ঢাকা: দরজায় কড়া নাড়ছে কাঙ্ক্ষিত অস্ট্রেলিয়া সিরিজ। লড়াকু টাইগারদের বিপক্ষে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলতে ২৮ সেপ্টেম্বর বিকেলে ঢাকার মাটিতে পা রাখবে তরুণ অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথের দল।
৯-১৩ অক্টোবর চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে সিরিজের প্রথম ম্যাচে সফরকারী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মাঠে নামবে স্বাগতিক বাংলাদেশ, আর ১৭-২১ অক্টোবর ঢাকায়, লেম্যান শিষ্যদের মোকাবেলা করবে হাথুরেসিংহের শিষ্যরা।
সন্দেহ নেই শক্তিমত্তা, মাঠের রণকৌশল এবং শারীরিক যোগ্যতায় টাইগারদের চাইতে বেশ এগিয়ে পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন এই দলটি। শুধু তাই নয়, টেস্ট সিরিজে দুই দলের মুখোমুখি লড়াইয়েও অনেক এগিয়ে তারা। টেস্ট ফর্মেটে বাংলাদেশের সঙ্গে ম্যাচ খেলেছে চারটি, যার কোনটিতে জিততে পারেনি টিম বাংলাদেশ। টেস্টে সবশেষ ২০০৬ সালে চট্টগ্রামে, টাইগারদের বিপক্ষে দুই ম্যাচ সিরিজের টেস্ট খেলে ২-০ তে সিরিজ জিতেছিল অধিনায়ক রিকি পন্টিংয়ের দল। এর আগে, ২০০৩ সালে টাইগারদের বিপক্ষে প্রথম সিরিয়ে অজিদের ২-০ তে সিরিজ জয়ের স্বাদ পাইয়ে দিয়েছিলেন অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ। সেই ধারাবাহিকতা কী এবারও বজায় রাখতে পারবেন তারা?
উত্তরে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাবেক অধিনায়ক ও ম্যানেজার, শফিকুল হক হীরা, বাংলানিউজকে জানান, “গেল বছরের জিম্বাবুয়ে সিরিজ থেকে টিম বাংলাদেশ এক বদলে যাওয়া দলের নাম। নিজেদের পারফরমেন্স দেখিয়ে দলটি এখন এশিয়ার ক্রিকেটের পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে চলেছে”।
তিনি যে বাড়িয়ে বলেননি তার প্রমাণ, ২০১৪’র শেষ নাগাদ নাটকীয় এক পরিবর্তন আসে টাইগার শিবিরে। পুরো বছরজুড়ে জয় খরায় থাকা দলটি অক্টোবর-নভেম্বরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডেতে ৫-০ এ জয়ের পর, টেস্টেও ৩-০ তে বিজয়ী । সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৫‘র বিশ্বকাপে প্রথমবারের মত কোয়ার্টার ফাইনাল। এরপর মে’তে, পাকিস্তানের বিপক্ষে দুই ম্যাচ সিরিজের প্রথম টেস্টে খুলনায়, তামিমের মহাকাব্যিক ২০৬ ও ইমরুলের অনবদ্য ১৫০ রানে পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথমবারের মত টেস্ট ড্র করে লাল-সবুজের দল। পরেরটি অবশ্য ঢাকায় ৩২৮ রানের বড় ব্যবধানে জিতেছিল, ৯২‘র বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। এরপর, জুনে ফতুল্লায় এশিয়ার পরাশক্তি ভারতের বিপক্ষে সিরিজের একমাত্র টেস্টটি ড্র হয় বৃষ্টির বাগড়ায়।
সবশেষ, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হোম সিরিজে দুটি টেস্টই বৃষ্টির চোখরাঙ্গানিতে পণ্ড হলে ১৫তম টেস্ট ড্র এর স্বাদ পায় টাইগার শিবির। তবে, সিরিজ ড্র হলেও টাইগারদের হারানোর কিছু ছিলনা বরং বলতে গেলে সিরিজটি দুহাত ভরে উপহার দিয়ে গেছে মুস্তাফিজুর রহমানের মত বিস্ময় বোলারকে। অভিষেক টেস্টেই এই কাটার বয়, ক্রিকেটে সব সময়ই শক্তিশালী দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তুলে নেন ৪ উইকেট। এই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে খেলতে পারলে তাই অস্ট্রেলিয়াকে ভয় পাবার সঙ্গত কোনো কারণই আর থাকছে না দারুণ ফর্মে থাকা বাংলাদেশের জন্য।
প্রায় ৭ বছর পর দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেলতে বাংলাদেশে সফরে আসছে অস্ট্রেলিয়া। ২০০৮ সালে, সব শেষ দুই দলের মুখোমুখি দেখা হয়েছিল ডারউইনে। তিনম্যাচ সিরিজের ওয়ানডেতে ৩-০ তে জয় পেয়েছিল স্বাগতিকরা।
