ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বইমেলা

একুশের চেতনায় উদ্দীপ্ত মেলা

সৈয়দ ইফতেখার আলম, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৬
একুশের চেতনায় উদ্দীপ্ত মেলা ছবি: জি এম মুজিবুর/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে: ‘একটি অসাধারণ আত্মত্যাগ কীভাবে ইতিহাস হয়ে ওঠে ও চিরকালের ইতিহাসে হয় রূপান্তরিত; একুশ তার এক অনন্য নজির। বাঙালির চেতনায়, শিল্প-সত্তায় একুশ বারবার নতুনতর দিগন্তের উন্মোচন ঘটায়।

নিয়ে আসে প্রকৃত আলোড়ন-প্রেরণা। যা প্রকাশ খোঁজে ভাষায়, যে ভাষার জন্য একুশ পেয়েছে অবিস্মরণীয়তা। রক্তের পথ পেরিয়েই একটা ‘জাতি’ হয়ে উঠে। খুঁজে পায় তার জাতীয়-সত্তা। একুশের শহীদেরা খুলে দিয়েছেন সে রক্ত-রাঙা রাজপথ। সে রাজপথ আজ জোয়ারের; মাথা নত না করার অনন্য প্রয়াসের। ’

শনিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) সারাদিনের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় যেনো সেই চেতনায় উদ্দীপ্ত জনসমাগমেরই প্রকাশ পাওয়া গেলো। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র-টিএসসির মোড় থেকে দোয়েল চত্বরের রাজপথ, পুরো বইমেলাতেই এদিন ছিলো মানুষের উপস্থিতি। এদিনের মেলার চিত্র সাহিত্যিক আবুল ফজলের ওই লাইনগুলোর মতোই মনে-প্রাণে জীবন্ত।

রাত পোহালেই অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। পুরো মাসজুড়ে যে চেতনায় জ্বলন্ত হয় বাঙালির হৃদয়, এর একটি অখণ্ডিত রূপ দেখা মেলে ২০তম দিনের মেলায়।

আরেকটি বড় বিষয়, এদিন ছিলো সরকারি ছুটির দিন, টানা তিনদিনের ছুটির দ্বিতীয় দিন। সকাল ১১টায় শুরু হওয়া মেলায় সকালে স্বল্প লাইন থাকলেও নিরিবিলি পরিবেশ বিরাজ করে। ছিলো শিশুদের আনাগোনা। দুপুরে রোদের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভিড়ও বাড়তে থাকে। কখনও ভিড়ের ভাটা না থাকা মেলায় বিকেলের পর জোয়ারের শুরু। স্রোতের মতো মানুষ ঢুকে ঘুরে-ফিরে কিনেছেন বই। একাধিক প্রতিষ্ঠানের প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের বিকিকিনিতে চলছে সুবাতাস। মেলার এখন মধ্যগগন, এসময় শুধুই বই নিয়ে বাড়ি ফেরার।

সময় প্রকাশনের প্রধান নির্বাহী ফরিদ আহমেদের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বাংলানিউজকে জানান, যার ভালো বই থাকবে তার বিক্রি এমনিতেই হবে। আর ছুটির দিনগুলো বিক্রির জন্য একটি বড় সুযোগ।

মেলার গত ১৮ দিনে যতো বই বিক্রি হয়নি, কেবল ১৯ থেকে ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তার চেয়েও বেশি বিক্রি হবে বলে মত দেন তিনি।

পরিসংখ্যানের দিক দিয়ে অন্যপ্রকাশের ব্যবস্থাপক তুহিন বলেন, শুক্রবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) ছয় লাখ টাকার মতো বেচা-কেনা হয়েছে। শনিবারও ঠিক তেমনই হলো। আর সবচেয়ে বড় কথা, এদিন মানুষ ঘুরতে কম, কিনতে বেশি এসেছিলেন।

