ঢাকা: ক’দিন পরেই ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। ভাষা আন্দোলনের চেতনায় ঋদ্ধ এ মেলা ইতিহাস, ব্যপ্তি-ব্যঞ্জনায় আজ ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।
ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিবেচনায় বইমেলার ব্যঞ্জনা বহুমাত্রিক হলেও এর মূল এবং একমাত্র উপাদান একটিই, বই। এই বইটিকেই পাঠ উপযোগী করে পাঠকের হাতে তুলে দিতে বছরজুড়ে ব্যস্ত থাকতে হয় লেখক-প্রকাশকদের। আর ফেব্রুয়ারির বইমেলার জন্য অনানুষ্ঠানিকভাবে কমপক্ষে ছয়মাস আগে বিশেষ প্রস্তুতি নিতে হয় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
ফলে বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে মেলার শেষ দিন পর্যন্ত এক বিশাল কর্মযজ্ঞে মেতে থাকতে হয় সংশ্লিষ্টদের। তবে প্রায় প্রকাশকেরই অনুযোগ, বেশিরভাগ লেখকই পাণ্ডুলিপি জমা দেন বইমেলার এক-দু’মাস আগে। তাই ডিসেম্বর, জানুয়ারিই মূলত প্রকাশনা শিল্পের সবচেয়ে ব্যস্ততম সময়।
একটি বই পাঠক বা ক্রেতার হাতে ওঠার আগে কতগুলো ধাপ সম্পন্ন করে আসতে হয়, তা সবসময়ই চাপা পড়ে যায় নান্দনিক বিষয়-অলঙ্করণে বইয়ের ভাঁজে। পাঠকের হাতে এসে বই পূর্ণতা পেলেও প্রতিটি বইয়েই মিশে থাকে অনেক দক্ষ যত্নবান, কর্মঠ, মেধাবী হাতের শ্রম।
যেমনটা বললেন, দিব্য প্রকাশ’র স্বত্ত্বাধিকারী মঈনুল আহসান সাবের, কেনার পর পাঠক একটি বই হয়তো এক বসাতেই পড়ে শেষ করে ফেলতে পারেন। আবার একই বই কোনো কোনো পাঠকের শেষ করতে সময় লাগে দুই-তিনদিন। এটা আসলে পাঠাভ্যাসের উপর নির্ভর করে। কিন্তু একটি বই পাঠকের হাতে তুলে দিতে অনেক সময়, মেধা-শ্রম যোগ করতে হয়। মেধা-শ্রম-প্রজ্ঞার অপূর্ব সংমিশ্রণের কাজটিই করে থাকেন একজন প্রকাশক।
অলঙ্করণের আগে একটি বইকে পাঠ উপযোগী করতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে থাকেন একজন সম্পাদনা কর্মী (প্রুফ রিডার)। শব্দ, বাক্যের অসামঞ্জস্যতা দূর করে বানান সংশোধনের পাণ্ডিত্যের কাজটি করতে হয় সম্পাদনা কর্মীকেই। তার আগে একজন টাইপ রাইটারকে লেখকের পাণ্ডুলিপি দেখে দেখে হুবহু টাইপ করতে হয়।
টাইপ হয়ে গেলে ‘এফোঁর’ সাইজের কাগজের চারপাশে সমান এক ইঞ্চি খালি রেখে ১৪ নাম্বার ফন্টে তা প্রিন্ট দিতে হয়। আর এখান থেকেই শুরু হয় সম্পাদনা কর্মীর কাজ। প্রথমেই একজন সম্পাদনা কর্মীকে মূল পাণ্ডুলিপির সাথে অনুলিপি মেলাতে হয়। ছাপাখানার ভাষায় একে বলা হয় ফার্স্ট প্রুফ।
ফার্স্ট প্রুফ শেষ হলে টাইপ রাইটার সংশোধনী চিহ্ন দেখে সংশোধন করে আবার তা ফেরৎ দেন সম্পাদনা কর্মীকে। দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রুফ রিডার শব্দ-বাক্যের অসামঞ্জস্যতা দূর করেন। একইভাবে টাইপ রাইটার আবার তা সংশোধন করে ফেরৎ দেন সম্পাদনা কর্মীর কাছে।
তৃতীয় বা সর্বশেষ পর্যায়ে সম্পাদনা কর্মী বানান সংশোধনেই মনযোগ দিয়ে থাকেন। বলা যায়, পাণ্ডুলিপি সংশোধনের কাজ তৃতীয় পর্যায়ে এসে শেষ হয়ে যায়। তবে পাণ্ডুলিপিটি চূড়ান্ত করার আগে তা আবার পাঠানো হয় লেখকের কাছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে সংশোধন, সংযোজন-বিয়োজন করে লেখক পাণ্ডুলিপি ছাপানোর জন্য স্বাক্ষর করে চূড়ান্ত অনুমোদন দেন।
