অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে: সপ্তাহের শেষ, ছুটিরও শুরু- এমন দিনের ভিড় যেন নিয়মিত হয়ে উঠছে গ্রন্থমেলায়। পরদিন ভোরে জাগার তাড়া নেই, ভিড়ে হেঁটে মাথা-পায়ে ব্যথা হলেও চিন্তা নেই! সেসব ভেবেই যেন মেলার ১১তম দিনের (বৃহস্পতিবার, ১১ ফেব্রুয়ারি) ভিড়টা চোখে প্রশান্তি দিয়েছে প্রকাশক-আয়োজকদের।
চিত্র দেখে বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক (ডিজি) শামসুজ্জামান খান বলেন, বসন্ত তারুণ্যের প্রতীক। এটি আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। বসন্তের উৎসবকে নতুন মাত্রা দিয়েছে বইমেলা। যার রেশ আজ থেকে শুরু হলো।
দুপুর ২টা ৪০ মিনিটের চিত্র, অন্তত ৫০ জন করে লাইনে দাঁড়িয়ে প্রবেশপথগুলোতে। তিনটা বাজার অপেক্ষা তাদের। মেলায় এবারই প্রথম এমন দৃশ্য চোখে পড়লো। সময় হলো, মেলায় ঢুকলেন দর্শনার্থী-ক্রেতারা। বের হওয়ার সময় চোখে পড়ে বেশিরভাগের হাতেই রয়েছে বইয়ের প্যাকেট।
নিজেদের মোটামুটি মধ্যম মানের প্রকাশনা উল্লেখ করেন ‘শোভা প্রকাশ’ পরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। তিনি বাংলানিউজকে জানান, এদিন প্রায় লাখ খানেক টাকার বই বিক্রি করেছেন।
মিজানুর রহমান বলেন, যারা আরও বড় প্রকাশনা ও বেশি জনপ্রিয়, তাদের বিক্রিটাও নিশ্চয়ই আমাদের চেয়ে বেশি হয়েছে। মন্দ নেই ছোটখাটো প্রতিষ্ঠানও।
তিনি বলেন, ১৮ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, মেলা শুরুর পর জোয়ার আসে, সেটি শেষ পর্যন্ত থেকে যায়। এখন সে জোয়ার শুরু হয়ে গেছে।
‘এবারের মেলায় সবচেয়ে বড়দিক, শুধু জোয়ারে গা ভাসাচ্ছেন না আগতরা, বই কিনে ফিরছেন’- বলেন তিনি।
আসছেন জনপ্রিয় লেখকরা হাসিমুখে মেলা ঘুরলেন আনিসুল হক। আর প্রথমবারের মতো এলেন লেখক ইমদাদুল হক মিলনও।
মেলার নতুন সাজ-পরিসরে মুগ্ধ বলে জানালেন বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপে। তিনি বলেন, অন্তত ১০/১২টি দেশের বইমেলা ঘুরেছি আমি। আমাদের এ মেলা বেশ ভালো ও গোছানো হয়েছে। খোলামেলা, স্টলগুলো সুন্দর, যোগ হয়েছে প্যাভিলিয়ন। সব মিলিয়ে ভালো। আগামীতে আরও ভালো হবে।
মেলায় দেরিতে আসা প্রসঙ্গে বলেন, আমার বই কলকাতা থেকেও বের হয়। সেখানে যেতে হয়। তবে আজ থেকে প্রতিদিন আসবো একদম শেষ পর্যন্ত।
এবার নিজের ৫টি নতুন বই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আসলে পিতা যেমন তার সন্তানদের মধ্যে কে বেশি আদরের, সেটি বলতে পারে না, তেমনি লেখক হিসেবে আমিও নিজের সেরা বই কোনটি, বলতে পারছি না। তবে এই প্রথম আমি একটি সায়েন্স ফিকশন লিখেছি, নাম- ‘ছোট সবুজ মানুষ’।
এদিকে ‘জীবনের গল্প’ নামে একটি বইয়ের লেখক আরজে কিবরিয়া স্টলে এলে তাকে ঘিরে ভিড় জমে। এক পর্যায়ে স্টলটির বিকিকিনি বন্ধ করতে বাধ্য হন তারা। পুলিশের প্রহরাও রাখা হয় শেষ পর্যন্ত। তিনি এদিন মেলায় আসবেন বলে আগেই রেডিওতে প্রচার করায় এ বিপত্তি বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
মেলায় রাঙ্গা
এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা এসেছিলেন মেলায়। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এবারের পরিবেশ অনেক ভালো। কোনো রকম অরাজকতা নেই। নিরাপত্তার ঘাটতি নেই।
নিরাপত্তার খাতিরে ধরপাকড়
মেলার ফটকের কাছেই হকারদের ভিড়ে নিরাপত্তাজনিত সমস্যা হতে পারে ও প্রবেশ-প্রস্থানেও হতে পারে সমস্যা। সে বিবেচনায় সন্ধ্যার পরপর কিছুক্ষণ ধরপাকড় চালায় পুলিশ। বিশেষ করে ভ্রাম্যমাণ দোকান ও হকারদের সরিয়ে দেওয়া হয়।
তবে সাধারণ আগতদেরও কিছুটা হয়রানির শিকার হতে হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মেলার ১১তম দিনে নতুন বই
