বইমেলা থেকে: বাঙালির অহঙ্কারের অমর একুশে গ্রন্থমেলা এখন বিদায়ের পথে। আর মাত্র তিনদিন পরই সমাপ্তি টানা হবে এ মেলার।
মেলার শেষ শুক্রবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) প্রাণের মেলায় নেমেছিলো বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। তবে এ উচ্ছাসেও ছিলো বিদায়ের বার্তা। বাংলা একাডেমির তথ্য কেন্দ্র থেকে বার বার বলা হচ্ছিলো, ‘আজ মেলার শেষ শুক্রবার, আর মাত্র তিনদিন পরই পর্দা নামবে অমর একুশে গ্রন্থমেলার’।
কর্মব্যস্ত নগর জীবনে যারা আসতে পারেননি এতদিন তাদের উপস্থিতি ছিলো লক্ষণীয়। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি কাদা জলে মাখামাখিতে ক্ষতিগ্রস্ত বিক্রেতাদের কপালে চিন্তার ভাজ পড়লেও শুক্রবার সে ক্ষতি কিছুটা পোষানোর চেষ্টা করেছেন তারা।
শুক্রবার বিকেলে মেলায় উপস্থিত দর্শানার্থীদের বেশিরভাগেরই হাতে ছিলো বই ভর্তি ব্যাগ। শুধু ঢাকার পাঠকরাই নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শেষ মুহুর্তে বইমেলায় ছুটে এসেছেন বিপুলসংখ্যক বইপ্রেমী পাঠকরা।
নজরুল মঞ্চ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্ধানের মঞ্চে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয় বেশ কিছু বইয়ের।
সকালটা শিশুদের বিকেলটা সবার
শুক্রবার ছুটির দিনের সকালেই শিশু-কিশোররা মেলা প্রাঙ্গণ মাতিয়ে তোলে আড্ডা, হৈ হুল্লোরে। বাবা-মায়ের হাত ধরে পুরো মেলা মাঠ ঘুরে বেড়িয়েছে শিশুরা। এক স্টল থেকে অন্য স্টল ঘুরে ঘুরে কিনেছে পছন্দের বই। শেষ শিশুপ্রহরে সকাল থেকে দুপুর- পুরো সময়টাই ছিলো সোনামনিদের। শিশুচত্বর সোহরাওয়ার্দীর বটতলায় হওয়ায় সেখানেই বেশি ভিড় ছিলো।
শিশুদের জন্য শেষবারের বিশেষায়িত এ দিনে মেলার শিশু কর্নারও সেজেছিলো নতুন সাজে। কবিতা, গল্প-ছড়া, উপন্যাসসহ শিশুতোষ বিভিন্ন বই মিলেছে শিশু কর্নারের স্টলগুলোতে।
বাংলা একাডেমির মেলা অংশের প্রবেশদ্বার আনুষ্ঠানিক কিছু কাজে অনেক আগেই খুলে গেলেও নির্ধারিত সময় সকাল সাড়ে ১০টায় খুলে সোহরাওয়ার্দীর গেট। তার আগে থেকেই দীর্ঘ লাইনে দেখা গেছে শিশুদের নিয়ে অভিভাবকদের প্রবেশের অপেক্ষা। পরে একে একে শিশুরা দলবেঁধে গ্রন্থমেলায় ঢুকে পড়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিশুদের কোলাহল বাড়তে থাকে। এক সময় পুরো মেলা প্রাঙ্গণে ছড়িয়ে পড়ে শিশুদের ছোটাছুটি।
এদিকে, অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কণ, সংগীত, সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। এতে
প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান। অনুষ্ঠান পরিচালনায় ছিলেন একাডেমির উপ-পরিচালক রহিমা আখতার কল্পনা।
সিসিমপুরে মাতোয়ারা শিশুরা
শিশুপ্রহর উপলক্ষ্যে শুক্রবারও ছিলো সিসিমপুরের আয়োজন। শিশু চত্বরের বটতলায় সিসিমপুরের শিক্ষামূলক এ আয়োজনে উপস্থিত ছিলো টুকটুকি, হালুম ও ইকরি। তারা সরাসরি নাটিকা-গান ও কসরতে মাতিয়ে তুলছে সোনামনিদের। সকাল ১১টা, দুপুর ১টা এবং সন্ধ্যা ৬টায় তিন ধাপে তাদের এই মজার আয়োজন পরিবেশিত হয়।
এবারের মেলায় শিশুদের জন্য বিশেষ আর্কষণ ছিলো সিসিমপুর বটতলা। সেখানে আনন্দমুখর সময় পার করে শিশুরা। সিসিমপুরের আয়োজন সম্পর্কে সিসিমপুরের বিজ্ঞাপনী সংস্থা ওয়াটারমার্কের প্রধান নির্বাহী জাকারিয়া পলাশ বলেন, ‘শিশুদের বইমেলায় বাড়তি আনন্দ যোগ করার জন্য সিসিমপুর এ আয়োজন করেছে। শিশুদের আনন্দই আসলে আমাদের মূল অর্জন। ’
বিকেলের পর গ্রন্থমেলা হয়ে ওঠে জনসমুদ্র। মানুষ লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে মেলায় প্রবেশ করেছে। কিনেছে পছন্দের লেখকের বই। মেলায় বইপ্রেমী ক্রেতারা যেমন উপচে পড়েছে বইয়ের স্টলগুলোতে তেমনি আড্ডাবাজরাও মাতিয়ে তুলেছিলো মেলাপ্রাঙ্গণ। মেলার ২৬তম দিনে মেলার প্রতিটি প্রাঙ্গণ ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। প্রতিটি স্টলেই দেখা গেছে বইপ্রেমীদের ভিড়।
** অভিজিৎ স্মরণে বিকেল ৪টায় ১ মিনিট নীরবতা
অভিজিৎ স্মরণে দায়সারা নীরবতা পালন
লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়ের প্রথম মৃত্যুবাষির্কীতে দায়সারাভাবে এক মিনিট নীরবতা পালন করেছে গ্রন্থমেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি। সকালের সিদ্ধান্তে বিকেল ৪টা থেকে ৪টা ১ মিনিট পর্যন্ত নীরবতা পালনের কর্মসূচি পালন করে একাডেমি। বিকেলে মেলার মূলমঞ্চের আলোচনা সভার আগে একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান এক মিনিট নীরবতা পালনের কর্মসূচির ঘোষণা দেন।
এরপর মেলামঞ্চের আলোচক ও দর্শক শ্রোতারা দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করে। তবে মূল মঞ্চে ও এর সামনে বাদে একাডেমির কোথাও এ কর্মসূচি পালন করা হয়নি।
প্রকাশকদের অভিযোগ, একাডেমির এ সিদ্ধান্তের কথা তারা জানতেন না। ফলে মেলার মূল অংশ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে কোথাও এ কর্মসূচি পালন করা হয়নি।
এ বিষয়ে জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ওসমান গনি বলেন, আমরা এ বিষয়ে কিছুই জানতাম না। একই কথা জানান, চারুলিপি প্রকাশের হুমায়ূন কবীর, পাঠসূত্রের নির্বাহী প্রকাশক তনুজা আকবর ও ঐতিহ্যের ব্যবস্থাপক আমজাদ হোসেন কাজল।
নীরবতা পালন ছাড়াও মেলার দুই মঞ্চের পাশে কালো দুইটি ব্যানার লাগানো হয়। এতে লেখা ছিলো ‘গত বছরের এই দিনে অভিজিৎ রায়ের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানাই। অবিলম্বে হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও বিচার দাবি করছি’।
গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারির গ্রন্থমেলা থেকে ফেরার পথে টিএসসি সংলগ্ন রাস্তায় অশুভ শক্তির হাতে নৃশংসভাবে খুন হন অভিজিৎ রায়।
তিন হাজার পেরোলো বই
২৬ তম দিনে ৩ হাজার পার করলো বাংলা একাডেমির বই। এদিন পর্যন্ত ৩ হাজার ৩৩টি নতুন বই এসেছে। আর মেলায় শুক্রবার নতুন বই এসেছে ১৯৬টি। উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে পুথি নিলয় এনেছে ইমদাদুল হক মিলনের ‘যত ভালবাসা পাই’ ও ‘মেঘবালিকা, জয়তী এনেছে ওমর ফারুক চৌধুরীর ‘শান্তির বিশ্ব নেতা রাষ্ট্র নায়ক শেখ হাসিনা’, ‘রাষ্ট্র নায়ক শেখ হাসিনার দর্শন’, বেহুলা বাংলা এনেছে মোহতি উল আলমের ‘গ্রেনেড’, অনুপম প্রকাশনী এনেছে হুমায়ূন আহমেদের শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক উপন্যাস’ ও সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা’, বলাকা প্রকাশনী এনেছে শরিফা বুলবুলের ‘বীরাঙ্গনা নয় মুক্তিযোদ্ধা’, আপন প্রকাশ এনেছে ফয়জুল আলম পাপপুর ‘এসো বানান শিখি’, চন্দ্রছাপ এনেছে আনোয়ারা সৈয়দ হকের ‘দশ রঙের ছড়া’, অধ্যাপক ডা. মো. আবদুল রহিমের ‘লজ্জাবতি’।
মূল মঞ্চের অনুষ্ঠান
বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ২০২১ সালের বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। আলোচনায় অংশ নেন ড. খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং রাশিদ আশকারী। সভাপতিত্ব করেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক এ. কে. আজাদ চৌধুরী।
সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে লাবণ্য আহমেদের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘গীতিমালিকা’-এর শিল্পীবৃন্দ তাদের পরিবেশনায় অংশ নেয়। এছাড়া সংগীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী ফকির আলমগীর, আবদুল জাব্বার, তিমির নন্দী, মনোরঞ্জন গোষাল, নমিতা ঘোষ, শিবু রায়, বিশ্বজিৎ রায়, মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন চৌধুরী, শফিউল আলম রাজা, পল্লবী সরকার মালতী এবং আরিফ রহমান।
যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন দেবব্রত চৌধুরী (তবলা), হাসান আলী (বাঁশি), সুমন কুমার শীল (দোতারা), মো. ফারুক (প্যাড), ডালিম কুমার বড়ুয়া (কি-বোর্ড)।
শনিবারের আয়োজন
মেলার ২৭তম দিনে গ্রন্থমেলা শুরু হবে সকাল সাড়ে ১০টায় এবং শেষ হবে যথারীতি রাত ৮টায়। এছাড়া বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ৬ দফার পঞ্চাশ বছর শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ।
আলোচনায় অংশ নেবেন ড. আবুল বারকাত, সুভাষ সিংহ রায় এবং অজয় দাশগুপ্ত। সভাপতিত্ব করবেন ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ। সন্ধ্যায় রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
বাংলাদেশ সময়: ২০১৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৬
এডিএ/এটি