ঢাকা: বাঘের বাচ্চাটা ওই বোতলের ভেতরে কেন, ওর কষ্ট হচ্ছে না? বাবাকে বারবার প্রশ্ন করে যাচ্ছিলো বছর তিনেকের তনু। বাবাও মেয়েকে বুঝিয়ে যাচ্ছে, এগুলো মৃত প্রাণী, রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে বোতলে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
বাইরে মাঘের তীব্র শীত। দুই ভাই বোনের মুখ চোখ বাদে পুরো শরীর গরম কাপড়ে ঢাকা। অবরোধ আর শৈত্যে ক্লান্ত শহরে দুই সন্তানকে নিয়ে মিরপুরের চিড়িয়াখানায় বেড়াতে এসেছিলেন বরিশালের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জামাল উদ্দিন। চিকিৎসার কাজে ঢাকায় এসে অবরোধে আটকা পড়ে নিজ শহরে ফিরে যেতে পারেননি।
ঘুরে ঘুরে বাঘ, সিংহ, হাতি, হরিণ, সাপ, শিপাঞ্জি দেখতে দেখতে তারা চলে এসেছেন প্রাণী যাদুঘরে। সেখানেই সাদের সাথে কথা। রাফাত জানাল, জাদুঘরটি তার খুব ভালো লেগেছে। এখানে এসে দেশি-বিদেশি অনেক পশু, পাখি ও মাছ তারা দেখতে পেয়েছে।
দেশের একমাত্র প্রাণী যাদুঘরটি চিড়িয়াখানার উত্তর-পশ্চিম দিকের শেষ মাথায়, মূল ফটক থেকে অন্তত পাঁচ থেকে সাত মিনিট হাঁটতে হবে। কুড়ি টাকা দিয়ে চিড়িয়াখানার প্রবেশ করার পরও আলাদা করে পাঁচ টাকায় যাদুঘরের টিকিট কাটতে হবে।
চিড়িয়াখানায় বেড়াতে আসা দর্শনার্থীদের ভ্রমণ পরিকল্পনায় প্রাণী জাদুঘরটি সচরাচর থাকে না। তবে ঘুরতে ঘুরতে তারা এখানে এসে পৌঁছালে না ঢুকেও পারেন না। প্রতিদিন প্রচুর দর্শনার্থী জাদুঘরটিতে ঢুকলেও সঠিক সংখ্যা বলতে পারেননি কর্মকর্তারা।
চারপাশে গাছপালা শোভিত দুই কুঠুরির ভবনটি প্রায় পঁচাত্তর হেক্টরের চিড়িয়াখানা থেকে আলাদা বলেই মনে হবে। ফটকে দুইজন ঘোষক রয়েছেন, যারা অবিরত মাইকে হাঁকডাক করে যাচ্ছেন-দেখে যান, দেখে যান, অদ্ভুত সব প্রাণীর বাহারি মেলা। এখানে দেখতে পাবেন দুইশ' চল্লিশ ধরনের প্রাণী। জিরাফ, ডলফিন, লাল পাণ্ডা, কালো বাঘ, সোনালি বাঘ, ১২০ কেজি ওজনের সামুদ্রিক কচ্ছপ, বিশাল নীল তিমি আরো কত কি!
