ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্রিকেট

প্রিমিয়ার লিগে দল পাবেন তো জুবায়ের?

সাজ্জাদ খান, স্পোর্টস করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৪৮ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০১৬
প্রিমিয়ার লিগে দল পাবেন তো জুবায়ের?

ঢাকা: প্রিমিয়ার লিগে দল পাবেন তো? প্রশ্ন শুনে একটুও অবাক হলেন না লেগস্পিনার জুবায়ের হোসেন লিখন! আবেগ নয় বাস্তবতা মেপেই দিলেন উত্তর, ‘জানি না ভাই, দল পাব কিনা...। মনের মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে।

বিপিএলে দল পেলাম না। জানি না প্রিমিয়ার লিগেও এমন হবে কিনা! এমনও হতে পারে আমি দল পাইনি। ’

 

গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক ক্রিকেট-বিপিএলে দল পাননি জুবায়ের। অথচ বিপিএল শুরুর কয়েকদিন আগেই বাংলাদেশ দলে টি-টোয়েন্টি অভিষেক হয় তার। জাতীয় দলের ক্রিকেটার দল পাবেন না, এমনটা তো কল্পনাতীত! জুবায়েরের কাছেও তাই, ‘বিপিএলে দল পাবো না এটা কল্পনাতেও ছিলো না। বিপিএল খেলতে না পারাতে আমার জন্য অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। টিমের সাথে থাকতে পারলেও লাভ হতো। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে লেগস্পিন অনেক কার্যকর, চলমান টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও লেগস্পিনাররা ভালো করছে। লেগস্পিনারদের হাতে অনেক ভ্যারিয়েশন থাকে, সুযোগ থাকে উইকেট পাওয়ার। প্রতিটা ওভারেই সুযোগ থাকে। নিজে লেগস্পিনার বলে বলছি না। ’

বিপিএলের খেলোয়াড় ড্রাফটে অবিক্রিত থাকেন জুবায়ের। এরপর ‘এ’ দলের হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যান তিনি। সফরে ‘এ’ দলের একমাত্র জয়টির নায়ক কিন্তু এই লেগস্পিনারই। স্থানীয় দল গুটেং এর বিপক্ষে ৮ বলে (১.২ ওভার) তুলেছিলেন ৪ উইকেট। এমন পারফরম্যান্সের পর আশায় বুক বেঁধেছিলেন, বিপিএলে বুঝি কোনো দল থেকে ডাক পড়বে। তবে কেউ ডাকেনি এই উঠতি বোলারকে, ‘দক্ষিণ আফ্রিকার উইকেটে কোনো বোলারই উইকেট থেকে সহযোগিতা পায়নি। আমি ৮ বলে ৪ উইকেট পেলাম। বিপিএলে টিম পাইনি বলে মনের ভেতর জেদ ছিল, আজ কিছু করে দেখাবো..। সফল হওয়ায় মনে হয়েছে এখন হয়তো কোনো টিম পেতে পারি।   তারপরও আসলে টিম পাইনি। কপালের দোষ বলে মেনে নিয়েছি। ’

বিপিএলে দল না পাওয়ার কষ্ট দূর হয় কোচের একটি কথায়। তখন বাংলাদেশের ফিল্ডিং কোচ রিচার্ড হ্যালসেল ছিলেন ‘এ’ দলের হেড কোচ। ওই ম্যাচে জয়ের পর সব ক্রিকেটারকে ডেকে নাকি হ্যালসেল বলছিলেন, ‘ও (জুবায়ের) তোমাদের অনেক ম্যাচ জেতাতে পারবে, যেমন আজ জিতলে তোমরা। ওকে অনেক বেশি সুযোগ দেয়া উচিত। তাকে বেশি ম্যাচ খেলানো উচিত। ’ কোচের এমন কথায় জুবায়েরের সব কষ্ট দূর হয়ে যায় নিমেষেই।

