ঢাকা: বদলে যাওয়া টাইগারদের প্রতিটি ম্যাচই এখন উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয় বিশ্বক্রিকেট প্রেমীদের মনের ভেতরে। শেষ ওভার পর্যন্ত বলা যায় না টাইগারদের প্রতিপক্ষের অবস্থা কী হতে পারে।
বৃষ্টির বাধায় ড্র হওয়া প্রথম টেস্টের তৃতীয় দিন পর্যন্ত সফরকারী প্রোটিয়াদের থেকে এগিয়ে ছিল স্বাগতিকরা। চতুর্থ ও পঞ্চম দিনে কোনো বল মাঠে গড়ায়নি। ফলে, দ. আফ্রিকার থেকে ১৭ রান এগিয়ে থাকলেও ড্র মেনে নিতে হয় টাইগারদের। চতুর্থ ও পঞ্চম দিন হাশিম আমলা বাহিনীকে একরকম চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল মুশফিক বাহিনী। প্রোটিয়ারা ঘুরে দাঁড়ানো প্রত্যয় ব্যক্ত করলেও টাইগাররা চ্যালেঞ্জ নিতে ছিল বদ্ধপরিকর।
বৃষ্টির কারণে খেলা মাঠে না গড়ানোয় প্রথম টেস্ট ড্র হলেও বাংলাদেশ এই টেস্ট থেকে পেয়েছে অনেক কিছু। যেখানে অনেক কিছুতেই প্রথম অর্জন টাইগারদের।
পঞ্চমদিনে এসে ৠাংকিংয়ের এক নম্বর দল দ. আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট ড্র করে বাংলাদেশ। শক্তিশালী দলটির বিপক্ষে এই ফলাফলকে বেশ সন্তোষজনকই বলতে হবে। কিন্তু প্রোটিয়ারা কাগজে-কলমে ফেভারিট হলেও আসলেই কি টাইগারদের থেকে এগিয়ে ছিল সফরকারীরা! ব্যাট-বলের লড়াইয়ে অবশ্যই এগিয়ে ছিল বাংলাদেশ।
টাইগাররা সাদা পোশাকে প্রোটিয়াদের এ টেস্টের প্রথম তিনদিন আটকে রেখেছিল। পাঁচদিন পুরো ম্যাচ মাঠে গড়ালে হয়তো অন্যরকম সাফল্য ধরা দিতো বদলে যাওয়া টাইগারদের হাতে। আর এই প্রথম কোনো টেস্টে পঞ্চম দিনের মুখ দেখে টাইগার-প্রোটিয়ারা। এর আগে দু’দলের মধ্যে যে আটটি টেস্ট হয়, তার ছয়টি গড়ায় চতুর্থ দিন পর্যন্ত। আর বাকী দু’টি ম্যাচ সমাপ্ত হয় তিনদিনে।
গত বছরই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পরপর তিনটি টেস্টে জয় পেয়েছে টাইগাররা। পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডেতে দুর্দান্ত সিরিজ শেষ করা বাংলাদেশ এ বছর পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট ড্র করলেও হেরে যায় দ্বিতীয় টেস্টে। ভারতের বিপক্ষে একমাত্র টেস্ট ড্র হয় বৃষ্টির কারণে।
চট্টগ্রাম টেস্টের মধ্য দিয়ে দ. আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্টে সর্বোচ্চ রানের সংগ্রহ গড়ে বাংলাদেশ। অতিথিদের বিপক্ষে দ্বিতীয়বারের মতো লিড নেওয়া বাংলাদেশের আগের সর্বোচ্চ দলীয় স্কোর ছিল ২৫৯ রান। ২০০৮ সালে চট্টগ্রামেই টেস্টে এক ইনিংসে দলীয় এ স্কোর গড়ে টাইগাররা। সে ম্যাচে সফরকারী দল ইনিংস ও ২০৫ রানের জয় পায়। শুধু ইনিংসে সর্বোচ্চ রানই নয়, প্রোটিয়াদের বিপক্ষে এবারই প্রথম এক ইনিংসে একশ ওভারের বেশি ওভার ব্যাটিং করে বাংলাদেশ। এর আগে ২০০২ সালে ৮৭.৫ ওভার ব্যাটিং ২৫২ রান তুলতে পেরেছিল টাইগাররা।
