গ্রন্থমেলা থেকে: ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন ভোলার ফুলজাহান বেগম। শরীরের প্রায় অর্ধেক পুড়ে গেছে।
এ বৃদ্ধার সন্তান মো. আলমগীর মাকে বাঁচাতে ছুটে এসেছেন অমর একুশে গ্রন্থমেলায়।
মেলার প্রবেশ মুখে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছেন ফুলজাহানের ছেলে। চোখের পানিতে ছলছল করছে তার চোখ। হাতে সাদা কাগজের প্ল্যাকার্ড। তাতে লেখা- একজন মুমূর্ষ রোগীর জন্য রক্তের প্রয়োজন, যোগাযোগের নম্বর ০১৭১৩৩৯৮৩৮৬।
বিকেলে মেলায় প্রবেশ করতেই আলমগীরের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। বলেন, ‘দিন দশেক আগে আমার মা চেরাগের আগুনে পুড়ে গেছেন। বৃদ্ধা মা আমার...খেয়াল করে নাই কখন শাড়িতে আগুন লেগেছে...’। কথা বলতে বলতে ডুকরে কাঁদেন মধ্যবয়স্ক আলমগীর। বলেন, ‘ভাই আমরা গরিব মানুষ। কৃষিকাজ করে কোনোরকম সংসার চালাই। রক্ত কেনার টাকাও নাই। তারমধ্যে এই রক্তটা (ও নেগেটিভ) নাকি পাওয়া কঠিন, তাই বইমেলায় আসছি। ’
আলমগীরের সঙ্গে কথা বলার সময় অমর একুশে গ্রন্থমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ আসেন। এসেই আলমগীরসহ কয়েকজন প্ল্যাকার্ডধারীকে এখানে না দাঁড়িয়ে তথ্যকেন্দ্রে গিয়ে রক্তের তথ্য দিতে বলেন। এখানে দাঁড়িয়ে রক্ত চাওয়ার আবেদন করায় সমস্যা কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দেখছেন না লিফলেট বিতরণ করে মেলার কি চেহারা করেছে?’ এসময় মেলার ভেতরে কয়েকজন লিফলেট বিতরণকারীকে তিনি মেলা নোংরা করার কারণে লিফলেট নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে নিষেধ করেন। আলমগীরসহ এরকম যারা রক্ত চেয়ে প্ল্যাকার্ড ধরেছেন তাদের তিনি তথ্য কেন্দ্রে পাঠান।
রক্ত চেয়ে প্ল্যাকার্ড ধরে যারা দাঁড়িয়েছেন তারা অভিযোগ করে বলেন, ‘আমরাতো মেলা নোংরা করছি না। একটি প্ল্যাকার্ড নিয়ে ভেতরে দাঁড়িয়েছি। ’
মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিবকে এ প্রতিবেদক ‘রক্তের বিষয়টা মানবিক বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা যায় কি-না’ এমন কথা বলতেই তিনি বলেন, সবই মানবিক। যারা ভিক্ষুক তাদের ভিক্ষা চাওয়াও মানবিকতা। কিন্তু মেলার পরিবেশ সুন্দর রাখতে তাদের মেলার ভেতর এ সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না।
তিনি বলেন, মেলার তথ্যকেন্দ্র থেকে রক্ত চেয়ে অ্যানাউন্স করা হয়। যে কেউ তথ্যকেন্দ্রে রক্তের চেয়ে তথ্য দিতে পারেন।
পরিবার ও স্বজনের রক্তের প্রয়োজনে এদিন কয়েকজনকে দাঁড়াতে দেখা গেছে। কেউ এসেছেন ও নেগেটিভ রক্তের প্রয়োজনে, কেউ এ নেগেটিভ। কারও বা এ পজেটিভ রক্ত প্রয়োজন।
বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্র থেকে জানা যায়, তথ্যকেন্দ্রে যে কেউ বিনামূল্যে রক্তের প্রয়োজনীয়তা জানাতে পারেন।
মেঘলা দিনের বইমেলা
মঙ্গলবার (৯ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমির দুই অংশেই ছিলো ক্রেতা-দর্শনার্থীর ভিড়। মেঘলা আকাশ। হালকা ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। মনোমুগ্ধকর এ বিকেলে তাই মেলায় আসার লোভ সামলাতে পারেননি অনেকেই। সন্ধ্যে হতেই এ ভিড় হয় দ্বিগুণ।