জাদুঘরের দুটি কক্ষের একটিতে স্টাফিং ও ফরমালিনে সংরক্ষিত পশু, পাখি ও জলজপ্রাণী। রয়েছেও উদ্ভিদও। অন্যটিতে অ্যাকুরিয়াম। কক্ষের মাঝে তিনস্তরে সাজানো ফরমালিনে সংরক্ষিত প্রাণী। আর চারপাশে কাচের ঘেরাটোপ দিয়ে রাখা হয়েছে স্টাফিং করা প্রাণী।
মুন্সীগঞ্জ থেকে আসা ছাহেরা খাতুন নামের ষাটোর্ধ এক বৃদ্ধা জাদুঘরটি ঘুরে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি জানতে চান, এসব মৃত পশু, পাখি ও মাছের এমন হুবহু অবয়ব দেয়া হয়েছে কীভাবে? বৃদ্ধার এই সাধারণ প্রশ্নটির জবাব দেয়ার মতো কেউ তখন সেখানে ছিলেন না।
ঢোকার পর প্রথম দৃষ্টিতে এটি জাদুঘর মনে নাও হতে পারে। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের ডিসপেন্সারির মতো থরে থরে সাজানো বোতলে এক মৃতপ্রাণীর জগত। চিড়িয়াখানার এই যাদুঘরে একশ তেপ্পান্নটি প্রাণীর নমুনা (specimen) ও একশ বারোটি স্টাফিং সংরক্ষিত।
প্রাণীর নমুনা বলতে যে কোন প্রাণী, সেটা মাছ, পশু, পাখি কিংবা তার অংশবিশেষ হোক না কেন, সেগুলো সরাসরি ফরমালিনে সংরক্ষণ করা। আর স্টাফিং (stuffing) হলো মৃতপ্রাণীর চামড়া ছাড়িয়ে ট্যানারির মতো বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে পরিষ্কার করে তুলা, রড ও জিআই তার দিয়ে প্রাণীর নিজস্ব অবয়ব বহাল রাখা।
জাদুঘরগুলোতে সাধারণত মেরুদণ্ড প্রাণীরই স্টাফিং করা হলেও অন্যগুলোর স্পেসিম্যান করে রাখা হয়েছে।
চিড়িয়াখানার প্রাণী জাদুঘরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শামীম হোসেন বলেন, চোখের মনিটা যদি কালো হয়, তাহলে কালো মার্বেল, বিড়াল বা বাঘের মতো হলে চোখের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে মার্বেল বসানো হয়। চোখের মনি বড় হলে লাটিম বসানো হয়। মূলত রং মিলিয়ে মার্বেল বসিয়ে চোখ তৈরি করা হয়। যেগুলো কালো ও সাদা চোখ, সেগুলোর মধ্যে কেবল মার্বেল ও তুলা বসিয়ে রং করলেই হয়ে যায়।
মৃতপ্রাণী সংরক্ষণের বিষয়ে আন্তর্জাতিক উপায়ের পাশাপাশি দেশীয় বিভিন্ন পদ্ধতিও কাজে লাগানো হয়েছে। মূলত প্রাণিবিদ্যা সর্বসাধারণকে ধারণা দিতে, বৈজ্ঞানিক কাজে লাগাতে অথবা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে মৃতপ্রাণী বা তার কোন অংশের নমুনা আন্তর্জাতিকভাবে সংরক্ষিত হয়ে আসছে।
প্রাচীনকালে মিশরে প্রাণীকে তার হুবহু অবয়বে অক্ষত রাখতে মমি করা হত। যদিও মমি ও স্টাফিং এক জিনিস না। মধ্যযুগে জ্যোতিষী, ওষুধ, চিকিৎসা সামগ্রী প্রস্তাতকারক ও বিক্রিতারা বিভিন্ন প্রাণী স্টাফিং করে রাখত।
