ঢাকা: আসছে নভেম্বরে পূর্ণ হচ্ছে বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের ১৫ বছর। টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট খেলে বাংলাদেশ দল।
অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি করে ক্রিকেট বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। তার ব্যক্তিগত ১৪৫ রানে ওপর ভর করে প্রথম ইনিংসে ৪০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করে বাংলাদেশ।
টেস্ট মর্যাদার যথার্থতা প্রমাণে আমিনুল ইসলামের ওই ইনিংসটি এখনো স্মরণ করেন টাইগার-সমর্থকরা।
অভিষেক টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান আমিনুল ইসলাম বুলবুল এখন ঢাকায়। অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমানো জাতীয় দলের সাবেক এ ক্রিকেটার ঢাকায় এসেছেন এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল (এসিসি) লেভেল-৩ কোচিং কোর্সের প্রশিক্ষক হিসেবে।
এসিসিতে দীর্ঘদিন কাজ করার পর এখন কাজ করছেন আইসিসি’র ডেভলপমেন্ট অফিসার হিসেবে।
মঙ্গলবার (০৬ অক্টোবর) মিরপুরে সপ্তাহব্যাপী কোচিং কোর্সের শেষ দিনে বাংলাদেশ ক্রিকেটের কাঠামোসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন বাংলানিউজের সঙ্গে।
টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের ১৫ বছর অতিবাহিত হতে চললেও সামান্য প্রাপ্তিতে খুশি নন তিনি। আমিনুল মনে করেন এ ১৫ বছরে টেস্ট র্যাংকিংয়ে ৬ কিংবা ৭-এ ওঠা উচিত ছিল বাংলাদেশের। এ জন্য দেশে সত্যিকার ক্রিকেট কাঠামো না থাকাকে দায়ী করেছেন তিনি।
প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান আমিনুল ইসলাম বুলবুলের সাক্ষাতকারটি বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য প্রশ্নোত্তর আকারে তুলে ধরা হলো:
বাংলানিউজ: আগে তো এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলে (এসিসি) কাজ করেছেন। এখন কী করছেন?
আমিনুল ইসলাম: এসিসিতে অনেকদিন কাজ করেছি। আমি এখন এসিসিতে নাই। এসিসি থেকে এখন আইসিসিতে ক্রিকেট ডেভলপমেন্ট অফিসার হিসেবে কাজ করছি। আমি ওখানে চীন, হংকং, থাইল্যান্ড, সিঞ্চাপুর আর কুয়েত-এদের যাবতীয় ক্রিকেট উন্নয়নে কাজ করি।
বাংলানিউজ: ওখানে আপনার কাজের ধরণটা কেমন?
আমিনুল ইসলাম: আগে যেমন শুধুমাত্র এশিয়াতে কাজ করতাম, এখন বিশ্বজুড়েই ক্রিকেট ডেভলমেন্টের কাজ করি। মূল কাজ হচ্ছে কোচ তৈরি করা, জাতীয় দলকে সহযোগিতা করা এবং জাতীয় দলকে সামনের দিকেএগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
বাংলানিউজ: বাংলাদেশের ক্রিকেট কতটা ফলো করেন?
আমিনুল ইসলাম: বাংলাদেশের ক্রিকেট সবসময়ই ফলো করি। অনলাইন পোর্টালগুলোতে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সব খবরাখবরই পাই।
বাংলানিউজ: ১৫ বছরে বাংলাদেশের ক্রিকেটের কতটা পরিবর্তন দেখলেন?
আমিনুল ইসলাম: আমার চোখে বাংলাদেশের ক্রিকেট অতটা পরিবর্তন হয়নি এখনো। ওয়ানডেতে আমরা ভালো খেলেছি বেশকিছু ম্যাচ। টেস্ট ক্রিকেটে এখনো ৯ নম্বর দল। আমাদের এ জায়গাটায় এখনো অনেক কাজ করার জায়গা আছে। আশা করেছিলাম, ১৫ বছরে হয়তো টেস্ট র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ ৭ কিংবা ৬ নম্বরে উঠে আসবে।
এছাড়া দেশব্যাপী ক্রিকেটকে আমরা ছড়িয়ে দিতে পারিনি। বিভাগীয় ক্রিকেট সেন্টারগুলোকে আমরা অ্যাকটিভ করতে পারিনি। কোনো টুর্নামেন্ট জেতা কিংবা সিরিজ জেতাই কিন্ত কোনো দেশের ক্রিকেট ডেভলমেন্টের প্রতিচ্ছবি নয়। ইংল্যান্ড কখনো বিশ্বকাপ জেতেনি; তারপরও তাদের ক্রিকেট কাঠামো অনেক শক্তিশালী। আমাদের কাঠামো এখনো ঠিকমতো দাঁড়ায়নি।
বাংলানিউজ: কাঠামো বলতে কি আঞ্চলিক ক্রিকেটের কথা বোঝাচ্ছেন?
