ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জলবায়ু ও পরিবেশ

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে আমাদের জলবায়ু ভাবনা

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০১৭
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে আমাদের জলবায়ু ভাবনা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে বাড়ছে জলোচ্ছ্বাস, ডুববে নিম্নাঞ্চল/ফাইল ফটো

সম্প্রতি জার্মানিতে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তর্জাতিক ফোরাম কনফারেন্স অব পার্টিজের ২৩তম অধিবেশন (কপ-২৩) সম্পন্ন হয়েছে। এ সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের নানা ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। যার মধ্যে ছিল সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধি ও ক্ষুদ্রদ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব।

জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। জলভাগ প্রসারিত হয়ে ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে স্থলভাগ।

প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণ- উভয়ই এর জন্য দায়ী। তবে সমুদ্রে এই উচ্চতা বৃদ্ধি প্রত্যক্ষভাবে দৃশ্যমান নয়। এটি একটি ধীর প্রক্রিয়া। দীর্ঘ সময়ের ভূ-উপগ্রহ চিত্র ও বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমাণের মাধ্যমে এর সত্যতা আজ প্রমাণিত।
 
বিগত আট লাখ বছরের মধ্যে ২০১৬ সালে বায়ুমণ্ডলে নির্গত হওয়া কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। এই প্রবণতা হয়তো ভবিষ্যতেও বহাল থাকবে। যদি তাই হয়, তবে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বরফ গলতে থাকবে। সেই সঙ্গে বর্তমান জলরাশির আয়তনও বাড়বে, যা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট।
 
বিজ্ঞানীদের ধারণা, বর্তমানে যে হারে তাপমাত্রা বাড়ছে, তা অব্যাহত থাকলে এ শতাব্দীর শেষ নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৩৮ ইঞ্চি পর্যন্ত বাড়তে পারে। কিন্তু মেরু অঞ্চলে বা গ্রিনল্যান্ড ও পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকায় যদি বরফের দ্রুত গলন শুরু হয় বা কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তবে এর হার অনেক বেড়ে যাবে।
 
জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যানেলের (IPCC) মতে, এ শতাব্দীর মাঝামাঝি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যদি ১ মিটার বাড়ে, তাহলে বাংলাদেশের অন্তত ১৭ শতাংশ ভূমি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হবে। এতে প্রথমেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশর নিম্নাঞ্চল। এর পর ধীরে ধীরে তা গ্রাস করবে অন্য অঞ্চলকেও। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সমুদ্রগর্ভ যদি ৫ ফুট বা তার কাছাকাছি উঁচু হয়, তবে বাংলাদেশের এক পঞ্চমাংশ এলাকা সমুদ্রে তলিয়ে যাবে এবং তা শুরু হবে নিম্নাঞ্চল থেকে।  

বিগত কয়েক বছরের হিসাব মতে, বঙ্গোপসাগর উপকূলের কিছু এলাকায় এরই মধ্যে এর প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ঢাল সুন্দরবন মারাত্মক ক্ষতির মুখোমুখি হবে। তলিয়ে যাবে এর অনেকাংশ। ইতোমধ্যে সুন্দরবনের ভেতরে অবস্থিত সুপেয় পানির কিছু উৎসে লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়েছে। জীবজন্তুর জন্য যা অশনিসংকেত। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঝড় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে সুন্দরবন আমাদের ঢাল সরূপ।
 
লবণাক্ততার ফলে খাদ্য উৎপাদন ও কৃষিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। বিঘ্নিত হবে খাদ্য নিরাপত্তা। শুধু নিম্নাঞ্চলই নয়, রাজধানী ঢাকাও আশঙ্কামুক্ত নয়। ঢাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ডের মতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে ঢাকাও আক্রান্ত হতে পারে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে ঝুঁকিপূর্ণ ১২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দশম।
 
বাংলাদেশ একটি বিপুল জনসংখ্যার দেশ। দক্ষিণে এটি সাগরবিধৌত। নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হলে এখানকার অধিবাসীরা উদ্বাস্তু হয়ে পড়বে। ভূমিহীন ও জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে পড়বে বিপুল সংখ্যক মানুষ। ফলে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেড়ে যাবে। মাথাপিছু সম্পদ ও কৃষিজমির পরিমাণও কমে যাবে। উদ্বাস্তু সমস্যা তখন দেশীয় সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক রূপ নিতে পারে। ফলে জলবায়ু সমস্যা তখন রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক রূপ নেবে। নিরাপত্তার সংকট দেখা দেবে। প্রশ্ন উঠতে পারে জলসীমা নিয়েও।
 
জলবায়ুর উষ্ণতা বা পরিবর্তনের ফলেই সমুদ্রপৃষ্ঠের এই উচ্চতা বৃদ্ধি। জলবায়ুর পরিবর্তন আমরা রোধ করতে পারবো না। একইভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়াও পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়কারী কাজগুলো পরিহার সম্ভব। এটিই বিশ্বব্যাপী যে জলবায়ু আন্দোলন তার মূল এজেন্ডা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে যেসব নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি হবে, সেগুলো মোকাবিলা করার জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক যৌথ ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার যে আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার তা পূরণে শিল্পোন্নত দেশগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে, জলবায়ু সংকট মোকাবিলা করার সক্ষমতা ও অভিযোজনের ওপর।  

এই অভিযোজন যাতে পরিবেশ, প্রকৃতি ও জীবনযাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। নদী, পলি ও পানি ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিতে হবে। সবুজ অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবেশ সচেতন নাগরিক ও রাষ্ট্রই আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম। শুধু পরিকল্পনা নয়, এক্ষেত্রে বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০১৭
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।