অনন্যা প্রকাশনীর প্রকাশক মো. মনিরুল হক বাংলানিউজকে বলেন, ছুটির দিনগুলোতে পাঁচ লাখের কাছাকাছি বিক্রি হচ্ছে। টানা তিনদিনের ছুটি হয়ে যাওয়ায় আমাদের লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে যাচ্ছি। আশা রাখি, ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে মেলা হওয়ায় এবারের সর্বাধিক বিক্রির রেকর্ড ছোঁবে।

কাকলী প্রকাশনীর কর্ণধার-প্রকাশক এ কে নাসির বাংলানিউজকে বলেন, এবার আমাদের সর্বোচ্চ বিক্রি হলো এই শুক্র ও শনিবারে। তবে আশা তো করি, রোববার মহান একুশের দিনে বিক্রির সব বাঁধ ভাঙবে।

হুমায়ূন আহমেদের গানগুলো নিয়ে একটি বই কাকলী থেকে আসার কথা ছিলো, সেটি কবে আসবে জানতে চাইলে নাসির বলেন, একটু জটিলতায় এবার মেলায় বইটি করতে পারছি না। সব প্রস্তুতি নিয়েও শেষ পর্যন্ত বইটি হলো না। তবে মেলার পরবর্তীতে বইটি প্রকাশ পাবে।

অন্বেষা প্রকাশনীর প্রধান নির্বাহী মোহাম্মাদ শাহাদাত হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, এবার আমাদের নতুন বইই শুধু নয়, পুরাতন বইও খুব বিক্রি হচ্ছে। মেলার এই শেষ সময়ে পাঠকের চাহিদা বেড়েছে, যা বই ও প্রকাশনা শিল্পের জন্য বরাবরই বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

সপরিবারে মেলায় এসে অনেকগুলো বই কিনেছেন পাঠক মো. শাহরীয়ার কবির। তার সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী মাসুমা, দুই ছেলে আহনাফ ও মোহাম্মাদ। তারা কিনেছেন, উপন্যাস ও শিশুসাহিত্য বিষয়ক বই। জানতে চাইলে শাহরীয়ার বলেন, পরিবার নিয়ে মেলায় ঘুরে খুব ভালো লাগলো। দুই সন্তানের বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি হোক, এমনটাই চাই।

আরেক ক্রেতা-পাঠক অগ্রণী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার নাজমুস সাকিব বলেন, বড় বড় প্রকাশনীগুলোর বইই কেনা হয়েছে। কারণ, তাদের পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ ও প্রকাশনা মান অন্যদের তুলনায় অনেক ভালো।

এদিকে, রাত পোহালেই মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। রোববার (২১ ফেব্রুয়ারি) মেলার মূল ফটক খোলা থাকবে সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত।

এই বিশেষ দিনটিকে ঘিরে বাংলা একাডেমির কর্মপ্রস্তুতি বিষয়ে মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান বাংলানিউজকে বলেন, ২১ ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে অনেক লোকসমাগম হয়, এবারও হবে। কিন্তু এবছর মেলার পরিসর বাড়ায় মানুষের কষ্ট হবে না, তারা স্বস্তিতেই ঘুরতে-ফিরতে-কিনতে পারবেন বলে মনে করি।

সকাল ৮টা থেকে চলা ১২ ঘণ্টার মেলায় ধূলাবালি-পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে ডিজি বলেন, এই এলাকা সন্ধ্যা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলে গেছে, আশেপাশে বেশ কিছু রাস্তাও বন্ধ। সুতরাং বইমেলাকে কেন্দ্র করে একটু তো সমস্যা হতেই পারে। কারণ, ঠিক মতো পানি ছিটানো ও গাড়ি চলাচল ব্যবস্থায় কিছুটা ঘাটতি থাকবে। তবুও আমরা সেবা দিতে চেষ্টা চালিয়ে যাবো। আশা করছি, মেলায় আগতদের কোনো সমস্যা হবে না।

মেলায় আরেফিন সিদ্দিক ও আছাদুজ্জামান মিয়া
বিকেলে মোড়ক উন্মোচন করতে মেলায় আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। পরে তিনি মেলা ঘুরে দেখেন।

