ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জলবায়ু ও পরিবেশ

উজানের ঢলে এবার ফুঁসছে কীর্তিনাশা পদ্মা

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪১ ঘণ্টা, জুন ২২, ২০২২
উজানের ঢলে এবার ফুঁসছে কীর্তিনাশা পদ্মা ফুঁসছে কীর্তিনাশা পদ্মা।

রাজশাহী: বর্ষার শুরুতেই বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে এবার পানি বাড়তে শুরু করেছে পদ্মায়।  

রাজশাহী পয়েন্টে মঙ্গলবার (২২ জুন) সন্ধ্যা ৬টায় পদ্মার পানির উচ্চতা মাপা হয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ মিটার।

আর রাজশাহীতে পদ্মার পানির বিপৎসীমা নির্ধারণ করা রয়েছে ১৮ দশমিক ৫০ মিটার। ফলে উচ্চতার এই গণিত বলছে, এখন বিপৎসীমার ৫ দশমিক ৮৪ মিটার নিচে রয়েছে পদ্মার পানি। এভাবে বাড়তে থাকলে সামনের দিনে বিপৎসীমা ছুঁই-ছুঁই করবে পদ্মার পানি।

এদিকে পদ্মার পানি বাড়তে শুরু করায় নদী ঘেঁষে গড়ে ওঠা শহরে এখনও ভাঙন দেখা না দিলেও রাজশাহীর চারঘাট-বাঘা, পবা ও গোদাগাড়ী এলাকায় এরই মধ্যে ভাঙন আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এবার বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে ফুঁসে উঠছে স্রোতস্বিনী পদ্মা নদী। কয়দিন আগের মরা পদ্মায় আবারও স্রোতের গর্জন শোনা যাচ্ছে। নদীর আনাচে-কানাচে এখনই টইটম্বুর হয়ে উঠছে। তাই এবার সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের আগেই তীরবর্তী মানুষের মধ্যে বাড়ছে ভাঙন আতঙ্ক।  দেশের অন্যান্য নদ-নদীতে পানি বাড়ার সঙ্গে পানি বাড়ছে পদ্মায়ও। তাই বর্ষার শুরুতেই নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন রাজশাহীর এই উপজেলাগুলোয় থাকা পদ্মার পাড়ের ভাঙন শোষিত মানুষ। প্রায় দেড় যুগেরও বেশি সময় থেকে নদীবক্ষে পৈত্রিক ভিটা ও আবাদি জমি হারিয়ে এই তারা এখন নিঃস্ব!

নদী ভাঙনের শিকার এসব মানুষের অভিযোগ, শুষ্ক মৌসুমে এসব পয়েন্টে ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কখনোই স্থায়ী পদক্ষেপ নেয় না। যে কারণে বর্ষা ও ভাদ্র মাসে ফুলে ফেঁপে ওঠে পদ্মা। আর ভাঙনের মুখে পড়ে নদী তীরবর্তী মানুষ। মাইলের পর মাইল জমি, বসতভিটা, দালানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নদীতে বিলিন হয়ে যায়। পদ্মার পেটে সহায় সম্বল হারিয়ে এরই মধ্যে কয়েক হাজার পরিবার বিভিন্ন জায়গায় চলে গেছেন। করেছেন পেশা পরিবর্তন। কেউ আবার জায়গা-জমি হারিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। ভাঙনের কবলে পড়ে অনেকেই হয়েছেন ভূমিহীন। বছর যায়, বছর আসে। কিন্তু পদ্মার আগ্রাসী আচরণ থেকে রক্ষা মেলেনা রাজশাহীর নদীকূলের এই মানুষগুলোর।