সতেরোশ আটচল্লিশ সালে প্রকাশিত ফ্রান্সের রওমার অঞ্চলে প্রাকৃতিক ইতিহাসের এনসাইক্লোপিডিয়ায় স্টাফিং পদ্ধতিতে পাখি সংরক্ষণের কথা বলা আছে। ফ্রান্স, জার্মানি, ডেনমার্ক ও ইংল্যান্ডে তখন এভাবে পশু, পাখি, জলজপ্রাণী ও উদ্ভিদ সংরক্ষণ করা হত।
আঠার সাইত্রিশ সালে ভিক্টোরিয়া যুগ শুরু হলে স্টাফিং জনপ্রিয় শিল্পে রুপ নেয়। তখন পশু-পাখির স্টাফিং দিয়ে ব্যাপকভাবে গৃহস্থালি সাজানো হত। ১৮৫১ সালে লন্ডনের হাইড পার্কের প্রদর্শনীতে বেশ কয়েক প্রকার পাখির স্টাফিংও ছিল।
চিড়িয়াখানার কিউরেটর ডা. এনায়েত হোসেন বলেন, চিড়িয়াখানায় কোনো প্রাণী মারা গেলে, সেটি যদি দুর্লভ হয়, তাহলে এখানে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। তবে বিরল প্রজাতির মৃতপ্রাণী অন্য কোথাও থেকে দান করা হলেও সেটি সংরক্ষণ করে রাখা হয়।
জাদুঘর থেকে বের হওয়ার পর বা পাশে একটি ছাউনিতে কাচে ঢাকা তিমির বিশাল কঙ্কাল। তিমির এই কঙ্কালটি কয়েকটি খণ্ডে ভাগ হয়ে গেছে। তবে যাদুঘরে ঢোকার পর ডানের টিনের ছাউনিতে শিগগিরই নীল তিমির একটি আস্ত কঙ্কাল নিয়ে আসা হবে বলে জানালেন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শামীম। সেটি এখন প্রদর্শনের জন্যে প্রস্তুত করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, অ্যাকুরিয়ামগুলোতে তেইশ প্রজাতির নয়শ সত্তরটা মাছ রয়েছে। সারা বছরই এসব মাছ সংরক্ষণ করা হয়। সাধারণত শীতকালে অ্যাকুরিয়ামে মাছ ঠাণ্ডায় মারা যায়, তবে এখানে হিটারের ব্যবস্থা থাকায় মাছের মৃত্যু কম হয়।
কর্মকর্তা শামীম হোসেন আরও বলেন, এখানে অনেক বেশি প্রাণীর স্টাফিং আছে। বিভিন্ন প্রাণীর ছবি এঁকে দেয়ালগুলো সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা, অথবা মৃতগাছের পাতা স্টাফিং করে রাখলেও অনেক সুন্দর দেখাত। এসব গাছের ডালের ওপর স্টাফিং করা বানর বা অন্য প্রাণী বসিয়ে রাখলে ভালো হতো। শিশুরা এসে সত্যিকার বানর দেখার মজা পেত।
তবে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় দর্শনার্থীদেরও ঘুরে ঘুরে দেখতে অসুবিধা হচ্ছে। একে অপরের পায়ে লেগে যাচ্ছে, একটু অসতর্ক হলে পরস্পরের শরীরেও ধাক্কাও লাগছে। নিজেরদের অসুবিধার কথা জানিয়ে এক দর্শনার্থী বলেন, এটির জন্য আরও বেশ কয়েকটি কক্ষের দরকার ছিল। এতে প্রদর্শনের পরিবেশ আরও সুন্দর হত।
দেশের একমাত্র হলেও আলাদা কোনো তহবিল নেই প্রাণী জাদুঘরটির জন্যে। চিড়িয়াখানায় বরাদ্দ বাজেট থেকেই কিছু অংশ প্রয়োজন মনে করলে এটির জন্যে খরচ করা হয়। এখানকার জন্যে আলাদা কোনো লোকবল নেই বলেও জানালেন শামীম।
‘চিড়িয়াখানার অন্য শাখা থেকে কর্মকর্তা এনে কাজ এখানে কাজ করানো হয়। ’
দুটি কক্ষের দেখাশুনার জন্যেও দুজন লোকও নেই। এ প্রতিবেদক প্রায় দুই ঘণ্টা কক্ষ দুটিতে অবস্থান করলেও কোনো কর্মচারী দেখতে পাননি।
