ঢাকা: অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসায় বাংলায় বক্তব্য দিয়েছেন দুই বিদেশি। তাদের আবেগঘন বক্তব্য মন কাড়ে উপস্থিত সবার।
সোমবার (০১ ফেব্রুয়ারি) বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলার উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ কবি ও জীবনানন্দ অনুবাদক জো উইন্টার, চেক প্রজাতন্ত্রের লেখক-গবেষক রিবেক মার্টিন, আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সমিতির (আইপিএ)-এর সভাপতি রিচার্ড ডেনিস পল শার্কিন বক্তব্য রাখেন।
এদের একজন নজরুলের একটি পূর্ণাঙ্গ কবিতা ও রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার অংশ বিশেষ আবৃত্তি করেন। আরেকজন ৫২’র ভাষা আন্দোলনের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে নিজের স্বপ্নের কথা বলেছেন। আরেকজন বইয়ের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কথা বলেন।
কবি কাজী নজরুলের ইসলামের ‘কবি-রাণী’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন অনুবাদক জো উইন্টার।
কবি-রাণী
তুমি আমায় ভালোবাসো তাই তো আমি কবি।
আমার এ রূপ-সে যে তোমায় ভালোবাসার ছবি। ।
আপন জেনে হাত বাড়ালো-
আকাশ বাতাস প্রভাত-আলো,
বিদায়-বেলার সন্ধ্যা-তারা
পুবের অরুণ রবি,-
তুমি ভালোবাস ব’লে ভালোবাসে সবি?
আমার আমি লুকিয়েছিল তোমার ভালোবাসায়,
তুমিই আমার মাঝে আসি’
অসিতে মোর বাজাও বাঁশি,
আমার পূজার যা আয়োজন
তোমার প্রাণের হবি।
আমার বাণী জয়মাল্য, রাণি! তোমার সবি। ।
তুমি আমায় ভালোবাস তাই তো আমি কবি।
আমার এ রূপ-সে যে তোমার ভালোবাসার ছবি। ।
কবিতাটির খানিকটা আবৃত্তির পর তিনি রসিকতা করে বলেন, আমি ভুলে গেছি সবি।
ভাঙা ভাঙা বাংলায় কবিতাটি আবৃত্তির সময় উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে হাসির রোল পড়ে। তারা কবিতা আবৃত্তির মধ্যে বার বার করতালি দিয়ে আবৃত্তিকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
এরপর জো উইন্টার রবীন্দ্রনাথের পলাতকা কাব্যগ্রন্থের ‘হারিয়ে যাওয়া’ কবিতার ‘অন্ধকারে ভয়ে ভয়ে থেমে থেমে’ লাইনটি আবৃত্তি করেন।
বৃটিশ এ কবি ইংরেজিতে বক্তব্য দিলেও, বক্তব্যের মাঝে বাংলা কিছু শব্দ উচ্চারণ করেন। যা উপস্থিত শ্রোতাদের উৎফুল্ল করে তোলে।
চেক প্রজাতন্ত্রের লেখক-গবেষক রিবেক মার্টিন তার পুরো বক্তব্য রাখেন বাংলায়। তার বক্তব্যে ফুটে ওঠে সংগ্রামী চেতনার কথা, বাংলার প্রতি ভালোবাসা আর বিশ্বের বুকে বাঙালির সম্মান ও আত্মত্যাগের ইতিহাসের কথা।
রিবেক মার্টিন বলেন, অমর একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু আর্ন্তজাতিক ভাষা দিবস নয়। বরং সারা দুনিয়ার বহু জাতির অনুরাগের প্রতীক।
৫২’র ভাষা আন্দোলনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, মনের ভাব ও ভাষা সংস্কৃতি স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে এটা ছিলো আধুনিক যুগের বহু জাতির সংগ্রামের ঐক্য। ‘..বাংলাদেশ এই সংগ্রামের এক প্রগতিশীল জাতি। মায়ের ভাষার দাবিতে ভাষা আন্দোলন করেছে এ জাতি। সেই আন্দোলনে শহীদ ও তাদের স্মৃতি আমাদের ভবিষ্যতের আলো। ’
চেক প্রজাতন্ত্রের এই লেখক ও গবেষক আরও বলেন, বাংলা ভাষার মতো জাতিগত ভবিষ্যতের স্বপ্ন ইউরোপ মহাদেশে অনেকের ছিলো, আজও আছে। যারা আমাদের উপনিবেশবাদের মধ্যে ছাপিয়ে রাখে, তাদের শিকল ভেঙে মুক্ত হয়ে নিজের গলায় গান গাইতে চাই।
আধিপত্যবাদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, নিজের ভাষা, নিজের জাতি অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় অনেক সময়।
ইন্টারনেটের যুগে কেউ যেন বই পড়া না ছাড়ে সেই আহ্বান জানিয়ে রিবেক বলেন, অমর একুশে গ্রন্থমেলা উদ্বোধন উপলক্ষে আমার তিনটি প্রার্থনা। প্রথমত, যারা আজ পর্যন্ত নানা কারণে নিজের গলায় স্বাধীন মনের ভাব প্রকাশের জন্য লড়াই করছে, তাদের যেন স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিতে না হয়। দ্বিতীয়ত, বই পড়ার নেশা আমরা এই ইন্টারনেটের যুগে যেন না ছাড়ি। তৃতীয়ত, অন্য ভাষা শেখার মাধ্যমে, সাহিত্য অনুবাদের মাধ্যমে, আলোচনার মাধ্যমে যেন এমন একটা মানসিক ভাষা তৈরি হয়। যার ছন্দে সারা বিশ্বের শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যত কল্পনা করা যায়।
আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সমিতির (আইপিএ)-এর সভাপতি রিচার্ড ডেনিস পল শার্কিন অবশ্য ইংরেজিতে বক্তব্য রাখেন।
তিনি ছাপা ও ডিজিটাল সব ধরনের বইয়ের পাইরেসি বন্ধ করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ ও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান। শিক্ষা ও উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ বইয়ের মাধ্যমে মোকাবেলা করার আহ্বান জানান শার্কিন।
সোমবার বইমেলার উদ্ধোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বেলা ৩টা ৪ মিনিটে শিল্পী তপন মাহমুদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সংস্থার শিল্পীদের সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান।
এরপর পবিত্র ধর্মগ্রন্থসমূহ থেকে পাঠ করা হয়।
মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন এবং আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি গানটি পরিবেশন করা হয়।
পরে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা এবং নজরুলসংগীত পরিবেশন করেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের পৌত্রী অনিন্দিতা কাজী।
বাংলা একাডেমির সভাপতি অ্যামিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব বেগম আক্তারী মমতাজ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। বাংলাদেশের প্রকাশকদের পক্ষে বক্তব্য রাখেন অন্য প্রকাশের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম।
অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী পুরস্কার প্রাপ্তদের হাতে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার তুলে দেন।
বাংলাদেশ সময়: ২১১৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০১, ২০১৬
এমইউএম/এডিএ/এমজেএফ/