কষ্ট দূর হলেও বিপিএলে না থাকায় অনেকগুলো ম্যাচ খেলা থেকে বঞ্চিত হন জুবায়ের। বিপিএলে ভালো করতে পারলে তো টি-টোয়েন্টি দল থেকেও বাদ দেয়ার প্রশ্ন আসতো না। বিপিএল শেষে জিম্বাবুয়ে সিরিজ, এশিয়া কাপ, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দলে নেই জুবায়ের। এমনকি প্রাথমিক দলেও ছিলেন না। এখন ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফর্ম করেই ফিরতে তবে। পাকা করতে হবে ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটই। তাইতো জুবায়েরের ভাবনায় এখন প্রিমিয়ার লিগ। এপ্রিলের শেষ দিকে বসবে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ ক্রিকেটের ২০১৫-১৬ মৌসুম। এখানে দল পাওয়া যাবে তো!  এমন ভাবনার কারন তো অমূলক নয়। ঘরোয়া ক্রিকেটে জুবায়ের যে অবহেলিত-এ কথা তো সবারই জানা। টিমে থাকলেও একাদশে রাখা হবে না তাকে। বিসিএলে ৬ ম্যাচের মধ্যে ইস্ট জোনের এ ক্রিকেটার খেলেছেন মাত্র একটি ম্যাচে। তাও পঞ্চম রাউন্ডে এসে। পরের রাউন্ডে আবার ড্রপ। এভাবেই চলছে জুবায়েরের ক্রিকেট ক্যারিয়ার। অথচ পরিপক্ক হয়ে উঠতে এ মুহূর্তে বেশি ম্যাচ খেলাটাই গুরুত্বপূর্ণ ২০ বছর বয়সী এ লেগস্পিনারের।

‘আমার কাছে মনে হয় তাকে যথেষ্ট সুযোগ দেয়া উচিত। আমরা এই দেশেই বেশি ম্যাচ খেলবো, এই ধরনের পিচেই উইকেট নিতে হবে। আর এই ধরনের পিচে উইকেট নিতে হলে আমিতো লিখনের চেয়ে ভালো বোলার আর দেখি না। ’- গত বছরের জুলাইয়ে ফতুল্লায় ভারতের বিপক্ষে টেস্ট চলাকালীন সময়ে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে জুবায়ের হোসেন সম্পর্কে এমন অভিমত দেন সাকিব আল হাসান। বৃষ্টিবিঘ্নিত সে ম্যাচে ভারতের প্রথম ইনিংসে উইকেট পড়েছিল ৬টি। সাকিব তুলেছিলেন চারটি, জুবায়ের দুটি। বিরাট কোহলি ও রিদ্ধিমান সাহাকে লেগস্পিনের ঘূর্ণিতে সরাসরি বোল্ড করেছিলেন জুবায়ের। তার গুগলিতে উইকেটে অস্বস্তি বোধ করছিলেন বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন বিরাট কোহলি।
 
৬ টেস্টে ৯ ইনিংসে বল করে জুবায়ের এ পর্যন্ত উইকেট তুলেছেন ১৬টি। ইনিংসে পাঁচ উইকেট একবার। টেস্টে নিজেকে প্রমাণ করা জুবায়ের এরপর বাংলাদেশ দলের হয়ে খেলেছেন তিনটি ওয়ানডে ও একটি টি-টোয়েন্টি।
 
জুবায়েরের জাতীয় দলের হয়ে একমাত্র টি-টোয়েন্টি ম্যাচ বিপিএল শুরুর আগে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। ওই ম্যাচটাই টি-টোয়েন্টি দল থেকে ছিটকে দেয় জুবায়েরকে। এক ম্যাচেই কি তাহলে জুবায়ের সম্পর্কে শতভাগ ধারণা পেয়ে গিয়েছিলেন নির্বাচকরা? বেশ কঠিনই। এক ম্যাচে জাজমেন্ট দিয়ে দেয়া। ওই ম্যাচে ২ ওভার বল করে ২০ রান দিয়ে নিয়েছিলেন দুই উইকেট। প্রথম ওভারে খরুচে বল (১৭ রান) করার শাস্তিটা এখনো পাচ্ছেন জুবায়ের। টি-টোয়েন্টিতে তাকে প্রাথমিক দলে রাখার চিন্তাতেও নেই নির্বাচকরা।

মজার ব্যাপার হলো জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ম্যাচের আগে কখনোই টি-টোয়েন্টি খেলেননি জুবায়ের। ঘরোয়া ক্রিকেটে তো নয়ই।
 