কর্মকর্তা শামীম অনেকটা আক্ষেপ নিয়ে বলেন, দর্শনার্থীদের অসতর্কতায় কোনো জিনিস নষ্ট হয়ে গেলেও তা দেখার কেউ নেই। সঠিক তত্ত্বাবধান থাকলে এখানে যে সংগ্রহ ছিল, তা দিয়ে জাদুঘরটি আরও ভালোভাবে সাজানো যেত। এজন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ থাকতে হবে।
প্রতি রোববার চিড়িয়াখানায় সাপ্তাহিক ছুটি থাকে। এছাড়া প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত খোলা থাকে বন্দী চিড়িয়াদের এই আবাসস্থল। বিরল ও বিপন্নপ্রায় মৃত পশুপাখি ও জলজপ্রাণী সংরক্ষণের জাদুর ঘরটিতে এ সময়ে দেখে আসতে পারেন।
স্পেসিম্যান করা প্রাণী:
ঢোকার শুরুতেই বাঁয়ে তাকালে চোখে পড়বে মিঠাপানির গ্যাঞ্জেটিক ডলফিন। এরপর একেএকে উল্লেখযোগ্য স্পেসিম্যান করা প্রাণীরা হল, দাঁড়াস সাপ, অজগরের বাচ্চা, মণিরাজ সাপ, ম্যান্ড্রিলের বাচ্চা, ডগফিস, সোনালি সাপ, হায়নার বাচ্চা, মায়া হরিণের বাচ্চা, জোঁক, শাপলপাতা মাছ, উলফ হিরিং, ভল্লুক বিড়ালের বাচ্চা, স্পটেড জেলি ফিস, ভেড়ার বাচ্চা, সিমুলাস মাছ, টালসা মাছ, রিটা মাছ, গণ্ডারের চামড়া, কমন ইল্যান্ড, হাড়গিলার বাচ্চা, পার্শে মাছ, সিমুলাস মাছ, পমপ্রেট মাছ, সিংহের বাচ্চা, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বাচ্চা, মায়া হরিণ, গাইয়ুব মাছ, ব্লাক এনজেল, গেছো বাঘের বাচ্চা, সামুদ্রিক চিংড়ি, সুরমাই মাছ, রাজা কাকড়া, শিম্পাঞ্জির বাচ্চা, উল্লুকের বাচ্চা, চন্দনা মাছ, সাপিবালি গরুর বাচ্চা, লাল লরি, বিদ্যুত মাছ, গেছো শামুক, রূপচাঁদা মাছ, তারা মাছ, ময়না পাখি, কমেট মাছ, কেশোয়ারীর ডিম, হ্যামার হাঙ্গর, জলহস্তির চামড়া, অস্কার।
স্টাফিং করা প্রাণী:
কবুতরের কঙ্কাল, সাম্বার হরিণের শিং, অরিক্সের মাথা, কালোবাস বানর, মিশুক, সিংহের বাচ্চা, শকুন, সিংহী, কালো বাঘ, সাদা রাজহাঁস, কালো বানর, মঙ্গোলিয়ান ফিজ্যান্ট, রাজ ধনেশ, সোনালী বাঘ, চিতা, মালয়েশিয়ান টাপির, টাপির, চামচের মতো ঠোঁটের স্পুন বিল, চশমা বানর, ওয়াটার বাক, সাইবেরিয়ান টাইগার, বিশালাকৃতির ঘড়িয়ালের চামড়া, উলু বানর, হামাদ্রিয়ান বেবুন, পোমা জানোয়ার, কমেট ফিস, বনমানুষ, সামুদ্রিক প্রবাল, মায়া হরিণের মাথা, শকুন, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, জলহস্তি, ম্যান্ড্রিল, শিম্পাঞ্জি, জিরাফ, ব্যাজার, সাদা হনুমান, উদ, ম্যান্ড্রিল, সামুদ্রিক বেবুন, জলহস্তি, মেছো বাঘ, লাল পাণ্ডা, ফ্লাইং স্কুরেল, ওয়াইল্ড বিস্ট, ওয়াটার বাক, ম্যাকাউ উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশ সময়: ০৬০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০১৫