কয়েকজন পেশাদার প্রুফ রিডারের সাথে কথা হলে বাংলানিউজকে তারা বলেন, যেকোনো প্রকাশনার জন্য সম্পাদনা (প্রুফ রিডিং, শব্দ-বাক্যের অসামঞ্জস্যতা দূর করা ইত্যাদি) একটি অপরিহার্য বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও এ কাজটি পেশাদারিত্বের মর্যাদা পাচ্ছে না। যদিও কিছু দৈনিক পত্রিকা, কয়েকটি অনলাইন সংবাদ মাধ্যম এবং হাতেগোনা কয়েকটি প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানে সম্পাদনা বিভাগ রয়েছে।
জানতে চাইলে একটি স্বনামধন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সম্পাদনা বিভাগের কর্মী, কবি শতাব্দি কাদের বাংলানিউজকে বলেন, বইমেলার কাজ নভেম্বর থেকেই শুরু করতে হয়। তবে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে কাজের চাপ বেড়ে যায়। এ সময়টাতে প্রতিদিন গড়ে চার ফর্মা প্রুফ দেখতে পারি। শব্দের হিসাবে ২০ হাজারতো হবেই! বছরের অন্যান্য সময় প্রতিমাসে ১৪ ফর্মা প্রুফ দেখা সম্ভব হয়।
সম্পাদনাকে পেশা হিসেবে নেওয়া এ সম্পাদনা কর্মী জানান, এক সময় হার্ড কপিতে (ছাপা অক্ষরে) সম্পাদনা করলেও এখন তিনি তা কম্পিউটারেই করে থাকেন। এক্ষেত্রে যান্ত্রিক কিছু সুবিধা পাওয়া যায় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
লেখকের চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়ার পর দ্বিতীয় ধাপে শুরু হয় বইয়ের অলঙ্করণের কাজ। এই অলঙ্করণের কাজটিও হয়ে থাকে কয়েকটি হাতে। যেমন বইয়ের প্রচ্ছদ; প্রচ্ছদের কাজটি বেশিরভাগ সময়ই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের চুক্তিবদ্ধ বা পছন্দের শিল্পীকে দিয়ে করানো হয়ে থাকে। অনেক সময় লেখক নিজেই নিজের বইয়ের প্রচ্ছদ করে থাকেন।
এ বিষয়ে কথা হয় দেশের খ্যাতিমান প্রচ্ছ্দ শিল্পী ধ্রুব এষ’র সঙ্গে। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, প্রতিটি বইয়ের বিষয়বস্তুই প্রচ্ছদের প্রতিপাদ্য। এক্ষেত্রে যে লেখক বা যে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আমার কাছ থেকে প্রচ্ছদ করিয়ে নিতে চান, তারা বইটির সিনোপসিস (পাণ্ডুলিপির সারাংশ) আমার কাছে দিয়ে যান। সে কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ বা যাই হোক না কেন। অনেক সময় বইয়ের বিষয়বস্তু বুঝে নেওয়ার জন্য সরাসরি লেখকের সঙ্গে কথা বলে নিই।
প্রকাশনা শিল্পের সাথে প্রচ্ছদ-অলঙ্করণের কাজটি ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রচ্ছদ হলো একটি বইয়ের বিষয়বস্তুর প্রতিচ্ছবি। অনেক পাঠক আছেন যারা প্রচ্ছদ দেখে ফ্লেপ্ফ কিংবা ভূমিকা পড়েন। ফলে একজন শিল্পী হিসেবে সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে প্রচ্ছদে বইয়ের বিষয়বস্তুকে ফুটিয়ে তোলার।
পেশা হিসেবে ১০ বছর ধরে প্রচ্ছদ আঁকার কাজ করে আসছেন জানিয়ে ধ্রুব এষ বলেন, সারা বছরই কাজ করি। বইমেলাকে কেন্দ্র করে এ সময়টাতে কাজের চাপ স্বাভাবিকভাবেই বেশি থাকে। তবে প্রতিবছর সব মিলিয়ে সর্বোচ্চ ছয়শ’ বইয়ের প্রচ্ছদ করতে পারি।
