ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বইমেলা

একুশের বইমেলায় মানুষের স্রোত

বিশাল পরিধির মেলায়ও ঠাঁই মেলে না!

আদিত্য আরাফাত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৬
বিশাল পরিধির মেলায়ও ঠাঁই মেলে না! ছবি:দীপু মালাকার/ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বইমেলা থেকে: গত বছর বইমেলার পরিসর ছিল আড়াই লাখ বর্গফুট। এবার ৪ লাখ ৭৮ হাজার বর্গফুট জায়গায় অমর একুশে গ্রন্থমেলা চলছে।

মেলার ইতিহাসে এতো বড় পরিসর এবারই প্রথম। পরিধির দিক থেকে বিশ্বে এটিকে রেকর্ড বলছে আয়োজক সংস্থা বাংলা একাডেমি।

বড় পরিসরে হলেও একুশের দিনে মেলায় আগত কেউ কেউ বলেছেন, ‘পরিসরটা যদি আরেকটু বাড়তো!’

এবার সবচেয়ে বড় পরিসরে বইমেলা হলেও অমর একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটিতে লোকসংখ্যা দেখে মনে হলো পরিসর যেনো ছোটই! মেলার দুই প্রান্ত সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং বাংলা একাডেমিতে যেন তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না।

একুশের রীতি অনুসারে রোববার (২১ ফেব্রুয়ারি) মেলার দ্বার খুলে দেওয়া হয় সকাল ৮টায়। সকালে শুরু হওয়া মেলার জনস্রোত তীব্র হয়ে ওঠে সন্ধ্যায়। ভেতরেই শুধু নয়, মানুষের এই স্রোত আছড়ে পড়ে আশপাশের পুরো এলাকায়।

সন্ধ্যার পর মেলায় দর্শনার্থীর ভিড় ছিল লাগামছাড়া। একপর্যায়ে একাডেমি প্রাঙ্গণের প্রবেশমুখে স্থাপিত আর্চওয়ে দিয়ে প্রবেশ করাই কষ্টকর হয়ে পড়ে। মানুষের সারি এতোই দীর্ঘ হয়েছিল যে অনেকেই মেলায় ঢুকতে সাহসই পাননি। এদিকে মেলার প্রবেশমুখে দীর্ঘ লাইন দেখে কাউকে কাউকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সীমানা প্রাচীর টপকিয়ে ঢুকতে দেখা গেছে।

বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শাহবাগ মোড় থেকে পাশাপাশি দুটি লাইন এসে থামে মেলার দুই প্রবেশমুখ বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। অনেকেই অভ্যাসবশত প্রথমেই ঢুকে যান একাডেমি প্রাঙ্গণে। এখানে ঘুরেফিরে যারা বই কিনতে আগ্রহী তারা ছুটে যান উদ্যান অংশে, যেখানে নতুন বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেছেন সৃজনশীল বইয়ের প্রকাশকরা।

শহীদ দিবসকে ঘিরে সবার সাজসজ্জায়ও ছিল একুশের আবহ। যে ভাষায় আমরা কথা বলি, যে বর্ণমালায় আমরা লিখতে পড়তে জানতে শিখেছি সেই বর্ণমালা স্থান পেয়েছে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের পোশাকে। কালো রঙের শাড়ি, পাঞ্জাবি, ফতুয়ায় যেমন ফুটে উঠেছে ভাষা শহীদদের হারানো ব্যথা, ঠিক তেমনিভাবে সাদা বিভিন্ন রংয়ের বড় বড় অ আ ক খ বর্ণগুলো জানান দিচ্ছিলো আমাদের মাতৃভাষার গৌরবময় ইতিহাসের কথা।

