তালিবান আফগানিস্তানে পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর দেশটির ক্রীড়া জগতে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দুইভাবেই তালিবান ক্রীড়া-বিরোধী সংগঠন, এমন একটি ধারণা প্রচলিত ছিল।
তালিবান-পুর্ব সময় থেকেই ক্রিকেট আফগানিস্তানের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় খেলা। রশিদ খান, মোহাম্মদ নবিদের মতো ক্রিকেটাররা বিশ্ব দাপিয়ে বেড়িয়েছেন এই ক্রিকেট খেলেই। কিন্তু তালিবান ক্ষমতায় আসার পর দেশটিতে ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়ে। বিশেষ করে মেয়েদের ক্রিকেট খেলার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় বিশ্ব ক্রিকেট থেকেই বিচ্ছিন্ন হওয়ার মতো পরিস্থিতিতে পড়েছিল তারা। তবে সেসব পেছনে ফেলে তালিবান ক্রিকেটকে তাদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য দারুণভাবে ব্যবহার করছে।
এই প্রেক্ষাপটে, ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের অংশগ্রহণ এবং তাদের পারফরম্যান্স নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। নিউজিল্যান্ডের মতো শক্তিশালী দলকে হারিয়ে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় করে দেয় তারা। এছাড়াও গ্রুপ পর্বে নিজেদের চার ম্যাচের তিনটিতেই দাপুটে জয় পেয়ে সুপার এইটে উঠেছে তারা। যেখানে তিন ম্যাচেই প্রতিপক্ষ দলকে তারা ১০০-এর নিচে থামিয়ে দিয়েছে। সুপার এইটে আফগানিস্তান অবশ্য শুরুতেই ভারতের কাছে হেরেছে। এরপর অস্ট্রেলিয়া এবং বাংলাদেশের মতো প্রতিপক্ষের সম্মুখীন হবে তারা।
এবারের বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের সুপার এইটে আসা অনেকের কাছেই বিস্ময়ের। কারণ এর আগে তারা গ্রুপ পর্বই পেরোতে পারেনি। অথচ তালিবান আমলে অনেকটা কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও তারা সেরা সাফল্য পেলো। যদিও গত কয়েক বছর ধরেই ক্রিকেটে আফগানরা শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে।
গত ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপে আফগানিস্তান ঈর্ষনীয় পারফরম্যান্স দেখিয়েছে। ইংল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের বিরুদ্ধে জিতেছে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে। ওয়ানডে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন আস্ট্রেলিয়াকে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে ফেলেও শেষ পর্যন্ত ম্যাচটি হেরে যায় গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের অতিমানবীয় ইনিংসের কাছে।
তালিবানের ক্রিকেটপ্রেমের রহস্য কী?
তালেবানদের ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা নতুন কিছু নয়। ১৯৯০-এর দশকের শেষদিকে এবং ২০০০-এর দশকের শুরুতে যখন তারা প্রথমবার ক্ষমতায় ছিল, তখনও তারা ক্রিকেটকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে, তারা আরও সক্রিয়ভাবে ক্রিকেটকে তাদের শাসনের বৈধতা প্রমাণ করার একটি উপায় হিসেবে ব্যবহার করছে বলে ধারণা করা হয়। আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশগ্রহণ করে তারা বিশ্বমঞ্চে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয় নিয়মিতই।
প্রশ্ন হচ্ছে এই ক্রিকেটপ্রেম কি শুধুই ক্রিকেট খেলাটির প্রতি, নাকি এই খেলা থেকে পাওয়া অর্থ আর জনপ্রিয়তাও বড় কারণ? এবারের বিশ্বকাপের আগে আফগান দলকে কাবুল এয়ারপোর্টে রাজকীয়ভাবে বিদায় জানানোর বিষয়টি অনেকের চোখে পড়েছে নিশ্চয়ই। এ থেকে ধারণা করা যায়, রশিদ-নবিদের কতটা মাথায় তুলে রাখা হয় আফগানিস্তানে। এর পেছনে আর্থিক কারণ তো অবশ্যই রয়েছে।
