ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বইমেলা

বইমেলায় এতো বই, দৃষ্টিহীনের পাঠ্য কই!

সৈয়দ ইফতেখার আলম, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৬
বইমেলায় এতো বই, দৃষ্টিহীনের পাঠ্য কই! ছবি: শাকিল/ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে: বইমেলায় এসে বই না পেয়ে ভীষণ কষ্ট নিয়ে ফিরে যান রেহানা আক্তার। সে অনেক বছর অাগের স্মৃতি।

এখনও ওই কষ্ট তার মনে দাগ কেটে আছে। কেবলমাত্র দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হওয়ায় লেখাপড়া জানা সত্ত্বেও, প্রাণের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় এতো বইয়ের ভিড়েও কোনো বই তার নয়, তাদের মতো মানুষের নয়! নতুন বইয়ের গন্ধ শুকে দেখা, পৃষ্ঠা উল্টে দেখার মতো আনন্দ তাদের সাজে না! এ যে কী কষ্টের অনুভূতি তা বলে বোঝাতে পারলেন না রেহানা।

ইডেন মহিলা কলেজের এই ছাত্রী আবেগঘন কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বাংলানিউজকে বলেন, এক সময় মেলায় এসে দেখি সবই কাগজে ছাপা বই। এত্তো বড় বইমেলায় আমাদের জন্য কিছুই নেই! তাতে কী, কেউ আমাদের কথা মনে না রাখুক— ধরেই নিয়েছি একুশ মানে মাথা নতো না করা। আমরাও মাথা নতো করবো না।

মেলার বাংলা একাডেমি অংশে স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনার স্টলে (৮৩-৮৪নং) বসে রেহানার সঙ্গে কথা হয়। পাশে ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স শেষবর্ষের পড়ুয়া ইডেন কলেজের আরেক ছাত্রী রীপা। তিনিও দৃষ্টিহীন। তবে বই পড়ার ভীষণ শখ। কেবলমাত্র সুযোগের অভাবে সমাজে তাদের বঞ্চিত থাকতে হচ্ছে বলে মত দিলেন তিনি।

স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনা সংস্থা প্রতিবারই মেলায় অংশ নেয়। অংশগ্রহণের উদ্দেশ্য একটাই— দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীসহ সাধারণ মানুষদের জানানো যে— চোখে না দেখলেও তাদের জন্য রয়েছে ব্রেইল পদ্ধতির বই। দৃষ্টিহীনদের জন্য ফরাসি অবিষ্কারক লুই ব্রেইলের ‘ব্রেইল বই’ বিষয়ে অনেকেই জানেন না বা সচেতন নন। গ্রন্থমেলায় অংশ নিয়ে স্পর্শ সে ধরনের বই সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে নিয়োজিত। পাশাপাশি তারা দৃষ্টিহীনদের জন্য ৩৬টি ব্রেইল বই দিচ্ছে। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা লেখিকা নাজিয়া জাবীনের সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের। তিনি বলেন, বইমেলা কি শুধুই ছাপার বইয়ের জন্য? যারা চোখে দেখতে পান তাদের জন্যই কি এই মেলার অায়োজন? কে দেবে এর উত্তর! বড় বড় সাহিত্যকর্ম প্রতিবছরই হচ্ছে, এর কত শতাংশ দৃষ্টিহীন ব্যক্তিরা পড়তে পারছেন! তাদের জন্য প্রকাশনীগুলো এবং বাংলা একাডেমি কিছুই কি করতে পারে না?

তিনি বলেন, আমাদের সংগঠন স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনার কাজ সমাজে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের হাতে বই তুলে দেওয়া। আমরা স্বল্প পরিসরে সে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। দৃষ্টিহীনরা ব্রেইলে কাটাকাটা অক্ষরে পড়েন; আমরা সাধারণ বইকে সে পদ্ধতিতে প্রকাশ করছি। তবে একটি ছোট্ট সংগঠন দিয়ে এ প্রকাশনার উন্নতি সম্ভব নয়। এগিয়ে আসা দরকার নামকরা প্রকাশনীগুলোকে।

নাজিয়া জাবীন আরও বলেন, ২০১১ সাল থেকে বইমেলায় অংশ নেওয়া। একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এতোগুলো স্টলের মধ্যে কোথাও গিয়ে তার বই পাচ্ছেন না, খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে। এটি কি তার অধিকার হনন নয়? ধরা যাক অধিকারের প্রশ্ন বাদ, এর যে কী কষ্ট তা কি কেউ বোঝেন!

‘তারা অন্তত আমাদের এখানে এসে একটি হলেও বই হাতে তুলতে পারেন সে প্রচেষ্টা নিয়েই মেলায় আসা। এ বছর স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনা থেকে ৯টি নতুন বই বেরিয়েছে। যার মধ্যে বাংলা একাডেমির সহায়তায় সৈয়দ শামসুল হকের লেখা ‘বঙ্গবন্ধুর বীর গাঁথা’ বইটি উল্লেখযোগ্য,’ যোগ করেন তিনি। এছাড়া স্পর্শ থেকে ব্রেইল পদ্ধতিতে প্রকাশিত মোট বই সংখ্যা ৩৭টি।

প্রশ্ন ছিল বড় বড় প্রকাশনীগুলো এই পদ্ধতিতে বই প্রকাশে আগ্রহী হচ্ছে না কেন, উত্তরে তিনি বলেন, যারাই স্টল নেবে তাদের জন্য বাধ্যতামূলক করে দিতে হবে যেন অন্তত একটি করে ব্রেইল বই প্রতিবছর জমা দেন তারা। নয়তো যাদের স্টল নয়, প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ তাদের জন্য এটি প্রাথমিকভাবে বাধ্যতামূলক হোক- তাহলেই সবাই আগ্রহী হবেন। তখন কমে অাসবে বৈষম্য। এছাড়া ব্রেইল বই করায় খরচ একটু বেশি- সেটিও অনীহার অন্যতম কারণ হতে পারে।