তবে এশিয়ায় অস্ট্রেলিয়ার সাম্প্রতিক জয়-পরাজয়ের পরিসংখ্যান টাইগারদের অস্ট্রেলিয়া ভীতি কাটিয়ে ওঠার পালে জোর হাওয়া দিচ্ছে। শেষ ৫টি সিরিজ সহ ২০১০ ও ২০১৩ সালে ভারতের মাটিতে হোয়াইট ওয়াশ হওয়া এই দলটি, গেল বছর আমিরাতেও ধবল ধোলাই হয়েছে পাকিস্তানের কাছে। একমাত্র জয়টি এসেছে ২০১১ সালে গলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে।
এবার বাংলা মাটিতে তাঁদের জয়ের সম্ভাবনা কতটুকু? “ এ প্রশ্নের জবাবে শফিকুল হক হীরা বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়া টিমের বেশিরভাগ সিনিয়র ক্রিকেটাররা গেল অ্যাশেজেই অবসরে চলে গেছেন। মাইকেল ক্লার্ক অবসরে, মিচেল জনসন-হ্যাজেলউডের মত পেসাররা আসছেন না, ইনজুরিতে পড়ে সিরিজচ্যুত হয়েছেন সহ-অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নার। এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজ জয় সহজ হবেনা। তবে, স্বাগতিকদের বিপক্ষে কম যাবেন না নতুন নেতৃত্ব হাতে নেয়া স্টিভেন স্মিথও। কারণ তাঁরও আছে সদ্য শেষ হওয়া ইংল্যান্ড সফরে স্বাগতিকদের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জয়ের তাজা অভিজ্ঞতা। এদিকে প্যাট কামিন্স, ক্যামেরুন ব্যানক্রফট, উসমান খাজা ও গ্লেন ম্যাকবসওয়েলের মত নির্ভরশীল ব্যাটমান আর মিচেল স্টার্ক, নাথান লিওঁন, পিটার সিডল ও অ্যানড্রিউ ফিকেটের মত অভিজ্ঞ বোলাররা যে কোন সময় পাল্টে দিতে পারেন ম্যাচের ভাগ্য। পাশাপাশি দলের নবাগতদের আছে ‘এ’ দলের হয়ে সম্প্রতি ভারত সফরের অভিজ্ঞতা যা এশিয়ার কন্ডিশনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। ‘
সত্যিকার অর্থে এই সিরিজে পার্থক্য গড়ে দেবে, অভিজ্ঞতা ও ধৈর্য্য। আর এই বিবেচনায় এগিয়ে আছেন টাইগার অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম, যার রয়েছে ৪৮টি টেস্ট ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা। পক্ষান্তরে অজি অধিনায়ক স্মিথ খেলেছেন ৩৩টি টেস্ট।
অষ্টম টেস্ট জয়ের পথে এ পর্যন্ত ৭টি টেস্ট জয়ী বাংলাদেশ দলের ব্যাটসম্যানদের ধৈর্য্য সহকারেই মোকাবেলা করতে হবে অজি বোলিং তোপ। শুধু তাই নয় দুর্দান্ত দলটির বিপক্ষে বোলিং, ব্যাটিং ও ফিল্ডিং এই তিন বিভাগেই দুর্দান্ত খেলতে হবে।
সম্প্রতি টাইগার ব্যাটিং ও বোলিং লাইনআপে এসেছে নাসির ও লিটন দাসের মত ম্যাচ উইনিংরা। ব্যাটিংয়ে যেমন আছেন সাকিব, তামিম, রিয়াদ, ইমরুল ও মুমিনুলের মত স্তম্ভরা, তেমন বোলিং বিভাগের গুরু দায়িত্বে থাকছেন- রুবেল, মুস্তাফিজ, মোহাম্মদ শহীদ, আরাফাত সানির মত অভিজ্ঞরা। আর নাসিরের চমকপ্রদ স্পিনতো থাকছেই। তবে, তাসকিনের ইনজুরি দলকে কিছুটা হলেও ভাবাচ্ছে।
“এই সিরিজে বোলিংয়ে টাইগারদের মুল শক্তি হিসেবে কাজ করবে স্পিন। উইকেট স্পোর্টিং হবে, তাই স্পিনের সঙ্গে পেসাররাও সুবিধা পেতে পারেন, আর নাম্বার ওয়ান অলরাউন্ডার হওয়ায় সাকিবকে পালন করতে হবে মূল দায়িত্ব-” বললেন শফিকুল হক হীরা।
আপাত দৃষ্টিতে টাইগারদের বোলিংয়ের চাইতে ব্যাটিংকেই এগিয়ে রাখছেন এই সাবেক অধিনায়ক। তবে, প্রিন্স অব কক্সবাজার মুমিনুলের সাম্প্রতিক অফ ফর্ম ভাবাচ্ছে তাঁকে।
সব মিলিয়ে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, নিজেদের কন্ডিশনে সিরিজটি হওয়ায় বাড়তি সুবিধা পাবে স্বাগতিক বাংলাদেশ। তবে কোনভাবেই পিছিয়ে থাকবে না সফরকারীরা। কারণ অধিকাংশ খেলোয়াড় নবাগত হলেও দলটি পুরোদস্তুর পেশাদার। উপরন্তু নিজেদের প্রমাণের জন্য তাদের প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট এ্ই বাংলাদেশ সফর।
তাই টাইগারদের ধারাবাহিক সফলতার প্রমাণ ও তরুণ অজিদের তৃতীয় বাংলাদেশ জয় এই দু’য়ের সংমিশ্রণে গোটা ক্রিকেট বিশ্ব যে জমজমাট একটি টেস্ট সিরিজ দেখতে যাচ্ছে, সেকথা বলার আর অপেক্ষা থাকছে না।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৪ ঘণ্টা, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫
আরআই