ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বইমেলা

‘ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে আছি, ভালোবাসা নিয়ে বাঁচতে চাই’

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৬
‘ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে আছি, ভালোবাসা নিয়ে বাঁচতে চাই’ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ

ঢাকা: ‘জনগণের কাছে যদি শাসন পৌঁছে দেওয়া না যায় সে দেশ কখনো উন্নতি করতে পারে না। দেশের উন্নতি করতে হলে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

স্থানীয় সরকার শক্তিশালী না হলে দেশ কখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে না।   বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ যে দেশ একজন শাসন করে। একজনের পক্ষে ষোল কোটি মানুষের দেশ পরিচালনা করা সম্ভব না। ষোল কোটি মানুষের ষোল কোটি সমস্যা। একজনের পক্ষে তার সমাধান করা সম্ভব না’।
 
মঙ্গলবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘আমার কর্ম আমার জীবন’ এর মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে এ কথাগুলো বলেন জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

রাজধানীর ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ মিলনায়তনে বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন ড. মিজানুর রহমান শেলী।
 
অনুষ্ঠানে এরশাদ বলেন, আমি প্রাদেশিক সরকার গঠনের কথা বলেছিলাম। কিন্তু সেটা হলো না। আমি চলে যাওয়ার পর হলে হতেও পারে। হতে হবেই, পৃথিবীতে কোথাও আমাদের দেশের মতো এ ধরনের সরকার নেই। এটা গণতন্ত্র না। স্থানীয় সরকার শক্তিশালী না হলে গণতন্ত্র শক্তিশালী হয় না। আর গণতন্ত্র শক্তিশালী না হলে দেশের উন্নয়ন টেকসই হয় না।  
 
অনুষ্ঠানে এরশাদ নিজের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনের নানাদিক তুলে ধরে বলেন, ‘জীবনে অনেক কথা বলেছি, অনেক সমাবেশে বক্তৃতা করেছি। আজ নিজের জীবনের কথা বলতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলছি। নিজের জীবন যদি বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখি, আমার জীবন বহুধারায় বিভক্ত। ছাত্র, কবি, সৈনিক, রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রনায়ক ছিলাম’।
 
এরশাদ বলেন, ‘দেশকে রক্ষা করতে গিয়ে রাষ্ট্রনায়ক হলাম। মানুষের কল্যাণে রাজনীতিবিদ হলাম, মানুষকে ভালোবাসার জন্য রাজনীতিবিদ হলাম। একদিকে পেলাম মানুষের ভালোবাসা, আরেক দিকে পেলাম কঠোর-কট্টর সমালোচনা। যেন রাজনীতি করে আমি অন্যায় করেছি’।
 
‘রাজনীতি তো অনেকেই করেন। শিক্ষকরা করেন, চিকিৎসকরা করেন, আইনজীবীরা করেন। তাদের রাজনীতি করতে দোষ নেই, আমি রাজনীতি করেছি দোষ হয়েছে!’
 
প্রকাশিত আত্মজীবনী গ্রন্থের আলোচনায় এরশাদ দাবি করেন, তিনি ক্ষমতায় না এলে এদেশের মানুষ আদি যুগেই থাকতো এবং আধুনিক সভ্যতার মুখ দেখতো না। মধ্য আয়ের দেশ গড়ার কাজ তার হাতেই সৃষ্টি হয়েছিল বলে বলেও দাবি করেন তিনি।
 
তিনি আরও বলেন, ‘আমি উপলব্ধি করেছিলাম, একটি জাতির উন্নয়নের পূর্ব শর্ত হলো যোগাযোগ ব্যবস্থা। আমি উপলব্ধি করেছিলাম, জনগণের উন্নয়নের সবচেয়ে বড় সহায়ক হলো বিদ্যুৎ। তাই আমি যোগাযোগ ব্যবস্থার বিপ্লব ঘটিয়েছি। মানুষের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। সেই উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা আমাদের অর্থনীতিতেও বড় অবদান রেখেছে’।
 
ভাষা আন্দোলনের কথা স্মরণ করে সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালুর দাবি জানিয়ে এরশাদ বলেন, ‘এটা ভাষার মাস। ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে এ জাতি। প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি আসে। শহীদ মিনারে যাই, ফুল দেই, গান গাই। কিন্তু সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার উদ্যোগ কেউ গ্রহণ করেননি। আমিই প্রথম ১৯৮৭ সালে সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু করার আইন পাস করেছিলাম সংসদে। সেখানে বলা ছিল সমস্ত নথিপত্রে বাংলা চালু করতে হবে, সাইনবোর্ড বাংলায় লিখতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে কঠোর শাস্তি হবে’।
 
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এরশাদ বলেন, ‘আমরা শহীদ মিনারে যাই। এ শহীদ মিনার ছিল অসম্পূর্ণ। পাকিস্তানিরা ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল। তারপর কেউ এটিকে সংস্কার করেননি। আমি এসে শহীদ মিনারের পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়েছি’।
 
তার শাসনামলে পহেলা বৈশাখে প্রথম সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল উল্লেখ করে এরশাদ বলেন, ‘আজ আমরা পহেলা বৈশাখ উদযাপন করি। আমিই প্রথম পহেলা বৈশাখে সরকারি ছুটি ঘোষণা করি। এ কথাটা অনেকেই জানেন না। মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ আমি করেছিলাম, মানুষ সেটা ভোলেনি। আমিই প্রথম বঙ্গভবনে কবিতার আসর করি’।
 
