বইমেলা থেকে: রান্না করা গরুর মাংস থেকে শুরু করে নকশিকাঁথা- সবই পাওয়া যায় অমর একুশে গ্রন্থমেলায়! গত বছর পর্যন্ত বইমেলা নিয়ে এমন অভিযোগ ছিল সব মহলে।
বিশেষ করে যারা বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে লেখক-পাঠক-প্রকাশক ও বইপ্রেমিদের ‘মিলনমেলা’ হিসেবে দেখতে চান, তারা সব সময় চাইতেন বইমেলা হবে শুধু বইয়েরই মেলা।
এবার তাদের চাওয়া শতভাগ পূরণ হয়েছে বৈকি! বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গন থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গ্লাস টাওয়ার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বর থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত ব্যাপ্ত অমর একুশে গ্রন্থমেলার আওতার মধ্যে খাবারের দোকান তো দূরের কথা, স্থায়ী চায়ের দোকানও বন্ধ করে দিয়েছে মেলা কর্তৃপক্ষ।
তিন বছর আগে অমর একুশে গ্রন্থমেলা তার লেজটুকু বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গনে রেখে পুরো শরীরটা নিয়ে হাজির হয় ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ছায়াবিথী তলে। আর তখনই একাডেমির সামনের সড়কটা উন্মুক্ত হয়ে যায় ফুটপাথের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য।
ফলে অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে শিশু একাডেমি থেকে শাহবাগ ছবির হাট পর্যন্ত পাইরেসি-ফটোকপি বইয়ের দোকান, চুরি-ফিতা-ঝাড়বাতি, জুতা-স্যান্ডেল-মোমবাতি, বেডসিট-আগরবাতি, বাচ্চাদের খেলনা-পাটের তৈরি দোলনা, মৃৎশিল্প-সিরামিক, নকশিকাঁথা, থ্রি-পিস, ঘর সাজানোর শো-পিস, চটপটি-ফুসকা, ডিম-সবজি-পরোটা ও আইসক্রিমসহ এমন কোনো জিনিস নেই, যা পাওয়া যেতো না।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বাংলা একাডেমির সামনের সড়ক ও ফুটপাথের ওপর এমনভাবে পসরা সাজিয়ে বসতেন যে, মেলায় আসা লেখক-পাঠক-প্রকাশক ও সাধারণ দর্শনার্থীদের চলাচলে প্রচণ্ড বিঘ্ন সৃষ্টি হতো।
আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল অংশ জুড়ে বসতো শত শত খাবারের দোকান। প্রিয়জনকে নিয়ে মেলায় আসা তরুণ-তরুণীরা বই কেনার টাকা খাবারের দোকানে রেখেই বাসায় ফিরতেন।
বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলা পরিণত হয় অমর একুশে বারোয়ারি মেলায়। গত বছর পর্যন্ত এ চিত্রই দেখে আসতে হয়েছে বইপ্রেমিদের।
কিন্তু এ বছরের চিত্র একেবারেই ভিন্ন!
টিএসসি বা দোয়েল চত্বরের সামনে নির্মিত বইমেলা তোরণ- যেপাশ দিয়েই এবার দর্শনার্থীরা মেলায় ঢোকেন না কেন, সড়ক ও ফুটপাথ পাচ্ছেন একেবারে ফাঁকা। পাইরেসি-ফটোকপি বইয়ের দোকান, চুড়ি-ফিতা-ঝাড়বাতি, জুতা-স্যান্ডেল-মোমবাতি, বেডসিট-আগরবাতি, বাচ্চাদের খেলনা-পাটের তৈরি দোলনা, মৃৎশিল্প-সিরামিক, নকশিকাঁথা, থ্রিপিচ, ঘর সাজানোর শো-পিস, চটপটি-ফুসকা, ডিম-সবজি-পরোটা ও আইসক্রিমের একটি দোকানও বসতে দেওয়া হয়নি।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলা প্যান্ডেল তো বটেই, এর বাইরেও বসতে দেওয়া হয়নি কোনো খাবারের দোকান।
বরং ছবির হাট থেকে শুরু করে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে স্থায়ী চায়ের দোকানগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যাচেলর স্টাফ মেসের ভেতরে যে খাবারের দোকান ছিল, সেটিও বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে এ দোকান যেন চালাতে না পারে, সেজন্য বসানো হয়েছে কড়া পুলিশি পাহারা।
বিগত বছরগুলোতে মেলা প্রাঙ্গন ও এর আশপাশে বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি তাদের নতুন পণ্য ভোক্তাদের কাছে পরিচিত করার জন্য মেলায় লিফলেট, স্যুভেনিয়র, ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন বিলি ও প্রর্দশন করতো। এবারের বইমেলায় কঠোর হস্তে সেগুলোকেও নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
শুধু তাই নয়, মেলায় অংশ নেওয়া কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের নির্দিষ্ট স্টল বা প্যাভিলিয়নের বাইরে কোনো ব্যানার, ফেস্টুন প্রদর্শনের সুযোগ পাচ্ছে না।
মেলার এই নির্ঝঞ্ঝাট নিরেট নিপাট পরিবেশ দেখে প্রায় সবাই সন্তুষ্ট হলেও কেউ কেউ আবার বলছেন, সব ধরনের খাবারের দোকান তুলে দিয়ে বাংলা একাডেমি পরিচালিত ক্যান্টিনে খাবারের দাম রাখা হচ্ছে গলাকাটা হারে!
ফলে ছোট বাচ্চা ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যারা মেলায় আসছেন, তারা নিরুপায় হয়ে বাংলা একাডেমির ক্যান্টিনেই খাচ্ছেন আর গচ্চা দিচ্ছেন।
সাভার থেকে পরিবারসহ মেলায় আসা মো. আব্বাস উদ্দীন বাংলানিউজকে বলেন, খাবারের দোকানসহ অন্যান্য দোকান-পাট তুলে দিয়ে মেলার নিরাপত্তা ও অনাহুত চাপ কমানোয় আমরা খুশি। কিন্তু মেলার ভেতরে বাংলা একাডেমির ক্যান্টিন অমানবিক মূল্যে খাবার বিক্রি করে আমাদের আনন্দ মাটি করে দিচ্ছে।
মিরপুর থেকে বন্ধুর সঙ্গে মেলায় আসা ফারজানা রহমান তনু বাংলানিউজকে বলেন, ফুটপাথে মাটি বা পাটিতে বিছিয়ে পাইরেসি ও নকল বই বিক্রি করায় বিগত বছরগুলোতে মেলার সৌন্দর্য অনেকটা ফিঁকে হয়েছিল। এবার সে সুযোগ না থাকায় মেলার সৌন্দর্য বেড়েছে। আর খাবারের দোকান না থাকায় বাড়তি খরচের হাত থেকে বাঁচা গেছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৬
এজেড/এএসআর