আমিনুল ইসলাম: হ্যাঁ। আপনি যদি দেখেন, আমাদের পুরো ক্রিকেটটাই ঢাকা কেন্দ্রিক। আমাদের যে অঞ্চলগুলো হয় যেমন- খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী, সিলেট, রংপুর, চট্টগ্রাম। এদের কিন্ত নিজস্ব কোনো খেলোয়াড় নেই। ওখানে মিরপুর স্টেডিয়াম থেকে নির্বাচকরা টিম বানিয়ে দেয়, সে টিমটা নিয়ে খেলে। আমিতো কখনো দেখি নাই চট্টগ্রাম বনাম ঢাকার খেলায় চট্টগ্রাম থেকে ৫০ জন লোক ঢাকায় খেলা দেখতে আসছে। কিংবা চট্টগ্রাম নিজের প্ল্যানিং, ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে বয়সভিত্তিকে খেলোয়াড় বের করে আনছে। এগুলো আমরা যদি না করি সত্যিকার উন্নতি হবে না। এখানে উন্নতির অনেক জায়গা রয়েছে।
বাংলানিউজ: এসব বিষয়ের সঙ্গে অবকাঠামোগত উন্নয়ন কতটা প্রয়োজন?
আমিনুল ইসলাম: এটা তো সবচেয়ে বেশি জরুরি। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর ভেবেছিলাম অঞ্চলগুলোতে ওয়ার্ল্ডক্লাস ইনডোর করে দেওয়া হবে। আরও প্রায় ১০০টা পিচ তৈরি করে দেবে বিভিন্ন দেশের ভালো মাটি এনে। কিছুই করা হয়নি। সত্যিকার ক্রিকেটের উন্নয়ন সেটা হচ্ছে না। শুধুমাত্র ঢাকা কেন্দ্রিক হচ্ছে সব। অটোমেটিক যেটা হচ্ছে সেটাই।
বাংলানিউজ: তৃণমূলে কি তাহলে ক্রিকেট সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে?
আমিনুল ইসলাম: আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে ক্রিকেট খেলা দেখতে পারছি। খোঁজ-খবর রাখতে পারছি। ক্রিকেট খেলার ব্যবস্থা তো করতে পারছি না। উপজেলা পর্যায়ে আমাদের কাঠামো থাকা উচিত। তৃণমূলে টপ টু বটম একটা কনসেপ্ট তৈরি করে খেলোয়াড় তৈরির ব্যবস্থা করা দরকার। অটোমেটিক যারা আসে তাদের নিয়েই আমরা খেলি। মুস্তাফিজ-সৌম্যরা ভালো খেললো, আবার তিন-চারটা ম্যাচ খারাপ খেললে বাদ দিয়ে দিলাম। আরেকটা সৌম্য-মুস্তাফিজ এলো তাদের খেলালাম। এই পলিসিতে চলছে। ১-৫ টেস্ট খেলা অনেক খেলোয়াড় আমাদের। তারা দীর্ঘ সময় খেলতে পারলো না কেন? আমার মনে হয় কাঠামো থাকাটা খুব জরুরি, যে কাঠামোতে একটা একটা খেলোয়াড় আসবে এবং ১০ বছর বাংলাদেশের হয়ে সার্ভিস দেবে।
বাংলানিউজ: বাংলাদেশ দল প্রসঙ্গে আসা যাক। অস্ট্রেলিয়া সিরিজ স্থগিত হয়ে যাওয়ায় আগামী তিন মাসে আন্তর্জাতিক সিরিজ নেই বাংলাদেশের। এর প্রভাব ক্রিকেটারদের মাঝে পড়বে কিনা?