‘আমরা রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করি। অনেক সাড়ম্বরে পালন করা হয়। আমিই প্রথম রাষ্ট্রপতি যিনি প্রথম রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন শুরু করি শিলাইদহে। আমিই প্রথম রাষ্ট্রপতি নজরুলজয়ন্তী পালন করি। এর আগে কেউ করেননি। কথাগুলো ছোট্ট হলেও অনেক বড়। কারণ, আমি আমার ভাষাকে ভালোবাসি, কবিগুরুকে ভালোবাসি, জাতীয় কবিকে ভালোবাসি। কিন্তু তাদের সেই মর্যাদা আমরা দিতে পারিনি। দরিরামপুর, শিলাইদহ পড়েছিল, কেউ যাননি। আমিই সেখানে প্রথম যাই এবং আনন্দমুখর হয়ে ওঠে। আজ প্রধানমন্ত্রী যান, রাষ্ট্রপতি যান। কিন্তু তারা ভুলেই যান, এর শুরু হয়েছিল এক সৈনিক রাষ্ট্রপতির সময়ে’।
 
জীবনী গ্রন্থের আলোচনায় বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ টেনে এরশাদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, যার জন্ম না হলে বাংলাদেশ হতো না। তাকে হত্যা করা হলো। আমি প্রথম রাষ্ট্রপতি তার কবরে গিয়ে দোয়া চেয়েছিলাম। তার আত্মার শান্তি কামনা করেছিলাম। বর্তমান সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, আমি কাউকে অসম্মান করিনি। যিনি যেখানে অবদান রেখেছেন, তার স্বীকৃতি আমি দিয়েছি’।
 
প্রকাশিত আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘আমার কর্ম আমার জীবন’ সম্পর্কে সাবেক স্বৈরশাসক এরশাদ বলেন, ‘আপনারা অনেকেই মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে এসেছেন। এ বইয়ের প্রতিটি কথা সত্য কথা। কিভাবে আমি স্বৈরাচার হলাম, কেন স্বৈরাচার হলাম, কেন বলি আমার মতো যদি আরও স্বৈরাচার জন্মগ্রহণ করতো, তাহলে বাংলাদেশ আরও উন্নত দেশ থাকতো?’
 
অনুষ্ঠানে দলীয় নেতাকর্র্মী, সুহৃদদের কাছে প্রশ্ন রাখেন এরশাদ, ‘আমি যে কাজগুলো করেছিলাম এগুলো কি স্বৈরাচারের কাজ? শহীদ মিনারের কাজ শেষ করেছিলাম, সেটা কি স্বৈরাচারের কাজ? পহেলা বৈশাখে ছুটি দিয়েছিলাম, এটা কি স্বৈরাচারের কাজ? রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী শুরু করেছিলাম, স্বৈরাচারের কাজ?’

মিলনায়তন উপচেপড়া দর্শকরা সমস্বরে উত্তর দেন, ‘না’।
 
আলোচনায় উঠে আসে দহগ্রাম, রিনার প্রসঙ্গ। এ সময় আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন এরশাদ। নিজেকে কিছুটা সামলে আবার বলতে শুরু করেন, ‘আমার পনেরটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। আমি কবিতা লিখি সেটাও অন্যায়। আমি সৈনিক মানুষ কেন কবিতা লিখবো? কতো সমালোচনা শুনেছি! কেউ প্রকৃতিকে ভালোবেসে কবিতা লেখেন, কেউ নারীকে ভালোবেসে কবিতা লেখেন, কেউ নদীকে ভালোবেসে কবিতা লেখেন। আমি কি প্রকৃতিকে ভালবাসতে পারবো না? আমি কি কিছুকে ভালবাসতে পারবো না? আমি কি কবিতা লিখতে পারবো না?
 
অনুষ্ঠানে দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দ্যেশ্য করে এরশাদ বলেন, ‘এই বইটাতে অনেক কিছু লেখা আছে। আমার কর্মের কথা তোমরা স্মরণ করো, আমি তোমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবো। আমার তো পাওয়ার কিছু নেই। মানুষ মাত্রই বেঁচে থাকতে চায়, আমি মানুষের ভালোবাসায় বেঁচে থাকতে চাই’।
 
‘গ্রামে-গঞ্জে যাই, মানুষের ভালোবাসায় আমি আপ্লুত হই। আমার পুলিশ লাগে না, গার্ড লাগে না। মানুষের ভালোবাসা আমাকে পরিবেষ্টিত করে রেখেছে, সেখানে কেউ কোনোদিন আঘাত করতে পারবে না। ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে আছি, ভালোবাসা নিয়ে বাঁচতে চাই। “
 
বইটি প্রকাশ করেছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘আকাশ প্রকাশনী’। প্রকাশক আলমগীর সিকদার জানান, প্রায় ৮৮০ পাতার লেখা এবং ১০৪ পাতার ছবিতে পরিপূর্ণ এ গ্রন্থটি অনেক বেশি সমৃদ্ধ। একটি পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী বলতে যা বোঝায় তাই হলো- ‘আমার কর্ম আমার জীবন’।
 
পাঁচ বছর সময় নিয়ে লেখা আত্মজীবনীতে উঠে এসেছে জিনাত মোশাররফের প্রসঙ্গ। এছাড়া রওশন এরশাদ, বিদিশা ও তার নিকটবর্তী অনেকের বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন তিনি। তার শৈশব, কৈশোর, কর্মজীবন ও রাজনৈতিক জীবনের প্রায় সবক’টি ঘটনা উঠে এসেছে এই বইয়ে। বইটির মূল্য ধরা হয়েছে ১২০০ টাকা।
 
অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন সাবেক সচিব মোকাম্মেল হক, লেখক মফিজুল ইসলাম, ছড়াকার রফিকুল হক দাদা ভাই।

বাংলাদেশ সময়: ২০৫৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৬
এমএইচপি/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।