গ্রন্থমেলা থেকে: সোমবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) একটু আগে-ভাগেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উপস্থিত হই। বইপ্রেমি মানুষগুলোর জটলা ভালোই লাগে।
বৃক্ষশোভিত উদ্যানের এ অংশটিতে হঠাৎ চোখ আটকে যায় গাছের সঙ্গে লটকানো একটি ফেস্টুনে। ‘তন্দ্রাচ্ছন্ন মূল্যবোধ, বইয়ের আলোয় জাগ্রত হোক’ লেখা ওই ফেস্টুনটি ঝুলিয়েছে অনলাইনে বই বিক্রি করে এমন একটি প্রতিষ্ঠান।
এছাড়া ‘বই মনের পরিধি বাড়ায়’, ‘আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দানে পাওয়া নয়’, ‘বইয়ে বইয়ে সয়লাব হোক ৫৬ হাজার বর্গমাইল’ লেখা আরও বেশ কয়েকটি ফেস্টুন। এই ফেস্টুনগুলোও ওই একই প্রতিষ্ঠানের।
মনে হতে পারে ‘ধান বানতে শিবের গীত’ গাইতে শুরু করেছি। কিন্তু ঘটানার পেছনেই তো কারণ থাকে। কারণ ছাড়া কার্য সংগঠিত হতে পারে কী?
ওই যে বলছিলাম ‘তন্দ্রাচ্ছন্ন মূল্যবোধ, বইয়ের আলোয় জাগ্রত হোক’! এতো বই বিক্রি। এতো মানুষের সমাগম, এতো যে আয়োজন- এ দিয়ে মূল্যবোধের কতটুকু অর্জন?- সেটিই দেখে নেওয়ার পালা।
বিকেল ঠিক ৩টায় মেলার দরজা খোলা হলে দেখতে দেখতে ভিড় জমে যায় তাম্রলিপি প্রকাশনীর সামনে। সেখানে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘গ্রামের নাম কাঁকনডুবি’ বইটি। এ ভিড় ঠেলে উকি মারতেই এ প্রতিবেদককে একজন স্টলকর্মীর জিজ্ঞাসা, ‘ভাই আপনি কি গ্রামের নাম কাঁকনডুবি চাচ্ছেন?’
বিক্রয়কর্মীর প্রশ্নের নেতিবচাক উত্তর দিয়ে, নিজের পরিচয়টা দেই। অপেক্ষায় থাকি, বই কিনেছেন এমন একজন পাঠকের সঙ্গে কথা বলার জন্য।
চকচকে কাভারে মোড়ানো ‘গ্রামের নাম কাঁকনডুবি’ বইটি কিনে গন্তব্যে রওনা হয়েছেন মো. শাহরিয়ার। উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে গমনেচ্ছু শাহরিয়ারের কাছে জানতে চাই- বাংলায় আজ কোন মাস। ঝটপট উত্তর -মাঘ মাস!
ভাষার জন্য জীবন দিয়ে বিশ্বের বুকে অনন্য ইতিহাস তৈরি করা বঙ্গসন্তান ফাল্গুন মাসের ১১ তারিখে দাঁড়িয়ে বলছে আজ মাঘ মাস।
কী ধরনের বই পড়ো?
-মুহম্মদ জাফল ইকবালের সায়েন্স ফিকশন আর হুমায়ূন আহমেদের হিমু, শুভ্র, মিসির আলী, ম্যাজিক মুন্সী।
শাহরিয়ার সঙ্গে কথাপোকথনের মধ্যেই সেখানে হাজির হন চাচাতো বোন সানজানা রহমান। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে অধ্যায়নরত সানজানা রহমানের প্রিয় লেখকের নাম এডগার অ্যালান পো, উইলিয়াম শেকস্পিয়র, ডেল কার্নেগি, তলস্তয়!
তালিকা আরও দীর্ঘ হতে পারতো। কিন্তু ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যায়নরত সানজানা রহমানকে থামিয়ে দিয়ে ‘অভাগা’ নজরুল-রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি সম্পর্কে তার কোনো কৌতূহল বা আগ্রহ আছে কি-না প্রশ্ন করা হলো। জানতে চাই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সৃষ্টি সম্ভার তার কাছে কেমন লাগে। জীবনানন্দ দাসের কবিতা পড়া হয় কি-না? ইত্যাদি ইত্যাদি।
মুচকি হেসে বললেন, -পড়া হয় মাঝে মাঝে!
শাহরিয়ার ও সানজানা রহমানের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলার মাঝখানটিতে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ চোখে পড়লো ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের প্যাভিলিয়নে। ছয় বন্ধু মিলে বই কিনে বের হচ্ছেন। দৌড়ে গিয়ে ধরে ফেলি তাদের।
কী বই কিনলেন? -ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর-এর ছাত্র প্লাবন সেন চৌধুরীর উত্তর-‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী’।
দাদার জন্য কেনা বইটি দাদা পড়ার পর নিজেও পড়বেন বলে এ জানান প্লাবন।
এবার তার কাছেও জানতে চাই, আজ বাংলায় কোন মাসের কয় তারিখ- অনেকক্ষণ ইতিউতি করে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র প্লাবন সেন চৌধুরী বললেন, বোধ হয় ফাল্গুন মাস! পাশ থেকে বন্ধু নিলয় বললেন, ‘আজ ফাল্গুন মাসের ১৩ তারিখ!’
বুঝতে বাকি থাকে না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার সময় শেষ বারের মতো বাংলা মাসের নাম ও তারিখটি শিখেছিলেন প্লাবন সেন চৌধুরী আর তার বন্ধু নিলয়। এরপর হয়তো বিএসএস যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার সময় জানবেন বা জানার চেষ্টা করবেন বাংলা মাসের নাম ও তারিখ।
তবে এ প্রতিবেদকে নসিহত করতে ছাড়েননি প্লাবন। বললেন –‘আপনি আজ অ্যাসাইনমেন্ট করতে এসছেন বলেই বাংলা মাসের নাম ও তারিখ জেনে রেখেছেন। অর্থাৎ প্লাবনের বিশ্বাস-তিনি যা জানেন না, অন্যরাও তা জানেন না। ’
মেলা থেকে বের হওয়ার পর আবারও চোখ আটকে গেল, ‘তন্দ্রাচ্ছন্ন মূল্যবোধ, বইয়ের আলোয় জাগ্রত হোক-’ লেখা ফেস্টুনটিতে। ফেস্টুনে লেখা স্লোগানটি এখন হৃদয়ে লিখতে পারলেই হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৫