এ টেস্টের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিগত অর্জনে এগিয়ে গেছেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি তিন ফরম্যাটে মোট ৮০০০ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন তিনি। চট্টগ্রাম টেস্টের তৃতীয় দিন প্রথম সেশনে ব্যক্তিগত ৩৪ রানের মাধ্যমে দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে এ মাইলফলক স্পর্শ করেন সাকিব।
সাকিবের আগে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে তিন ফরম্যাটে আট হাজার রান স্পর্শের রেকর্ড গড়েন তামিম ইকবাল। তিন ফরমেটে তার সংগ্রহ ৮ হাজার ৪২৭ রান। আর সাকিবের সংগ্রহ ৮০১৩ রান।
এর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তৃতীয় ওয়ানডে ম্যাচে দুই উইকেট সংগ্রহের মাধ্যমে ওয়ানডে ইতিহাসে চতুর্থ এবং বাংলাদেশের দ্বিতীয় বাঁহাতি স্পিনার হিসেবে ২০০ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড গড়েন সাকিব। ওয়ানডে ক্রিকেটে শ্রীলঙ্কার সনাৎ জয়সুরিয়া, নিউজিল্যান্ডের ড্যানিয়েল ভেট্টোরি এবং বাংলাদেশের আবদুর রাজ্জাকের পর চতুর্থ বাঁহাতি বোলার হিসেবে ২০০ উইকেটের রেকর্ড গড়েন তিনি।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের প্রথম ম্যাচের প্রথম ইনিংসে দারুণ এক কীর্তি গড়েন বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানরা। প্রথমবারের মতো টেস্ট ৠাংকিংয়ের শীর্ষ দলটির বোলারদের পিটিয়ে ব্যক্তিগত হাফ সেঞ্চুরির দেখা পান তিন বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান। এ কীর্তিমান ব্যাটসম্যানরা হলেন- তামিম ইকবাল, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ও লিটন কুমার দাস। ওপেনার তামিম করেন ৫৭, মিডলঅর্ডার ব্যাটসম্যান রিয়াদ তার চেয়ে ১০ রান বেশি (৬৭ রান) এবং লিটন সংগ্রহ করেন পুরোপুরি ৫০। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব ৪৭ রানে আউট হয়ে না গেলে এ কীর্তিতে তার নামও লেখা হয়ে যেতো। এর আগে, প্রোটিয়াদের বিপক্ষে এক ইনিংসে টাইগার ব্যাটসম্যানদের দু’টি হাফ সেঞ্চুরির কীর্তি ছিল।
এছাড়া, দলীয় অর্জনে সাকিব-লিটনের ব্যাটে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে লিড নেওয়া জুটিতে রেকর্ড করে বাংলাদেশ। ৮২ রানের এ জুটির রেকর্ডের পর ব্যক্তিগত ৪৭ রানে সাজঘরে ফেরেন সাকিব। এদিকে, প্রোটিয়াদের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো টাইগারদের শীর্ষ পাঁচ জনের মধ্যে চার জন ২৫ এর বেশি রান করেও রেকর্ড করেছেন।
প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে দারুণ খেলতে থাকা লিটন কুমার দাসকে ভারতের বিপক্ষে সুযোগ দিয়েছিলেন নির্বাচকরা। আর সে সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রথম টেস্টে বেশ ভালোই করেন লিটন। সাদা পোষাকে দ. আফ্রিকার বিপক্ষে ব্যক্তিগত দ্বিতীয় টেস্ট খেলতে নেমে ক্যারিয়ার সেরা রান করে অর্ধশতক হাঁকান তিনি। ১০১ বলে টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম অর্ধশতকের দেখা পান দিনাজপুরের উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান লিটন দাশ।