ছোট্ট সোনমনিরাও মেলায় এসেছিল বর্ণমালায় অক্ষরে ছাপা পোশাক পরে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেলা পরিণত হয়েছে জনসমুদ্রে। আর সন্ধ্যার দিকেতো একরকম পা ফেলার জায়গা ছিলো না বলা চলে। বিশেষ করে মেলার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অংশে এতো পরিসর থাকার পরও মনে হচ্ছিল কোথাও যেন খালি জায়গা নেই। মেলায় আসার পাশাপাশি পাঠকরা মনের আনন্দে বই কিনতে কার্পণ্য করেননি। হাতে হাতে ছিল নতুন বই।   শুধু শীর্ষস্থানীয় প্রকাশকরাই নয় ছোট ও মাঝারি প্রকাশকনাগুলোতেও ছিল মানুষের ভিড়। এমনকি লিটল ম্যাগ চত্বরটিও জমে ওঠে। পরিবার পরিজন নিয়েও অনেকে এই ছুটির দিনটিতে মেলায় এসেছেন বইয়ের টানে।

শীর্ষস্থানীয় প্রকাশনা সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা জানান, অন্যান্য বারের তুলনায় এবার একুশের দিনে বিক্রি ভালো। তবে বিকেলের দিকে মেলার উভয় অংশে পা ফেলার মতো জায়গা ছিল না। স্টলে স্টলে লাইন দিয়ে বই কিনেছেন আগতরা।

কবিতায় শুরু মেলার সকাল
প্রতিবারই একুশের দিনে বইমেলায় সকালে বাংলা একাডেমির মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান। এবার তার ব্যতিক্রম হয়নি। এদিন সকাল সাড়ে ৭টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর। এতে ১৩০ জন কবি কবিতা আবৃত্তি করেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কবি আসাদ চৌধুরী।

‘বাংলাদেশের অলি আহাদ’ কিনলেন অর্থমন্ত্রী
বিকেল সোয়া ৪টার দিকে বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে এসেছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সঙ্গে ছিলেন তার সহধর্মিণী সাবিয়া মুহিত। প্রথমেই তিনি অ্যাডর্ন পাবলিকেশনের স্টলে যান।   সেখান থেকে তিনি আবদুল হাই শিকদারের ‘বাংলাদেশের অলি আহাদ’ বইটি কেনেন। এরপর তিনি কাকলী প্রকাশনীর স্টলে যান। সেখান থেকে যান অনন্যার স্টলে। স্টলের ভেতর বেশ কিছু সময় অতিবাহিত করেন তিনি।

মেলায় প্রধান বিচারপতির পা
ভিড়-ভাট্টার মধ্যে বিকেলে অমর একুশের গ্রন্থমেলার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এসেছিলেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। প্রথমেই তিনি যুবজাগরণের স্টল পরিদর্শন করেন। এরপর একে একে বিভিন্ন স্টল পরিদর্শন করেন তিনি।

আড়াই হাজার পার হলো বই
একুশের দিনে নতুন বইয়ের সংখ্যা আড়াই হাজার পার হয়েছে। বাংলা একাডেমির তথ্যানুযায়ী রোববার পর্যন্ত গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে মোট ২ হাজার ৬০৬টি বই। বাংলা একাডেমির তথ্যমতে, রোববার মেলায় এসেছে ২১০টি বই। এর মধ্যে গল্প ৩৭, উপন্যাস ৩৫, প্রবন্ধ ১৬, কবিতা ৫৭, গবেষণা ৪, ছড়া ৭, শিশুতোষ ১১, জীবনী ৪, রচনাবলী ১, মুক্তিযুদ্ধ ৫, নাটক ১, বিজ্ঞান ১, ইতিহাস ১, অনুবাদ ২ ও অন্যান্য ২৮।

উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে অন্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত নাসির আলী মামুনের ক্যামেরায় তোলা ছবিতে হুমায়ূন আহমেদের আলোচিত্রের বই ‘অনন্ত জীবন যদি’, নাসরিন জাহানের ‘নিঃসঙ্গতার পাহারাদার’, অনিন্দ্যপ্রকাশ থেকে মফিজ উদ্দিন আহম্মেদের ‘খেয়াল’, চারুলিপি থেকে পান্না কায়সারের ‘পাথরসময়’, ধ্রুবপদ থেকে রীতা ভৌমিকের ‘একাত্তরের সেই গেরিলা-২’, মোহাম্মদ সাদিকের ‘কবিতাসংগ্রহ’, বিদ্যাপ্রকাশ এনেছে মফিদুল হকের ‘বাংলাদেশের গণহত্যা ও ন্যায়রথের অভিযাত্রা’, অনিন্দ্য প্রকাশ এনেছে মোশতাক আহমেদের ‘দেশের প্রতি ভালবাসা’, সময় এনেছে শামসুজ্জামান খানের  ‘বর্ধমান হাউসে রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য প্রবন্ধ, মুনতাসির মামুনের ‘বাংলাদেশ রাজনীতি, ধর্ম ও যৌথ জঙ্গিবাদের বিকাশ’, পুথিনিলয় এনেছে হায়াৎ মামুদের ‘বাংলাদেশ মাতৃভাষার অধিকার’, কথা প্রকাশ এনেছে ফরিদুর রেজা সাগরের ‘ছোটদের পাঁচ,’ শ্রাবণ প্রকাশনী এনেছে আবুল কালাম আজাদের ‘গণমাধ্যম ও আজকের বাংলাদেশ’, অনন্যা এনেছে আনোয়ারা সৈয়দ হকের ‘তুমি আগে যাবে না আমি’, হাসান হাফিজের ‘অভিমান মৃত্যু ও পাথর’, গদ্যপদ্য এনেছে জাকির তালুকদারের ‘মেয়েটি কেবল নিয়তির কাছে গিয়েছিলো’, মোহিত কামালের ‘চোখের ভেতরে চোখ’, পার্ল পাবলিকেশন্স থেকে হারুন-আর-রশিদের ‘পরিবেশবান্ধব সবুজ ব্যাংকিং’।

মূল মঞ্চের আয়োজন
বিকেল ৪টায় অমর গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় অমর একুশে বক্তৃতা ২০১৬। এতে স্বাগত ভাষণ দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। ‘আবাসন: বিশ্বে ও বাংলাদেশে’ শীর্ষক একুশে বক্তৃতা প্রদান করেন সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

অনুষ্ঠানে আলোচকরা বলেন, গত প্রায় দু’দশক ধরে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের নিয়ে সমস্যা-আক্রান্ত। স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশেরও প্রায় এক কোটি লোক বিশ্বের নানা দেশে কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে স্থায়ী ও অস্থায়ী আবাসন গড়ে তুলেছে। অস্থায়ীরা যখন হঠাৎ করে দল-বেঁধে ফিরে আসে তখন আমাদের সামাজিক-অর্থনীতিও সমস্যাকীর্ণ হয়। তাই বিশ্বজুড়ে এই আবাসন সমস্যা আমাদের বোঝা প্রয়োজন।

সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সুদীপ চক্রবর্তীর পরিচালনায় নাট্য সংগঠন, থিয়েট্রেক্স বাংলাদেশ পরিবেশন করে শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী রচিত ভাষা আন্দোলনের অমর নাটক ‘কবর’।

সোমবার মূল মঞ্চের আয়োজন
সোমবার (২২ ফেব্রুয়ারি) গ্রন্থমেলা শুরু হবে বিকেল ৩টায় এবং চলবে রাত ৮টা পর্যন্ত। এদিন বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘শাহ্ আবদুল করিম জন্মশতবার্ষিকী’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন অধ্যাপক আবুল হাসান চৌধুরী। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন ড. ভীষ্মদেব চৌধুরী, শরদিন্দু ভট্টাচার্য, সাইমন জাকারিয়া। সভাপতিত্ব করবেন অধ্যাপক ড. আবুল আহসান চৌধুরী।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৬
এডিএ/আইএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।