অমর একুশে গ্রন্থমেলার ১১তম দিনে নতুন বই এসেছে ১৩১টি। এর মধ্যে গল্পের ২৮, উপন্যাস ২০, প্রবন্ধ ১৪, কবিতা ২৪, ছড়া ৩, শিশুসাহিত্য ৫, জীবনী ১০, মুক্তিযুদ্ধ ২, নাটক ১, বিজ্ঞান ১, ভ্রমণ ৩, চিকিৎসা/স্বাস্থ্য ২, কম্পিউটার ১, রম্য/ধাঁধা ২, সায়েন্স ফিকশন ৩ এবং অন্যান্য বই রয়েছে ১২টি।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- রায়হান আহমেদের প্রবন্ধ ‘হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু’, মো. মাহবুবুল আলমের স্মৃতি মূলক বই ‘হুমায়ুন আহমেদের সাথে সাতটি বছর’, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘দুই বাংলার শ্রেষ্ঠ সমকালীন প্রেমের গল্প’, অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর স্বাস্থ্য বিষয়ক গ্রন্থ ‘কিডনির যত্ন’, শামসুল আলম জুয়েলের আত্মউন্নয়নমূলক বই ‘সফলতার রহস্য’, দন্ত্যস রওশনের ‘একটি হলুদ নিমপাতা’, সুমন্ত আসলামের কিশোর উপন্যাস ‘পা কাটা পাপ্পু’, জ্যোতিষ শাস্ত্রী ড. শেখর রায়ের স্বাস্থ বিষয়ক ‘সুস্থ থাকুন সহজ উপায়ে’, আবদুশ শুকুর খানের উপন্যাস ‘রাত বারোটার ঘণ্টা’।
এদিনের বিকেল-সন্ধ্যা
এদিন বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে ‘বাংলা একাডেমির হীরকজয়ন্তী: অমর একুশে গ্রন্থমেলার অতীত থেকে বর্তমান’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান হয়। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গবেষক বদিউদ্দিন নাজির। আলোচনায় অংশ নেন মুহম্মদ জাহাঙ্গীর, ড. জালাল আহমেদ এবং খান মাহবুব। সভাপতিত্ব করেন প্রকাশক মহিউদ্দিন আহমদ।
আলোচকরা বলেন, একই সঙ্গে অমর একুশে গ্রন্থমেলা আয়োজনে মাসব্যাপী আলোচনায় বইয়ের সম্পাদনা, মুদ্রণ, বিপণন ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। গণমাধ্যমে বইয়ের প্রচারের ক্ষেত্রে একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকাও প্রয়োজন, যার মাধ্যমে প্রকৃত ভালো বই পাঠকের কাছে পৌঁছুতে পারে।
সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ফয়জুল আলম পাপ্পুর পরিচালনায় আবৃত্তি সংগঠন ‘প্রকাশ সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংগঠন-’এর শিল্পীরা অংশ নেন। এতে সংগীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী শাহীন সামাদ, কল্যাণী ঘোষ, বুলবুল মহলানবীশ, মাহমুদ সেলিম, হায়দার হোসেন, মাহমুদুজ্জামান বাবু এবং শেখ মিলন।
যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন গৌতম মজুমদার (তবলা), শেখ আবু জাফর (বাঁশি), মো. ফারুক (প্যাড), শাহরাজ চৌধুরী (গিটার) এবং সুমন রেজা খান (কি-বোর্ড)।
১২ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ‘শিশুপ্রহর’ ঘোষণা
শিশুদের নিয়ে অভিভাকরা যেন স্বাচ্ছন্দ্যে বই কেনার সুবিধা পারেন, সে লক্ষ্যে ১২ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) এবং ২৬ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) শিশুপ্রহর ঘোষণা করা হয়েছে। সকাল ১১টা থেকে বেলা ১টা শিশুপ্রহর থাকবে।
একাডেমি মিলনায়তনে সিসিমপুরের অনুষ্ঠান থাকবে শিশুপ্রহরের মূল আকর্ষণ। এতে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
শুক্রবারের অনুষ্ঠান
শুক্রবার সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে শিশু-কিশোর সংগীত প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন
বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী পাপিয়া সারোয়ার।
বিচারকমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে থাকবেন আনিসুর রহমান তনু, ইয়াকুব আলী খান এবং সাগরিকা জামালী। এতে সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করবেন রহিমা আখতার কল্পনা। আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হবে।
বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘বাংলাদেশে নজরুলচর্চা:
অতীত থেকে বর্তমান’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রফিকউল্লাহ খান। আলোচনায় অংশ নেবেন ভাষাবিদ, প্রাবন্ধিক ড. মাহবুবুল হক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মোহীত উল আলম এবং কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন।
সভাপতিত্ব করবেন প্রখ্যাত নজরুল গবেষক ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। সন্ধ্যায় রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
বাংলাদেশ সময়: ২১৩৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৬
এসকেএস/আইএ/এএ