এমন ব্যাটিংয়ের পর টাইগারদের ব্যাটিংয়ের প্রশংসা করেন দক্ষিণ আফ্রিকার বোলিং কোচ ল্যাঙ্গেভেল্ট। টেস্টের দ্বিতীয় দিন শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বাংলাদেশ দলের ব্যাটসম্যানদের প্রশংসা করে বলেন, তামিম, মাহমুদউল্লাহ ভালো ব্যাটিং করেছে। সাকিব একজন বড় টিম প্লেয়ার। সে দলকে যেকোন জায়গায় নিয়ে যেতে পারে। প্রথম টেস্টের দ্বিতীয়দিন শেষে সফলতার পাল্লা বাংলাদেশের দিকে ৬০ ভাগ এবং ৪০ ভাগ দক্ষিণ আফ্রিকার দিকে আছে বলেও স্বীকার করেন প্রোটিয়া এ বোলিং কোচ।
পাকিস্তানের বিপক্ষে একমাত্র টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ক্রিকেট বিশ্বের নজর কেড়ে ছিলেন সাতক্ষীরার ছেলে মুস্তাফিজুর রহমান। সেই ম্যাচে চার ওভার বল করে ২০ রান খরচায় নিয়েছিলেন বুমবুম খ্যাত শহীদ আফ্রিদি ও মোহাম্মদ হাফিজের উইকেট। ভারতের বিপক্ষেও অভিষেক ওয়ানডেতে বাঁহাতি পেসার দেখিয়েছেন তার প্রতিভার ঝলক। ইনসুয়িং আর অফকাটার দিয়ে ভারতীয় অধিনায়ক ধোনি, কোহলি, রায়নার মত বাঘা বাঘা খেলোয়াড়কে নাজেহাল করে তুলে নিয়েছিলেন উইকেটে। সাদা পোশাকে সুযোগ পেয়ে অভিষেক ম্যাচেই দক্ষিণ আফ্রিকাকে মুস্তাফিজ ভুগিয়েছেন যথেষ্ট।
প্রোটিয়াদের বিপক্ষে অভিষেক টেস্টে জ্বলে উঠে কাটার-কিং খ্যাত মুস্তাফিজ বিশ্ব ক্রিকেটকে জানান দেন, শুধু টি-টোয়েন্টি বা ওয়ানডে নয়, টেস্টেও চমক দেখাতে প্রস্তুত তিনি। অভিষেক টেস্টে অল্পের জন্য তিনি বঞ্চিত হন একটি রেকর্ড থেকে। প্রথম ইনিংসে নিজের ১৪তম ওভারে যদি হ্যাটট্রিক করতে পারতেন তবে ইংল্যান্ডের পেসার মরিস অ্যালম, নিউজিল্যান্ডের স্পিনার পিটার পেথেরিক ও ড্যামিয়েন ফ্লেমিং এর পাশে যুক্ত হতো বাংলাদেশের মুস্তাফিজের নাম। তারা অভিষেক ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেছিলেন।
অভিষেক ম্যাচেই প্রোটিয়া অধিনায়ক হাশিম আমলাকে দিয়ে টেস্ট উইকেট শিকার শুরু করেন ১৯ বছর বয়সী এ তরুণ। এরপরের বলেই জেপি ডুমিনিকে এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলে সাজঘরে পাঠান মুস্তাফিজুর। তার ১৪তম ওভারের তৃতীয় বলটিতে ছিল হ্যাটট্রিকের সুযোগ। ক্রিজে আসা নতুন ব্যাটসম্যান কুইন্টন ডি কক সে বলটিতে রেহাই পেলেও পরের বলেই তার অফস্টাম্প উপড়ে দেন মুস্তাফিজ।
চট্টগ্রাম টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার টপ অর্ডারের প্রথম তিন ব্যাটসম্যানের প্রত্যেকেই ৩০ রানের কোটা পেরোলেও কেউ অর্ধশতক ছুঁতে পারেননি। তাইজুল, সাকিব ও মাহমুদুল্লাহ’র ঘূর্ণি জাদুতে প্রোটিয়াদের প্রথম তিন ব্যাটসম্যানকে সাজঘরে ফিরতে হয় কাঙ্ক্ষিত অর্ধশতকের দেখা না পেয়েই।
প্রথম তিন ব্যাটসম্যান ত্রিশের কোটা পেরুনোর পরেও কারো অর্ধশতক ছুঁতে না পারার এমন ঘটনা এর আগে প্রোটিয়াদের একবারই ঘটেছে। পাঁচ বছর আগে ২০১০ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রোটিয়াদের টপ অর্ডারের প্রথম তিন ব্যাটসম্যান ৩০ রানের কোটা পেরিয়েও কেউই অর্ধশতক তুলে নিতে পারেননি।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২০ ঘণ্টা, ২৫ জুলাই ২০১৫
এমআর