মেলার ভয় বৃষ্টি
গতরাতে হঠাৎ করেই দেশজুড়ে বৃষ্টি নেমেছিলো। এক ঘণ্টার বৃষ্টিতে রাজধানী মেতেছিলো জলের উৎসবে। কিন্তু বৃষ্টিতে নাগরিক মনে দোলা দিলেও স্বস্তিতে ছিলেন না প্রকাশকরা। মেলা ঘুরে দেখা গেছে, দু’একটি স্টলের ওপরের সিলিংয়ে চুঁইয়ে পড়া বৃষ্টির পানির দাগ। প্রকাশকরা জানালেন, আরেকটু বৃষ্টি হলেই বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হতে হতো প্রকাশনা সংস্থাগুলোকে।
অবসর প্রকাশনীর ব্যবস্থাপক মাসুদ রানা বাংলানিউজকে বলেন, মঙ্গলবার রাতে আমাদের স্টলের কয়েকটি স্থান দিয়ে বৃষ্টির পানি চুঁইয়ে পড়েছে। বৃষ্টির পড়ার স্থায়িত্ব বেশি হলে বই ভিজবেই।
তাম্রলিপি প্রকাশনীর সত্ত্বাধিকারী একেএম তরিকুল ইসলাম রনি বলেন, আমরা নিজেদের উদ্যোগে ত্রিপল রেখেছি। বৃষ্টি এলে যাতে বইয়ের ওপর সেগুলো বিছিয়ে দেয়া যায়। বইগুলোকে প্রতিদিন সর্বোচ্চ নিরাপদ স্থানে রাখার চেষ্টা করি। তবু শঙ্কা থেকেই যায়। বৃষ্টির পরিমাণ বেশি হলে তা হলে বই ভিজবেই।
মেলায় মন্ত্রী মোজাম্মেল ও বিএনপি নেতা মওদুদ
বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আসেন মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। নজরুল মঞ্চে তিনি অনন্যা থেকে প্রকাশিত গণসঙ্গীতশিল্পী ফকির আলমগীর সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি বন্ধুরা’ বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন।
মোড়ক উন্মোচন শেষে মন্ত্রী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের জন্য চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। চেতনায় একাত্তরকে ধারণ করে আমাদের কবি-সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক কর্মীরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। সঠিক ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে তারা পথ দেখিয়ে যাচ্ছেন। ’ এ সময় উপস্থিত ছিলেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ।
নজরুল মঞ্চে মোড়ক উন্মোচন করা হয় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের প্রয়াত সন্তান আমান মওদুদের চিত্রকর্ম ও জীবনী নিয়ে সংকলনগ্রন্থ ‘ইন লাভিং মেমোরি অব আমান মওদুদ: হিজ লাইফ অ্যান্ড আর্ট’। মোড়ক উন্মোচন করেন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী মনিরুল ইসলাম। এসময় উপস্থিত ছিলেন মওদুদ আহমেদ, তার স্ত্রী হাসনা মওদুদ। বইটি প্রকাশ করেছে পলাশ প্রকাশনী।
বইটি সম্পর্কে চিত্রশিল্পী মনিরুল ইসলাম বলেন, আমান মওদুদের কোনো কোনো চিত্রে আছে দেশীয় ব্যাপার। আবার কোনোটাতে শাশ্বত ব্যাপারও রয়েছে। তা ছাড়া ব্যক্তিজীবনে সে ছিলো অসাধারণ মানুষ।
ছেলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ বলেন, আমার ছেলে বুদ্ধিবৃত্তিক বিবেচনায় সবার কাছে প্রতিবন্ধী ছিলো। কিন্তু প্রতিনিয়ত সে তার ভাবনার প্রকাশ করেছিলো চিত্রের মাধ্যমে। প্রতিটি চিত্রেই আছে তার মেধার স্বাক্ষর।