ধ্রুব এষ’র মতো সারা বছর প্রচ্ছদের কাজ না করলেও বইমেলা সামনে রেখে বছরের নভেম্বর থেকে ব্যস্ত সময় পার করতে হচ্ছে সময়ের আরেক শিল্পী সব্যসাচি হাজরাকে।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ধ্রুব দা’র মতো এতো কাজ আমি করতে পারি না। বইমেলা সামনে রেখে সর্বোচ্চ ৫০টি বইয়ের প্রচ্ছদ করতে পারবো বলে আশা করছি। তাছাড়া কিছু ভাল লাগার কাজ তো আছেই। সেগুলো বরাবরই মনযোগ দিয়ে করার চেষ্টা করি।
এ শিল্পীও জানালেন, প্রচ্ছদ করার ক্ষেত্রে বইয়ের বিষয়বস্তুই প্রধান। তবে ভাল লাগার কাজগুলো সরাসরি লেখকের সাথে কথা বলে অথবা পাণ্ডুলিপি পড়ে করার চেষ্টা করেন।
সম্পাদনা, প্রচ্ছদের কাজ হয়ে গেলে চূড়ান্ত অলঙ্করণের কাজটি করে থাকেন একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনার। তিনি বইটির পুঙ্খানুপুঙ্খ মাপজোক দিয়ে কম্পিউটারে সাজিয়ে বইটি মুদ্রণের জন্য প্রস্তুত করেন। মুদ্রণের জন্য প্রস্তুতকৃত পর্যায়টিকে ছাপাখানার ভাষায় বলা হয় আউটপুট।
এই আউটপুট দিয়েই তৈরি করা হয় প্লেট। সাধারণত চার রঙের মুদ্রণে সিটিপি (কম্পিউটার টু প্লেট) এবং এক ধরনের ফ্লিম ব্যবহার করা হয় প্লেট তৈরিতে। এক রঙের মুদ্রণে ট্রেসিং পেপার দিয়ে প্লেট করা হয়।
প্লেট হয়ে গেলেই তা চলে যায় নির্ধারিত ছাপাখানায়। মুদ্রণের কাজ সম্পন্ন হলে শুরু হয় বাঁধাইয়ের কাজ। বাংলাবাজার, ফকিরাপুল এলাকায় মুদ্রণ শিল্পকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে অসংখ্য প্লেট ও বাঁধাই কারখানা। শত শত শ্রমিক সংখ্যা, দিন ও মাশোহারা হিসেবে এসব কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করছেন।
কথা হয় বাঁধাই শ্রমিক রমজান আলীর সঙ্গে। তিনি জানান, বাঁধাইয়েও অনেক পর্যায়ের কাজ থাকে। একজন বইয়ের ফর্মা গুনে গুনে মুদ্রিত কাগজের ভাঁজ ঠিক করেন। আরেকজন সেলাই দেন। অন্যজন আঠা লাগিয়ে তা চাপা দিয়ে রাখেন।
সারা বছর এক রেটে কাজ করলেও জরুরি বিবেচনায় কাজের রেট সামান্য বেশি নিয়ে থাকেন। বইমেলার কাজগুলোতেও বছরের অন্য সময়ের তুলনায় রেট একটু বেশিই নিচ্ছেন বলে জানান তিনি।
বইয়ের ভেতরের পৃষ্ঠার (ছাপাখানার ভাষায় বলে ‘ইনার’) বাঁধাইয়ের কাজটি শেষ হলে প্রতিটি বই আলাদা আলাদাভাবে কাটিং মেশিনে সূক্ষ্ণভাবে কাটা হয়। কাটিং শেষে তা আবার আনা হয় বাঁধাই কারখানায়। এবার বাঁধাই শ্রমিকরা প্রতিটি বইয়ে আঠা দিয়ে মোড়ক লাগিয়ে শুকানোর জন্য দু’তিন দিন রেখে দেন।
এরপর সেই বই-ই লেখক-প্রকাশক বা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান হয়ে স্থান পাবে মেলার স্টলে, প্যাভিলিয়নে। অনেকগুলো মানুষের মেধা-মনন-প্রজ্ঞা-শ্রম সমন্বয়ে অনেক যত্নে তৈরি হওয়া বইটি তখনই সার্থক, যখন এটি পাঠকের মননকে ঋদ্ধ করে, বিকশিত করে বা আন্দোলিত করে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮০৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০১৬
এমএইচপি/জেডএম