গ্রন্থমেলা থেকে: শুরু থেকেই অমর একুশে গ্রন্থমেলায় আসছে আকর্ষণীয়, মনোরম অঙ্গসজ্জার নতুন বই। এসব বইয়ের শরীরে জড়িয়ে থাকা হরেকরকম প্রচ্ছদ ছড়াচ্ছে নতুন বার্তা।
নানা স্টলে শোভা পাচ্ছে থরে থরে বইয়ের স্তূপ। স্টলের সামনেও সারিতে মেলে ধরা হয়েছে বই। মঙ্গলবার বাংলা একাডেমি আয়োজিত এ মেলার দ্বিতীয় দিনে এসেছে বিভিন্ন লেখকের গল্প, কবিতা, উপন্যাস আর প্রবন্ধের বিভিন্ন বই।
গ্রন্থমেলা ঘুরে দেখা যায়, দ্বিতীয় দিনেও গুছিয়ে উঠতে পারেনি গ্রন্থমেলা। মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে গিয়ে দেখা যায় কিছুটা অগোছালো চিত্র। বিশেষ করে এখনো বেশ কিছু স্টলের সাজসজ্জার কাজ বাকি থাকায় সোমবার সন্ধ্যা নাগাদও বই ওঠেনি তাকে। কাঁচা রঙের গন্ধ, বাঁশে পেরেক ঠোকার আওয়াজ। ব্যানার টাঙানো, বই ওঠানোতেই ব্যস্ত দেখা গেছে অনেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে।
বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢুকতেই দেখা গেলো, লাল ইট বিছিয়ে তৈরি করা হয়েছে রাস্তা। সেখানে নতুন বালি। অসংখ্য মানুষের পা সেই ধুলো উড়িয়ে দিচ্ছে প্রাঙ্গণজুড়ে। বিভিন্ন স্টলের সঙ্গে সেই ওই রাস্তার সংযোগ সড়ক থাকার কথা থাকলেও তা এখনও করে উঠতে পারেনি বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ।
বইমেলার এমন সাজগোজের মধ্যেও স্টল ঘুরে ঘুরে নতুন বইয়ের পাতা উল্টেপাল্টে দেখেন নানা বয়সের পাঠক। কেউ পড়েন ভূমিকা, পছন্দ হলে কিনেও নেন কেউ কেউ। প্রিয় লেখকের নতুন বইয়ের তথ্য সংগ্রহে অনেকে ব্যস্ত ছিলেন। তবে ক্রেতার চেয়ে দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিলো বেশি। এরকম অবস্থার মধ্য দিয়ে কাটে প্রাণের বইমেলার দ্বিতীয় দিনটি।
রামপুরা থেকে মেলায় আসা শারমিন সুলতানা বাংলানিউজকে বলেন, মেলার দ্বিতীয় দিনেও স্টলের কাজ চলছে। এটা মোটেও কাম্য ছিলো না। একাডেমি কর্তৃপক্ষ বইমেলা শুরুর আগেই মেলার কাজ সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা দিতে পারতো।
শারমিনের মতো এমন মন্তব্য আরও কয়েকজন দর্শনার্থীরও।
এসব বিষয়ে কথা হয়েছিলো মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব জালাল আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, কয়েকটি স্টল এখনও কাজ শেষ করতে পারেনি। তাদের মঙ্গলবারের মধ্যে কাজ শেষ করার তাগিদ দিয়েছি আমরা। কাজ শেষ করতে না পারলে বুধবার থেকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সেই সঙ্গে বুধবারের মধ্যে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের মিডিয়া সেন্টার ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের শৌচাগার নির্মাণের কাজ শেষ হবে বলে জানান তিনি।
তাছাড়া এখনও অনেক স্টল নির্মাণের কাজ শেষ হয়নি। সেখান থেকে ভেসে আসছে হাতুড়ি-বাটালির আওয়াজ। এছাড়া এখনও মিডিয়া সেন্টার এখনও নির্মিত হয়নি। আলোকসজ্জার জন্য অনেক ল্যাম্পপোস্ট তৈরি করা হলেও সেখানে লাইটিং চোখে পড়েনি খুব একটা।
অনুপম প্রকাশনীর সত্ত্বাধিকারী মিলনকান্তি নাথ বলেন, আমাদের দাবি এটাই ছিলো যে মেলাটা এক জায়গায় হবে। যারা বইয়ের প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত তারা সবাই এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একসঙ্গে মেলা করছেন। এটা অনেক বড় প্রাপ্তি। পাঠক-লেখকেরা আসবেন, স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়াবেন, বই কিনবেন, এটাই তো আমরা চেয়েছিলাম। বইমেলা এখন সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক উৎসব।
বিভিন্ন স্টলের বিক্রয়কর্মী জানান, এবারের শুরুটা খারাপ না। যত দিন যাবে, আরও ভালো হবে মেলা। বেশ গোছানো এবারের বইমেলা প্রাঙ্গণ। রাজনৈতিক অরাজকতাও নেই।
