেকে সোজা বই মেলায়
** বইয়ের পাতায় একাত্তর