ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জলবায়ু ও পরিবেশ

হাত বাড়ালেই মুঠো ভরা শিম

মাহবুবুর রহমান মুন্না, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩১৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৫
হাত বাড়ালেই মুঠো ভরা শিম ছবি: মানজারুল ইসলাম/ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

খুলনার ডুমুরিয়া থেকে ফিরে: তুমি যদি যাও – দেখিবে সেখানে মটর লতার সনে,
সীম আর সীম – হাত বাড়াইলে মুঠি ভরে সেই খানে।
তুমি যদি যাও সে – সব কুড়ায়ে
নাড়ার আগুনে পোড়ায়ে পোড়ায়ে,
খাব আর যত গেঁঢো – চাষীদের ডাকিয়া নিমন্ত্রণে,
হাসিয়া হাসিয়া মুঠি মুঠি তাহা বিলাইব দুইজনে।



পল্লী কবি জসীম উদ্‌দীনের নিমন্ত্রণ কবিতার পঙ্‌ক্তিগুলোর মতোই খুলনার ডুমুরিয়ায় যেকোনো ক্ষেতে দাঁড়িয়ে হাত বাড়ালে মুঠো মুঠো শিম পাওয়া যাবে। যেখানে এলে মনে হবে শিমের রাজ্যে দাঁড়িয়ে আছেন। ক্ষেত ছাড়াও মাছের ঘেরের ভেড়িতে শিম চাষ করেছেন এলাকার চাষিরা। ফলে মাছ উৎপাদনের পাশাপাশি শিম বিক্রি করে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করছেন তারা।

সরেজমিনে ডুমুরিয়ার চুকনগর, আঠারো মাইল, গুটুদিয়া, খর্ণিয়া এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মাছের ঘের ও জমিতে সারি সারি শিম ক্ষেত। দেখলে মনে হয় শিম ফুল দিয়ে সাজানো বাগান।

শিম চাষিরা বাংলানিউজকে জানান, আগাম জাতের শিম চাষ করা ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় শিমের বাম্পার ফলন হয়েছে।

তারা জানান, এখানকার কৃষকরা প্রতিদিন নিজেদের ক্ষেতের শিম সংগ্রহ করে কোন ফড়িয়া ছাড়াই পাইকারদের কাছে সরাসরি বিক্রি করেন। স্থানীয় বাজার থেকে প্রতিদিন ট্রাক, পিকআপ ভ্যান যোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে শিম সরবরাহ করেন তারা।

শিম ক্ষেতে বসে কথা হয় চুকনগর এলাকার কৃষক মিজানুর রহমানের সঙ্গে। এ সময় তিনি জানান, আগাম জাতের শিম প্রথম যখন বাজারে বিক্রি করেছেন তখন প্রতি কেজি শিম ৯০ থেকে ১০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।

তিনি আরও জানান, অনুকূল আবহাওয়ায় শিমের ভালো ফলন ও উচ্চ মূল্য পেয়ে ফুরফুরে মেজাজে আছেন উপজেলার কৃষাণ-কৃষাণীরা।

গুটুদিয়া এলাকার কৃষক আব্দুস সালাম জানান, কয়েক বছর আগেও এই এলাকায় শুধু বাড়ির আঙিনা ও আশপাশের পতিত জমিতে নিজের পরিবারের চাহিদা মেটাতে শিম চাষ করত বাড়ির মেয়েরাই। অন্যান্য ফসলের চেয়ে লাভজনক হওয়ায় এখন সেই শিমের চাষ বাড়ির আঙিনার গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে মাঠের পর মাঠে। এমন কি মাছের ঘেরেও।

তিনি জানান, সমগ্র ডুমুরিয়ায় মাঠে মাঠে এখন সবুজ শিমের সমারোহ।
বাণিজ্যিকভাবে শিম চাষ করে দারিদ্র্য দূর করে সংসারের স্বচ্ছলতা এনেছেন এসব গ্রামের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খুলনার উপ-পরিচালক আব্দুল লতিফ বাংলানিউজকে জানান, এ বছর খুলনায় ৩শ’ ৯০ হেক্টর জমিতে শিম চাষ পদ্ধতি করা হয়েছে। যার অধিকাংশই ডুমুরিয়া উপজেলায়।

আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ বছর শিমের বাম্পার ফলন হয়েছে বলেও জানান তিনি।

শিমের পরিচিতি
শিম একটি প্রোটিন সমৃদ্ধ শীতকালীন সবজি। এর বিচিও পুষ্টিকর সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। এটি জমি ছাড়াও রাস্তার ধারে, আইলে, ঘরের চালে ও গাছেও ফলানো যায়।

শিম চাষ পদ্ধতি
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও কৃষিবিদদের মতে শিম চাষ পদ্ধতি ও ফলন বাড়ানোর উপায় নিচে উল্লেখ করা হলো।

যে মাটিতে শিম ভালো হয়
দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটিতে শিমের ভালো ফলন হয়।

জাত
দেশে পঞ্চাশটিরও বেশি স্থানীয় শিমের জাত আছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বাইনতারা, হাতিকান, চ্যাপ্টা শিম, ধলা শিম, পুটি শিম, ঘৃত কাঞ্চন, সীতাকুন্ডু, নলডক ইত্যাদি। বারি শিম ১, বারি শিম ২, বিইউ শিম ৩, ইপসা শিম ১, ইপসা শিম ২, একস্ট্রা আর্লি, আইরেট ইত্যাদি আধুনিক উচ্চ ফলনশীল জাত।

চাষ
আষাঢ় থেকে ভাদ্র মাস (মধ্য জুন থেকে মধ্য সেপ্টেম্বর) শিমের বীজ বপনের উপযুক্ত সময়।
 
জমি তৈরি 
১. শিম চাষের আগে জমি খুব ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে তৈরি করে নিতে হবে। জমি ও মাটির অবস্থা বুঝে ৪-৬টি চাষ ও মই দিতে হবে।

২. বসত বাগানে শিম চাষ করতে হলে ৯০ সে.মি. চওড়া ও ২৫ সে.মি. গভীর করে ২-৩টি মাদা তৈরি করতে হবে।

৩. প্রতি মাদায় ৪-৫টি বীজ বপন করতে হবে।

৪. জমিতে চাষের সময় ২ মিটার চওড়া বেড তৈরি করতে হবে।

বীজ বপন
১. প্রতি বেডে ২ থেকে ৩ মিটার দূরে দূরে মাদায় ৪-৫টি বীজ বপন করতে হবে।

২. বীজ কিছুটা গভীরতায় বপন করতে হবে। তাহলে বীজের অঙ্কুরোদগম ভালো হবে এবং পাখি বীজ নষ্ট করতে পারবে না।

সার প্রয়োগ
কৃষকদের মতে গুণগত মানসম্পন্ন ভালো ফলন পেতে হলে শিম চাষের জমিতে যতটুকু সম্ভব জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। মাটি পরীক্ষা করে মাটির ধরণ অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে।

সেচ ও নিষ্কাশন
চাষের সময় জমিতে রসের অভাব হলে প্রয়োজনে সেচ দিতে হবে। বীজ বপনের সময় বৃষ্টি থাকতে পারে। তাই গাছের গোড়ায় যেন পানি না জমে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

ফসল সংগ্রহ
অগ্রহায়ণ থেকে মাঘ (নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি) মাস পর্যন্ত শিম সংগ্রহ করা যায়।

উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ
প্রতি বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমি থেকে প্রায় ১৫০০-৩০০০ কেজি শিম পাওয়া যায়।
 
বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
শিম পেকে গেলে খোসা বাদামি রঙ ধারণ করে শিরাগুলো আরো স্পষ্ট হয়। আঙুলে চাপ দিলে বীজ যদি শক্ত মনে হয় তখন ফসল সংগ্রহ করতে হবে। ভালো ও পুষ্ট গাছ বাছাই করে ফল ছিঁড়ে ভালোভাবে শুকাতে হবে। তাপরপর লাঠি দিয়ে ভালোভাবে পিটিয়ে বা হাত দিয়ে বীজ বের করতে হবে। বীজ যাতে ফেটে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বীজ ২-৩ দিন রোদে শুকিয়ে ঝাড়াই করে ১০% আর্দ্রতায় সংরক্ষণ করতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৩১৮ ঘণ্টা,  ডিসেম্বর ২৩, ২০১৫
এমআরএম/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।