আমিনুল ইসলাম: সিরিজটা শেষ মুহূর্তে স্থগিত হয়েছে। যেহুতু সিরিজটা পুনরায় করার চেষ্টা চলছে আশা করি যত দ্রুত সম্ভব এর আয়োজন হবে। অজিরা যদি না আসে, ঘরোয়া ক্রিকেট বাড়িয়ে দিতে হবে। খেলার মধ্যে রাখতে হবে ক্রিকেটারদের। এমন তো না খেলা বন্ধ থাকবে। খেলা তো হবেই। ঘরে বাইরে খেলা হবে। কিপ দেম বিজি অল দ্যা টাইম। এটা ক্রিকেট বোর্ডের দায়িত্ব তাদের কিভাবে অ্যাকটিভ রাখবে। যেহুতু সিরিজটা বাতিল হয়নি স্থগিত হয়েছে, সেটাকে সামনে রেখেই অনুশীলন করা উচিত। টিমের যারা ম্যানেজম্যান্ট আছে তাদের দায়িত্ব তাদের মাঠে ধরে রাখা।
বাংলানিউজ: টেস্টে লম্বা সময় ধরে উইকেটে থাকার মানসিকতা কেন তৈরি হচ্ছে না ক্রিকেটারদের মাঝে?
আমিনুল ইসলাম: এটা নির্ভর করছে দেশের ঘরোয়া ক্রিকেট কিভাবে চলছে তার ওপর। এখনো বলা হয় আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেট হচ্ছে ‘পিকনিক’ ক্রিকেট। কোচের এখানে একটা বিশাল দায়িত্ব আছে। একটা খেলোয়াড় যখন পরিণত হয় এবং পরিণত হওয়ার জন্য তার যে লেভেলে শারিরীক, মানসিক বিষয়গুলোকে দেখা হচ্ছে, সে জায়গাটায় মনে হয় একটু দুর্বলতা আছে। আমরা টেকনিক নিয়ে অনেক কাজ করি কিন্ত ক্রিকেটারদের মানসিক উন্নতি নিয়ে তেমন কাজ করি না। যার জন্য পেস বোলাররা অহরহ ইনজুরিতে পড়ছে। ব্যাটিংয়ে যদি উন্নতি করতে হয় লংগার ভার্সন ক্রিকেট যে যত খেলবে তত উন্নতি করবে। ভালো করতে হলে লংগারভার্সন খেলতে হবে। লংগার ভার্সনের কোনো বিকল্প নেই। সেটা স্কুল ক্রিকেট থেকে ফাস্ট ক্লাস পর্যন্ত।
বাংলানিউজ: টেস্টে বাংলাদেশের কিছু অর্জনও আছে। সেগুলোর মধ্যে কোন ম্যাচগুলোকে বিশেষভাবে দেখেন?
আমিনুল: বাংলাদেশের কিছু কিছু টেস্ট ম্যাচের কথা মনে পড়ছে এ মুহূর্তে। ২০০৬ এ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ফতুল্লা টেস্ট, মুলতানে পাকিস্তানের বিপক্ষে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে বার্বাডোজ টেস্ট।
এছাড়া সাম্প্রতিকালে খুলনাতে পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিতীয় ইনিংসে তামিমের ডাবল সেঞ্চুরি, গলে মুশফিকের ডাবল সেঞ্চুরি-এসব ম্যাচগুলো অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য সুখস্মৃতি।
বাংলানিউজ: প্রথম টেস্টে সেঞ্চুরিই শুধু করেননি লম্বা সময় ধরে উইকেটে ছিলেন। মাঠে নামার আগে মাইন্ডসেট কী ছিল?
আমিনুল: বল বাই বল খেলার মানসিকতা নিয়ে মাঠে নেমেছিলাম।
বাংলানিউজ: দীর্ঘদিন এসিসি ও আইসিসিতে কাজ করেছেন আপনি। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা আছে কিনা?
আমিনুল: অবশ্যই আছে। তবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড থেকে কখনোই অফিসিয়ালি আমাকে প্রস্তাব করা হয়নি। কখনো বলা হয়নি আস। কোনো সুনির্দিষ্ট অফার আমাকে করা হয়নি। অফার থাকলে অবশ্যই কোনো একদিন কাজে লাগবো দেশের ক্রিকেটে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭০৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৭, ২০১৫
এসকে/এসএইচ