সন্ধ্যায় অ্যাডর্ন পাবলিকেশন্সের সামনে দেখা যায় বিদেশিদের ভিড়। এগোতেই জানা গেলো, সেখানে সুদূর মরক্কো, সুইডেন, স্লোভাকিয়া, তাইওয়ান থেকে এসেছেন সেসব দেশের বিখ্যাত কবিরা। উপলক্ষ অ্যাডর্ন থেকে প্রকাশিত আমিনুর রহমান অনূদিত ‘পৃথিবী সেরা সমকালীন চার কবির কবিতা’ ও ‘নিকারাগুয়ার কবিতা’ বই দু’টির মোড়ক উন্মোচন। উপস্থিত ছিলেন মরক্কোর কবি বেনাইসা বোমালা, সুইডেনের কবি বেনট বার্গ, স্লোভাকিয়ার মিলান রিচার, তাইওয়ানের কবি লি কুই শিন, লি রুই ইং, ড. ফাং ইয়াও চিয়েন, তাই চিন চু, চেন জিয়াও জেন।
মূল মঞ্চের অনুষ্ঠান
বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলা একাডেমির হীরকজয়ন্তী: বাংলা একাডেমিকে ফিরে দেখা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শফিউল ইসলাম। আলোচনায় অংশ নেন ফজলে রাব্বি, আজিজুর রহমান আজিজ, বেগম আকতার কামাল এবং মোহিত কামাল। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল কাইউম। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়, সুবীর নন্দী, সুজিত মোস্তফা, ইফফাত আরা নার্গিস, আঞ্জুমান আরা শিমুল।
নতুন বই
বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্র মঙ্গলবার মেলায় আসা নতুন বইয়ের সংখ্যা ৭টি জানালেও মেলাপ্রাঙ্গণ ঘুরে জানা যায়, এদিন নতুন বইয়ের সংখ্যা শতাধিক। বাংলা একাডেমির কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের তথ্য কেন্দ্রে লেখক-প্রকাশকরা যতটি বই জমা দেন ততটিই তারা প্রচার করেন। দ্বিতীয় দিনে অনেক বই প্রকাশ হলেও তথ্য কেন্দ্রে ৭টির বেশি বই জমা পড়েনি।
মেলার মাঠ ঘুরে দেখা গেছে এদিন অন্যপ্রকাশ থেকে এসেছে জননন্দিত লেখক হুমায়ুন আহমেদের ‘সেরা দশ গল্প’, একই প্রকাশনা থেকে ইমদাদুল হক মিলনের ‘সেরা দশ গল্প’, জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের ‘স্বপ্নে সীমানা পারাপার’, তাম্রলিপি থেকে মুহম্মদ জাফর ইকবালের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি ‘ক্রেনিয়াল’, হুমায়ুন আহমেদের প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন খানের প্রথম কবিতার বই ‘আজো, কেউ হাঁটে অবিরাম’, স্টুডেন্ট ওয়েজ থেকে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের ‘মিশ্রগদ্য’, আগামী প্রকাশনী থেকে হাসনাত আবদুল হাইয়ের উপন্যাস ‘শুচিতা’, অবসর থেকে ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘রবীন্দ্রনাথ কেন জরুরি’, ‘উত্তরাধিকারের অনিবার্য প্রশ্ন’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘নির্বাচিত সেরা সাত’, সময় প্রকাশন থেকে সাইদ হাসান দারার ‘উপাখ্যান : মুজিব-ইয়াহিয়া-ভুট্টো এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ’, ঐতিহ্য থেকে দেওয়ান বারীন্দ্রনাথের ‘প্রাইভেট লাইফ অব ইয়াহিয়া খান’ ইত্যাদি।
বুধবারের আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসব
বুধবার বাংলা একাডেমিতে স্লোভাকিয়া, মরক্কো, সুইডেন, চীন, তাইওয়ান, যুক্তরাজ্য, ভারত ও বাংলাদেশের কবিদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হবে দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসব। সকাল ১০টায় উৎসবের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে। এতে বাংলা ও বিশ্বকবিতা বিষয়ে প্রবন্ধ পাঠ করবেন ব্রিটিশ কবি ও জীবনানন্দ গবেষক জো উইন্টার ও বাংলাদেশের কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। কবিতাপাঠে অংশ নেবেন ব্যাংক্ট বার্গ, মিলান রিচার্ড, ড. বেনাইছা বহুমালা, জাকারিয়া বহুমালা, ড. লি ফো আর, লি রো ইয়াং, ড. ফাং ইয়াও চিয়েন, তাই চি চৌ, চেন সিউ জেন, কবি আসাদ চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, রবিউল হুসাইন, কাজী রোজী, আনোয়ারা সৈয়দ হক, আমিনুর রহমান। সভাপতিত্ব করবেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক।
বাংলাদেশ সময়: ২১১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০১৬
এডিএ/এএ