এখন রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার ইউসুফপুর ও সদর ইউনিয়নের প্রায় চারটি গ্রামে ভাঙন শুরু হয়েছে। এছাড়া রাজশাহীর বাঘা উপজেলার সর্ব দক্ষিণ পূর্বে থাকা সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন চকরাজাপুরেও ভাঙন দেখা দিয়েছে। বাঘা উপজেলার সীমান্তবর্তী পদ্মা নদীর চরাঞ্চল চকরাজাপুর এখন বর্ষায় পানিতে পরিপূর্ণ। তবে রাজশাহীর চারঘাট ও বাঘা উপজেলা এলাকায় পদ্মা নদীর ভাঙন রোধে ৭২২ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ চলমান আছে। আগামী মৌসুমে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এ কাজ শেষ হলেই ভাঙন রোধ হবে বলছে, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।

পাউবো বলছে, রাজশাহীর চারঘাট উপজেলা ও বাঘা উপজেলায় পদ্মা নদীর বাম তীরের স্থাপনাগুলো প্রতি বছর বর্ষায় আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাই পদ্মা নদীর এই পয়েন্টগুলোয় থাকা বাঁধ ও স্থাপনাগুলোকে ভাঙন থেকে রক্ষায় ওই প্রকল্পের কাজ বছরজুড়েই চলমান থাকে। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে। এটি ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত চলার কথা রয়েছে। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ৭২২ কোটি ২৪ লাখ ২৬ হাজার টাকা। তবে সরকারি প্রকল্পের কাজে টাকা বরাদ্দের জটিলতা লেগেই থাকে। তাই শুষ্ক মৌসুমে কাজে ধীর গতি থাকে।

প্রকল্প কাজের অগ্রগতি প্রশ্নে রাজশাহী পাউবোর সহকারী প্রকৌশলী আব্দুর রশিদ জানান, মৌসুমি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে দেশের অন্যান্য নদীর মত কীর্তিনাশা পদ্মায়ও পানি বাড়তে শুরু করেছে। তবে নদী পাড়ের ভাঙন রোধ প্রকল্পের কাজও চলমান আছে। এই নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। পানি বাড়তে শুরু করায় যেসব এলাকায় নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে প্রয়োজনে সেসব এলাকায় পাউবো বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলবে। তারা পরিস্থিতি মনিটরিং করছেন।

এদিকে পদ্মার পানি হু-হু করে বাড়তে থাকায় ভাঙনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে রাজশাহীর পবা ও গোদাগাড়ী উপজোর নদীর তীরবর্তী এলাকায়ও।

এর আগে, রাজশাহী মহানগর এলাকায় শহর রক্ষা বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছিল ২০১৬ সালে। ওই সময় পদ্মা ঘেঁষে থাকা শ্রীরামপুর পুলিশ লাইন এলাকার বাঁধে তিন মিটার এলাকাজুড়ে ফাটল দেখা দেয়। যদিও তড়িঘড়ি করে জিও ব্যাগ ফেলে সেসময় কোনোভাবে জোড়াতালি দিয়ে বাঁধের ভাঙন ঠেকানো হয়। তবে এরপর শহর রক্ষা বাঁধের ওই অংশে আর সংস্কারের ছোঁয়া লাগেনি। এর ওপর বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকেই এবার বৃষ্টিপাত হওয়ায় বিগত বছরের তুলনায় পদ্মার রাজশাহী পয়েন্টে আগেভাগেই পানি এসেছে। এতে বন্যার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। যদিও গেল ২০ বছরে রাজশাহীতে পদ্মার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে দুই বার। এর মধ্যে ২০০৪ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত টানা ৮ বছর রাজশাহীতে পদ্মার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেনি। কেবল ২০০৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে পদ্মার সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল ১৮ দশমিক ৮৫ মিটার। এরপর ২০১৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে পদ্মা বিপৎসীমা অতিক্রম করেছিল। ওই বছর পদ্মার পানির উচ্চতা দাঁড়িয়েছিল ১৮ দশমিক ৭০ মিটার। এরপর আর এই রেকর্ড ভাঙেনি।

রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) গেজ রিডার এনামুল হক জানান, মূলত গত ১৭ মে থেকে রাজশাহীতে পদ্মার পানি বাড়তে শুরু করেছে। ওইদিন সন্ধ্যা ৬টায় রাজশাহী পয়েন্ট পদ্মা নদীর পানির উচ্চতা মাপা হয়েছিল ৮ দশমিক ৭৫ মিটার। এরপর ২৯ মে পর্যন্ত পানির উচ্চতা ছিল ৯ মিটারের মধ্যে। ৩০ মে পানির উচ্চতা কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৭৪ মিটারে।

এরপর গত ১ জুন সন্ধ্যা ৬টায় ছিল ৯ দশমিক ৮০ মিটার। ওইদিন থেকে পানি আবার পানি কমে ৯ দশমিক ৭৪ মিটার হয়। এরপর ৬ জুন থেকে ২১ জুন পর্যন্ত পানি কেবল বাড়ছেই। এর মধ্যে ৬ জুন সন্ধ্যা ৬টায় ছিল ৯ দশমিক ৮২ মিটার, ১০ জুন সন্ধ্যা ৬টায় ছিল ১০ দশমিক ২৫ মিটার, ১৫ জুন সন্ধ্যা ৬টায় ছিল ১১ দশমিক ২২ মিটার, ২০ জুন সন্ধ্যা ৬টায় ছিল ১২ দশমিক ৩৫ মিটার এবং সর্বশেষ ২১ জুন সন্ধ্যা ৬টায় ছিল ১২ দশমিক ৬৬ মিটার। অর্থাৎ বর্তমানে রাজশাহী পয়েন্টে পদ্মার বিপৎসীমার (১৮ দশমিক ৫০) ৫ দশমিক ৮৪ মিটার নিচ দিয়ে প্রাবাহিত হচ্ছে পদ্মার পানি।

তবে রাজশাহীতে বিপৎসীমা অতিক্রম না করলেও এর কাছাকাছি গেলেই শহর এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। এতে তীরবর্তী মানুষগুলো চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এর আগে, ২০২১ সালের ২০ আগস্ট এই পয়েন্টে পদ্মার পানির উচ্চতা ছিল ১৭ দশমিক ৮৫ মিটার। যোগ করেন গেজ রিডার।

আর পরিস্থিতি যাই হোক এবারও পদ্মার পানি শহররক্ষা বাঁধ অতিক্রম করবে না। কারণ রাজশাহীতে পদ্মার বিপৎসীমা ১৮ দশমিক ৫০ মিটার। আর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বা শহর রক্ষা বাঁধের উচ্চতা ২১ দশমিক ৬৭ মিটার। তাই পদ্মার পানি বাড়লেও বাঁধ নিয়ে এখনই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। রাজশাহীর পাউবো বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শফিকুল ইসলাম শেখ বলেন, পাউবোর পক্ষ থেকে গোটা দেশের নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি ও বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। ফলে সিলেট, নীলফামারী, সিরাজগঞ্জ ও পাবনার বন্যা পরিস্থিতি দেখে রাজশাহীর মানুষও কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। তবে আপাতত বন্যার আশংকা নেই। এই সময় পানি বাড়াটা স্বাভাবিক।  

তবে সাধারণত হঠাৎ করে বেশি বেড়ে গেলে ভাঙন দেখা দেয়। তাই ভাঙন ঠেকাতে পাউবো ১০ হাজার জিও ব্যাগ মজুদ রেখেছেে। প্রয়োজন হলে অবশ্যই দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। যদিও শহর এলাকায়  ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ নেই।  

গেল কয়েক বছর আগে শহরের টি-বাঁধ এলাকার অংশটা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই ওই এলাকায় পানি বাড়ার বিষয়ে তারা নজর রাখছেন। আর রাজশাহীর চারঘাট-বাঘা, পবা-গোদাগাড়ীর যেসব পয়েন্টে পানি বাড়ছে সেসব এলাকার ভাঙন দেখা দিলে তার রোধের আগাম ব্যবস্থা তাদের রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন রাজশাহী পাউবোর এই শীর্ষ কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৮ ঘণ্টা, জুন ২২, ২০২২
এসএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।