ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্রিকেট

মাশরাফিকে সরানোই যেন এজেন্ডা!

হুসাইন আজাদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫১ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০১৬
মাশরাফিকে সরানোই যেন এজেন্ডা! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ম্যাচটার আগ পর্যন্তও তিনি বাংলাদেশ দলের ‘জিয়ন কাঠি’ বলে ‘সবার’ কাছে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু ‘তাসকিন-সানি নিষেধাজ্ঞায়’ বিপর্যস্ত বাংলাদেশ অজিদের কাছে হেরে যাওয়ার পরই মুণ্ডুপাত শুরু হলো তার।



ওই ম্যাচটায় বাংলার লড়াকু খেলোয়াড়রা যথাসম্ভব লড়াই করতে সক্ষম হলেও  অধিনায়ককে শূলে চড়ানোর প্রতিযোগিতায় নামলো অস্থির চিত্ত দর্শক। আর আগুনে ঘি ঢালার মতোই ওইসব দর্শকের অস্থিরতাকে আরও উস্কে দিলেন কিছু  জ্ঞানী-গুণী-সুশীল। অতি উৎসাহী ক্রিকেট লিখিয়েরা তো রীতিমতো তার অবসরের প্রশ্নই তুলে বসলেন।

অস্ট্রেলিয়‍ার সঙ্গে ম্যাচের পরবর্তী দু’টি খেলার আগেও ‘অতি উৎসাহী’দের অবসর সংক্রান্ত প্রশ্নে বিব্রত হতে হয়েছে টাইগারদের স্মরণকালের সবচে’ সফল অধিনায়ককে।

‘জিয়ন কাঠি’ থেকে ‘সমালোচিত-প্রশ্নবিদ্ধ-বিব্রত’ মাশরাফি বিন মোর্তজা বিশ্বকাপ শেষ করে দেশে ফিরলেন রোববার (২৭ মার্চ)। ভারতের তিন প্রান্তের তিন শহরে ২০ দিন ছোটাছুটি করে ৭টি ম্যাচ খেলে আসায় বিমানবন্দরে নামার পর চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ ছিলো স্পষ্ট। তবু তিনি শুনিয়েছেন বিশ্বকাপে প্রাপ্তির কথা, দেখিয়েছেন আশার আলো।

আসলে চোখে-মুখের ক্লান্তিকে বিমানবন্দরে আড়াল করে যেভাবে আশার কথা শুনিয়েছেন, ইনজুরি-আঘাতকে জয় করে এভাবেই বাংলাদেশ দলে প্রায় দেড় দশক ধরে আলো জ্বালিয়ে যাচ্ছেন মাশরাফি। বিপজ্জনক বেশ ক’টি অস্ত্রোপচারের পরও বাস্তবতাকে দেশপ্রেমের আবেগ দিয়ে বারবার পরাস্ত করে তিনি ছুটে চলেছেন জাতীয় দলের ঝাণ্ডা নিয়ে। লাল-সবুজের এই ‘ক্ষ্যাপাটে পতাকাধারী’ মাশরাফির হাতে দলের নেতৃত্ব আসার পর পর পুরো বাংলাদেশই যেন হয়ে উঠলো ‘ক্ষ্যাপাটে’, দৌড়াতে শুরু করলো বাঘের গতিতে।

২০১৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত যে বাংলাদেশ ‘হারের বৃত্ত’ থেকে বেরই হতে পারছিল না, সে বাংলাদেশ ২০১৪ সালের নভেম্বর থেকে হয়ে উঠলো অপ্রতিরোধ্য। বিশেষত ওয়ানডে ফরম্যাটে বাংলাদেশের কাছে নাকানি-চুবানি খেতে থাকলো বড় বড় সব দল। যারমধ্যে ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তানও রয়েছে। এই অপ্রতিরোধ্য গতিতে গত বছর ওয়ানডে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার রূপকথা পর্যন্ত রচিত হয়ে যায়। এ বছর খেলা হয়ে যায় টি-টোয়েন্টি এশিয়া কাপের ফাইনালও। যেই পরিসংখ্যানে ৬৮ শতাংশ জয় নিয়ে গতবছর সাফল্যের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে জায়গা করে নেয় বাংলাদেশ।

অথচ, এই মাশরাফিই কিনা মাত্র একটি পরাজয়ে বিদ্ধ হতে থাকলেন দলে থাকার যৌক্তিকতার প্রশ্নবাণে! যদিও ‘তাসকিন-সানি নিষেধাজ্ঞায়’ আড়ালের কলকাঠির পরিচালক বলে অভিযুক্ত ভারতের সুনীল গাভাস্কার ও বোরিয়া মজুমদাররা যখন মাশরাফির অধিনায়কত্ব ও তার দলে থাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তখনই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার জবাব দিয়ে দেন টাইগার ক্রিকেট সমর্থক ও বিশ্লেষকদের অনেকেই।

কিন্তু এই সমর্থক ও বিশ্লেষকদের বড় ক্ষোভের জায়গা, গাভাস্কার-বোরিয়াদের সুরে সুর মিলিয়ে মাশরাফিকে কেন বারবার বিব্রত করছিলেন গুটিকয় সংবাদকর্মী! পাল্লা দিয়ে তারা কেন বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন, মাশরাফি অবসর নেবেন কবে? তাও আবার বিশ্বকাপের একেবারে মাঝপথে, যখন ‘তাসকিন-সানি’কে হারিয়ে মানসিকভাবে প্রায় বিপর্যস্ত বাংলাদেশ?