এর আগে, মেলায় আসেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। এসময় তিনি সন্ত্রাস দমনে কঠোর ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিনয়ী হয়ে পুলিশকে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান।

শনিবারের নতুন বইয়ের তথ্য
বাংলা একাডেমি বলছে, শনিবার গ্রন্থমেলার ২০তম দিনে নতুন বই এসেছে ১৩৭টি। এর মধ্যে যথারীতি কবিতা সবচেয়ে বেশি ৫০টি, এরপর উপন্যাস ২০, গল্প ১১, শিশুতোষ ১০, প্রবন্ধ ০৮, ছড়া ০৬, মুক্তিযুদ্ধ ০৪, জীবনী ০২ ও অন্যান্য বাকিগুলো। ২০ দিনে মোট বই সংখ্যা দুই হাজার ৩শ ৯৬টি; এর ৬৪০টিই কবিতা।

শনিবারের উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে- সময় থেকে আবুল মাল আবদুল মুহিতের গবেষণাগ্রন্থ ইকোনমি অব বাংলাদেশ, অনন্যা থেকে ইমদাদুল হক মিলনের উপন্যাস জিন্দাবাহার, ঘাসফড়িং থেকে আনিসুল হকের শিশুতোষ বই বুবলিদের এক বিকেল, কথা প্রকাশনী থেকে সুজন বড়ুয়ার প্রবন্ধ কেমন হবো কেমন করে, দ্য রয়েল থেকে আলী ইমামের অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র-২।

শনিবার মূলমঞ্চের আয়োজনে যা ছিলো
বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় 'বাংলাদেশে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণ: সমস্যা ও সম্ভাবনা' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন লেখক-গবেষক মফিদুল হক। আলোচনায় অংশ নেন বদিউর রহমান ও গোলাম কুদ্দুছ। সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী।

আলোচকরা বলেন, ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বাঙালির সাংস্কৃতিক সংগ্রাম পরিপূরক হয়েছে রাজনৈতিক সংগ্রামের। ধারাবাহিক সাংস্কৃতিক অভিযাত্রায় বাঙালি জাতিসত্তা ও মূল্যবোধ বিনির্মাণে সংস্কৃতিকর্মীরা পালন করেছেন তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা।

সভাপতির বক্তব্যে কামাল লোহানী বলেন, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সমস্যা যেমন আছে, আছে ব্যাপক সম্ভাবনাও। এখন সময় এসেছে সেই সম্ভাবনাকে খুঁজে বের করার। আর এজন্য চাই জাতি হিসেবে আমাদের গভীর আত্মবিশ্বাস। আমি বিশ্বাস করি, জনগণের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জাগরণই পারে সকল অপশক্তিকে তাড়াতে।

সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ফকির সিরাজের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী’। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ পাঠ করবেন শিশুশিল্পী ফারহান সাদিক খান সামি। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন আব্দুল মতিন (তবলা), শেখ আবু জাফর (বাঁশি), প্রদীপ কুমার কর্মকার (প্যাড) ও আনোয়ার সাহদাত রবিন (কী-বোর্ড)।  

রোববার অমর একুশের অনুষ্ঠান
রোববার (২১ ফেব্রুয়ারি) গ্রন্থমেলা শুরু হবে সকাল ৮টায় ও চলবে যথারীতি রাত ৮টা পর্যন্ত।

মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনে বাংলা একাডেমি বিস্তারিত কর্মসূচি নিয়েছে। এর মধ্যে রাত সাড়ে ১২টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের নেতৃত্বে বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে।

সকাল সাড়ে ৭টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে রয়েছে স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর। এতে সভাপতিত্ব করবেন কবি আসাদ চৌধুরী।

পরে বিকেল ৪টায় অমর একুশে গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে অমর একুশে বক্তৃতানুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা দেবেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। 'আবাসন: বিশ্বে ও বাংলাদেশে’ শীর্ষক একুশে বক্তৃতা রাখবেন সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন। সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

বাংলাদেশ সময়: ২২২২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৬
আইএ/এসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।