সারা বিশ্বের বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলে প্রচুর অর্থ আয় করেন আফগানিস্তানের কয়েকজন ক্রিকেটের। যা বৈদাশিক মুদ্রা হিসেবে পায় আফগানিস্তান। পরিমাণ আহামরি না হলেও, যে দেশের সরকারকে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ স্বীকৃতি দেয় না; তাদের জন্য প্রতিটি বৈদাশিক মুদ্রাই গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া আইসিসির কাছ থেকে পাওয়া অর্থও কাজে লাগাতে পারে তালিবান। যদিও দ্বিপাক্ষিক কোনও সিরিজ বা টুর্নামেন্ট নিজেদের ঘরের মাটিতে আয়োজন করতে পারেনি আফগান ক্রিকেট বোর্ড। আইসিসির অনুমোদনও মেলেনি আজ পর্যন্ত। যা সম্ভব হলে হয়তো আর্থিকভাবে আরও লাভবান হতে পারতো আফগানিস্তান।
আর্থিক কারণ তো আছেই, তবে দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রিকেটের ব্যাপক জনপ্রিয়তাও তালিবানের অজানা নয়। তারা জানে, এই ক্রিকেট খেলোয়াড়রা তাদের দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনছেন। যা তালিবানও নিজেদের প্রয়োজনে কাজে লাগাতে পারছে। তালিবানের প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে নেতিবাচক ভাবনা কাজ করে, তা কিছুটা হলেও দূর করছেন ক্রিকেটাররা। যদিও নারী ক্রিকেট নিষিদ্ধ করে অনেকবারই চাপের মুখে পড়েছে তারা। যেমন অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ আফগান পুরুষ দলকে তাদের দেশে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেলতে আমন্ত্রণ জানায় না। যদিও সেখানকার ফ্র্যাঞ্চাজি লিগে নিয়মিতই খেলেন আফগান ক্রিকেটাররা।
তালিবানকে নিয়ে আইসিসির দ্বিধা
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) তালেবানের ক্রিকেট নিয়ে এখন পর্যন্ত দ্বিমুখী অবস্থানেই রয়েছে। একদিকে তারা আফগান ক্রিকেটের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে সমর্থন করতে চায়, কিন্তু অন্যদিকে, শাসনব্যবস্থার সঙ্গে তালিবান যুক্ত থাকায় কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে চলে আইসিসি। আইসিসি একটি স্পষ্ট অবস্থান নিতে চাইছে, কিন্তু রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে এটি একটি জটিল ইস্যু।
আফগানিস্তানকে ক্রিকেট খেলতে দেওয়ায় আইসিসিকে একইসঙ্গে মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সমালোচনা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তালিবানের অধীনে নারীদের ক্রিকেট খেলার সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে, যা একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয়। এই পরিস্থিতিতে, আইসিসি কীভাবে ভারসাম্য বজায় রাখবে তা নিয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
তালিবানের ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা ও আইসিসির দ্বিধা একটি গভীরতর সমস্যা তৈরি করছে। আফগানিস্তানের ক্রিকেটাররা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিভা প্রদর্শন করছে, কিন্তু তাদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত অবস্থায় রয়ে গেছে। আইসিসির জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ তারা ক্রীড়ার মাধ্যমে শান্তি ও সংহতির বার্তা দিতে চায়, কিন্তু একইসঙ্গে নৈতিক এবং সামাজিক দ্বায়িত্বও পালন করতে হবে।
২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের সাফল্য তাদের দেশের জন্য একটি গর্বের বিষয় হলেও, তালিবানের রাজনৈতিক প্রভাব এবং আইসিসির নীতিগত অবস্থান আগামী দিনে আরও তীব্র হবে। এই পরিস্থিতি কিভাবে সমাধান হবে তা এখনও অজানা। তবে এটি নিশ্চিত যে, তালেবানদের ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা এবং আইসিসির দ্বিধা আগামী দিনে আরও বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে।
◑লেখক,
মানবসম্পদ ও উন্নয়নকর্মী