মাশরাফি ভক্তদের প্রশ্ন, বারবার একটি ম্যাচের ব্যর্থতাকে মনে করিয়ে দিয়ে পরবর্তী দু’টি ম্যাচের আগেই অবসরের প্রসঙ্গ তোলা কি কোনো খেলোয়াড়কে মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয় না? যদি দেয়, তবে কি এটা পুরো টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের অধিনায়ককে মানসিক চাপে রাখার এজেন্ডা নয়? যেই এজেন্ডার অর্ধেক বাস্তবায়ন হয়েছিল তাসকিন-সানিকে নিষিদ্ধ করে?

যদিও বারবার অবসরের প্রশ্ন উত্থাপনকারীরা দাবি করেছেন, মাশরাফি বিভিন্ন সময়েই টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট থেকে অবসরের ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিন্তু সেই ইঙ্গিতের কথা কি তাকে একটি হারের পর মনে করিয়ে দিতে হবে? সে বিষয়ে কি এমন বড় টুর্নামেন্টের মাঝপথে প্রত্যেকটি খেলার আগেই প্রশ্ন করতে হবে? এমন বিব্রতকর প্রশ্নে মাশরাফি ‘পরে’ জানাবেন বললেও তারা কেন বারবার প্রশ্ন করতে লাগলেন?

নড়াইল এক্সপ্রেসের অধিনায়কত্ব ও সমালোচনা নিয়ে জনৈক ক্রিকেট সমর্থকের ভাবনা, দু’তিনটে ম্যাচ হারার পর যদি কারও অধিনায়কত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এবং সেই প্রশ্নের জেরে অধিনায়ক অবসরে চলে যান, তবে রিকি পন্টিংয়ের হাত ধরে অস্ট্রেলিয়ার কখনোই দু’দুটো বিশ্বকাপ জেতা হতো না। মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বে ভারতের জেতা হতো না ওয়ানডে বিশ্বকাপ ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। কারণ, এই চূড়ান্ত সাফল্যের আগেই কয়েক দফায় পারফরম্যান্সে অবনমনের কারণে অবসর নিতে হতো তাদের।

ক্রীড়া বিষয়ক ওয়েবসাইট ক্রিকইনফোর হিসাবে, বিশ্বকাপের গত ৪টি ম্যাচ মিলিয়েও বাংলাদেশ দলের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সফল অধিনায়ক মাশরাফি। ওয়ানডে ফরম্যাটে সাফল্যের বিচারে এই মুহূর্তে তিনিই দ্বিতীয় সেরা অধিনায়ক।

পরিসংখ্যান মতে, ২০০১ সালে অভিষেকের পর ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্টে প্রথম অধিনায়কত্ব করেন মাশরাফি। প্রথম টেস্টেই জিতে যান তিনি, যদিও খেলার মাঝে ইনজুরিতে পড়ে বেশ কিছু দিনের জন্য মাঠ ছেড়েছিলেন তিনি।

একই বছর ওয়ানডেতে অভিষেকের পর মাশরাফি এ ফরম্যাটে অধিনায়কত্ব পেয়েছেন ২০১৪ সালের নভেম্বরে। তারপর থেকে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন ২৮টি ওয়ানডে ম্যাচে। দলকে জিতিয়েছেন ২০টিতে। এ জয়ের হার ৭১.৪২ শতাংশ। আর টি-টোয়েন্টিতে মাশরাফি অধিনায়কত্ব করেছেন ২৩টি ম্যাচে। এরমধ্যে ৪০.৯০ শতাংশ হারে তিনি জয় পেয়েছেন ৯টিতে।

টেস্টের বাইরে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে মাশরাফির চেয়ে অনেক পিছিয়ে তার সাবেকরা। ৪৯ ওয়ানডে ম্যাচে নেতৃত্ব দেওয়া সাকিবের জয়ের (২৩টি ম্যাচ) হার ৪৬.৯৩ শতাংশ। আর ৬৯ ম্যাচে নেতৃত্ব দেওয়া হাবিবুল বাশারের জয়ের (২৯টি ম্যাচ) হার ৪২.০২ শতাংশ। অপরদিকে, টি-টোয়েন্টিতে ২৩টি ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়ে মুশফিকুর রহিমের জয়ের (৮টি) হার ৩৬.৩৬ শতাংশ। যদিও একটি ম্যাচ নেতৃত্ব দিয়ে একটিতেই জয় লাভ করা শাহরিয়ার নাফিসের এক্ষেত্রে শতভাগ সফল।

স্বদেশি অধিনায়কদের বাইরে যদি বর্তমান সাফল্যের বিচারে অস্ট্রেলিয়া, ভারত অথবা দক্ষিণ আফ্রিকা নিয়েও হিসাব কষা হয়, তবু অনেক, বিশেষত ওয়ানডে ফরম্যাটে এগিয়ে আছেন মাশরাফি।

ওয়ানডেতে মাশরাফির ৭১.৪২ শতাংশ হারে জয়ের বিপরীতে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথের জয়ের হার (১৫ ম্যাচ খেলে ১০ ম্যাচে জয়) ৬৬.৬৬ শতাংশ, ভারতের অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির জয়ের হার (১৯১টি ম্যাচ খেলে ১০৪ ম্যাচে জয়) ৫৮.৮৮ শতাংশ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক এবিডি ভিলিয়ার্সের জয়ের হার (৮১ ম্যাচে ৪৭ জয়) ৬০.৮৯ শতাংশ।

যদিও টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে অপরিণত বাংলাদেশকে নিয়ে খানিকটা সংগ্রাম করতে হচ্ছে মাশরাফিকে। সে কারণে এই ফরম্যাটে তার জয়ের হারও অন্য দলের অধিনায়কদের তুলনায় কম। কিন্তু সেটা যে আর কম থাকবে না, তা বলছে এশিয়া কাপে বাংলাদেশ দলের রানার্সআপ হওয়ার অর্জনই।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০১৬
এইচএ/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।