প্রকাশকরা লাভই করতে চান শুধু, সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গাতেও আসতে হবে তাদের, মত দেন নাজিয়া জাবীন।

স্পর্শের স্টলে বসে বই পড়ছিলেন সেই রেহানা। তার কণ্ঠে ফুটে ওঠে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হয়েও হার মানতে না শেখার দৃঢ়তা। পড়ছেন ইডেন মহিলা কলেজে সমাজ বিজ্ঞানে মাস্টার্স শেষবর্ষে। তিনি বাংলানিউজকে বললেন, খুব কষ্ট হয় যখন সমাজে অবহেলা দেখি। আমি তো করুণা চাই না। তবুও কেন অবহেলা সহ্য করতে হবে!  সারামেলা ঘুরে আপনি আমাদের জন্য একটিও বই খুঁজে দিতে পারবেন! তা পারবেন না। তবে কি নতুন যেসব বই এবার এলো, তা আমরা পাবো না পড়ার জন্য- প্রশ্ন রাখেন রেহানা।

তার পাশে থাকা রীপা তাবাসসুম বলেন, চোখে দেখি না বলে মনে শিক্ষার আলো নেই এটি কিন্তু ভুল। সমাজ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বদলে যাচ্ছে কিন্তু মানুষের এসব ধ্যানধারণা বদলাচ্ছে না।

ফেব্রুয়ারির ২০ দিনে মেলায় ২১শ'র বেশি নতুন বই এসেছে। কিন্তু যার একটিও নয় দৃষ্টিহীনদের জন্য! অথচ বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতির (বিপিকেএস) তথ্যানুযায়ী, দেশে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের সংখ্যা আনুমানিক ২ শতাংশ।

এ বিষয়ে প্রশ্ন ছিল প্রকাশকদের প্রতিনিধি অন্বেষা প্রকাশনের প্রধান নির্বাহী মোহাম্মাদ শাহাদাত হোসেনের কাছে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, সরকার যদি এ বিষয়ে সহযোগিতা করতো তবে আমি কেন ছোট-মাঝারি সব প্রকাশনাই ব্রেইলে বই প্রকাশ করতে পারতো। বছরের নতুন প্রকাশিত সেরা বইটিকে ব্রেইল করাই যায়। কিন্তু সবার সমন্বিত উদ্যোগ এক্ষেত্রে প্রয়োজন।

শাহাদাত হোসেন বলেন, আমরা চাইলেও অনেক সময় সময়-সুযোগ হয়ে ওঠেনি। আসলে অন্য বইয়ের তুলনায় এ ধরনের বইতে সময় বেশি দরকার। তবে আমি মনে করি এতোদিন যে ভুল হয়েছে, তা কাটিয়ে আগামীবার থেকে প্রতি মেলায় সবার একটি করে ব্রেইল বই করা উচিত।

তিনি বলেন, আমি নিজেও করবো, কথা-বার্তা হয়েছে। এ বছর শুধু সময়ের অভাবে পারিনি। আগামী বইমেলায় অন্বেষা থেকে একটি ব্রেইল বই থাকবে বলে আশা রাখি। শুধু আমি নয়, অন্য প্রকাশকরাও যেন অন্তত একটি করে ব্রেইল বই করেন, সে আহ্বান জানাবো।

ব্রেইল বই নিয়ে কাজ করা লেখক-প্রকাশক মফিদুল হকের কাছে জানতে চাওয়া হয় এই বই প্রকাশে আমাদের দুর্বল অবস্থানের বিষয়ে। উত্তরে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, একটা সময় আমাদের ‘সাহিত্য প্রকাশ’ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়, সঙ্গে ছিল স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনা সংস্থা। সে কাজের সমন্বয়ে ১০/১২টি বই প্রকাশ পেয়েছে। আসলে এই বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটিতে যতদূর শুনেছি আলোচনা হয়েছে। আশা রাখি ধীরে ধীরে অন্য প্রকাশনীগুলোও এগিয়ে আসবে।

দৃষ্টিহীনদেরও বইপড়ার অধিকার অাছে উল্লেখ করে মফিদুল হক বলেন, তাদের সে অধিকার-আশা-ভরসা নষ্ট করতে পারি না। একটি উদাহরণ দেই- দক্ষিণ অাফ্রিকায় সংবিধান ব্রেইলে লেখা, কিন্তু আমাদের তো নেই! এই দায় রাষ্ট্র-প্রকাশক সবাইকেই নিতে হবে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান ও সমাজনীতি গবেষক মেজবাহ কামাল বাংলানিউজকে বলেন, দৃষ্টিহীন বা অন্ধদের জন্য বই প্রকাশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি বিষয়। সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে প্রকাশনীগুলোর উদ্যোগ নেওয়া দরকার। তারপরে সরকারি কার্যক্রম, মনিটরিং থাকতে হবে। এমনকি রাষ্ট্র এবং বড় বড় প্রকাশনা সংস্থা একত্রে এনিয়ে কাজ করতে পারে।

‘আমি প্রত্যাশা করবো এ বিষয়টি শুধু মুখে বলে নয়, কার্যত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারণ একটি শ্রেণির মানুষের অধিকার হরণ করে রাষ্ট্র পরিচালিত হতে পারে না,’ যোগ করেন মেজবাহ কামাল।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৬
আইএ/আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।