বিকেল ৫টায় নজরুল মঞ্চে মোড়ক উন্মোচন করা হয় তরুণ সাংবাদিক ইন্দ্রজিৎ সরকারের দু’টি কিশোর উপন্যাস। বই দু’টি হলো পার্ল পাবলিকেশন্স থেকে ‘বল্টুর ভয়ংকর অভিযান’ ও দেশ পাবলিকেশন্স থেকে ‘মানুষখেকোর জঙ্গলে গোয়েন্দা সপ্তক’।
বই দু’টির মোড়ক উন্মোচন করেন সমকালের নির্বাহী সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি।
মূল মঞ্চের আয়োজন
বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশের প্রকাশনা কার্যক্রম : অতীত থেকে বর্তমান’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আহমাদ মাযহার। আলোচনায় অংশ নেন শিল্পী রফিকুন নবী, কবি তারিক সুজাত, লেখক রেজানুর রহমান ও পশ্চিমবঙ্গের লেখক-গবেষক ইমানুল হক। সভাপতিত্ব করেন শিল্পী হাশেম খান। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিলো সত্যেন সেন শিল্পগোষ্ঠীর শিল্পীদের পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী নাদিরা বেগম, দিলরুবা খান, আজগর আলীম, মো. নূরুল ইসলাম।
নতুন বই
বাংলা একাডেমির তথ্যমতে, মঙ্গলবার মেলায় প্রকাশিত হয়েছে ১১০টি নতুন বই। এর মধ্যে গল্প ২০, উপন্যাস ১৫, প্রবন্ধ ৮, কবিতা ২৮, শিশু সাহিত্য ৩, ছড়া ৫, জীবনী ৪, মুক্তিযুদ্ধ ১, নাটক ১, বিজ্ঞান ৫, ভ্রমণ ১, ইতিহাস ৩, স্বাস্থ্য ১, রম্য/ধাঁধা ১, অনুবাদ ১, সায়েন্স ফিকশন ৩ ও অন্যান্য ১০টি বই।
উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত মাহমুদ মেননের অনুবাদগ্রন্থ ‘জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪’, অন্যপ্রকাশ থেকে ফেরদৌস হাসানের ‘মায়া’, পিয়াস মজিদের ‘নগর ঢাকায় জনৈক জীবনানন্দ’, রেজাউদ্দিনের ‘জ্যামিতি বক্সের গল্প’, চন্দ্রদ্বীপ এনেছে অসীম সাহার ‘শ্মশান ঘাটের মাঝি’, অনন্যা এনেছে মুস্তাফা জামান আব্বাসীর ‘আব্বাস উদ্দীন মানুষ ও শিল্পী’, ঐতিহ্য এনেছে বিচারপতি মো. গোলাম রব্বানীর ‘বাংলাদেশের সংবিধানের বিকাশ, বৈশিষ্ট্য ও বিচ্যুতি,’ কথাপ্রকাশ এনেছে রাজু আলাউদ্দিন অনূদিত ‘কথাসমগ্র’, গোল্ডেন বুকস এনেছে লুৎফর রহমান রিটনের ‘রসগোল্লাটা কথা বলে’, পার্ল পাবলিকেশন্স এনেছে ইন্দ্রজিৎ সরকারের ‘বল্টুর ভয়ঙ্কর অভিযান’, রাত্রি এনেছে সৈয়দ শামসুল হকের ‘বাবার সাথে যাওয়া ও অন্যান্য বিষয়ের গল্প’, তারেক মাহমুদ জর্জের ‘তথ্য অধিকার আইনের ময়নাতদন্ত’, মনের কথা প্রকাশনা থেকে মানিক মুনতাসীরের ‘খবরের কবর’।
বুধবার যা থাকছে মেলায়
বুধবার মেলার ১০তম দিনে বইমেলার দুয়ার খুলবে যথারীতি বেলা ৩টায়। চলবে রাত ৮টা পর্য্যন্ত। বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘বাংলাদেশে শিশুসাহিত্য চর্চা: অতীত থেকে বর্তমান’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন শাহীন আখতার। আলোচনায় অংশ নেবেন আসলাম সানী, রাশেদ রউফ ও সুজন বড়ুয়া। সভাপতিত্ব করবেন বিশিষ্ট লেখক রশীদ হায়দার। এছাড়া প্রতিদিনকার মতো সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানতো থাকছেই।
বাংলাদেশ সময়: ২১২৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৬
এডিএ/এএ