শুধু সাকিব আল হাসান নয়, স্পিনের রাজা মুস্তাক আহমেদ, লেগস্পিনার ইয়াসির শাহ, ইমরান তাহিরেরও যথেষ্ট সমীহ পেয়েছেন জুবায়ের। সম্ভাবনাময় এক প্রতিভা না হলে কেনইবা আগ বাড়িয়ে জুবায়েরের সঙ্গে পরিচিত হতে আসবেন তারা? জুবায়ের বলছিলেন, ‘পাকিস্তানের সাথে আমাদের টেস্ট খেলা। ওই সময় ইয়াসির শাহ আমার কাছে নিজে থেকেই এসেছেন। আমিই চেয়েছিলাম তার কাছে যাব। প্র্যাকটিসে এসে আমাকে বলেছেন, তুমি গুগলি কিভাবে মারো। আমাকে একটু দেখাবে? সত্যি কথা আমার খুব হাসি পেয়েছিল..। তিনি তো প্রতিষ্ঠিত লেগস্পিনার। আমার কোচ তখন জানান এ বিষয়ে কোনো কিছু বলার দরকার নাই। ‌ম্যাচ চলাকালীন সময়ে আসছিল তো, এজন্য হয়তো না করেন কোচ। আমার কাছে ব্যাপারটা খুব অবাক লেগেছিল। মুস্তাক আহমেদের কাছে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল রিচার্ড হ্যালসেল। পাকিস্তান যখন আসলো সোনারগাঁও হোটেলে বসে মুস্তাক আহমেদ আমাকে বলেন, তোমার অ্যাকশন মাশাআল্লাহ খুব সুন্দর। তিনি অনেক টিপস দিয়েছিলেন। ’  

জুবায়ের এখন: বিসিএল শেষে বিসিবির একাডেমিতে থেকে নিয়মিত স্পিন বোলিং নিয়ে কাজ করছেন জুবায়ের হোসেন লিখন। বিসিবির গেম ডেভলপম্যান্ট ম্যানেজার ‍ও সাবেক কোচ নাজমুল আবেদিন ফাহিম দেখভাল করছেন তার। লেগস্পিনের ঘূর্ণি, গুগলি আর স্ট্রেইট বল করাটা দারুণ আয়ত্ত্বে এসেছে। ফ্লিপার নিয়েও কাজ করছেন। নেটে ব্যাটিংটাও করছেন মাঝে মাঝে। নিজেকে নিয়ে মূল্যায়ন করতে বলা হলে জুবায়ের বলেন, আমি জানি আমার ভেতর কি আছে। আমি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাবো। দেখি কি আছে সামনে। সে পরিমান চেষ্টা আছে আমার মধ্যে, অ্যাকুরিসি নিয়ে কাজ করছি। আত্মবিশ্বাস আছে।   সিনিয়র ক্রিকেটারদের মধ্যে মুশফিক ভাই, সাকিব ভাই, তামিম ভাই, রিয়াদ ভাই আমাকে অনেক সাপোর্ট করেন। বাংলাদেশ দলের সবাই আমার অ্যাবিলিটি সম্পর্কে জানে। তারা বলে, তুই যেদিন ভালো করবি ব্যাটসম্যানরা সেদিন দাঁড়াতেই পারবে না। তাদের কথায় উৎসাহ পাই। আমার ইচ্ছা বাংলাদেশে যেহেতু লেগস্পিনার নাই। আমি নিজেও বিশ্বাস করি একটা লেগস্পিনার টিমে থাকা মানে দলের জন্য কতো ভালো। নিজে লেগস্পিনার বলে বলছি না। খেলা দেখে, বুঝে যেটুকু জানি একটা লেগস্পিনার  টিমে থাকা অনেক জরুরি।
 
জুবায়ের সম্পর্কে নাজমুল আবেদিন ফাহিম: জুবায়েরের উঠে আসার প্রক্রিয়ার মধ্যে একটা জিনিসের খুব অভাব ছিল, সেটা হলো যথেষ্ট ম্যাচ না খেলা। বিশেষ করে লংগার ভার্সন। লেগস্পিন ইজ অ্যা ভেরি ভেরি ডিফিকাল্ট আর্ট। স্বাভাবিক কোনো বডি মুভমেন্ট থাকেনা। এ জন্য অ্যাকুরিসি ঠিক থাকা খুব কঠিন। এটা ‍জুবায়েরের জন্য মাঝে মাঝে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আমরা যতটকু দেখেছি সে যখন প্র্যাকটিসে থাকে, প্র্যাকটিস ম্যাচে থাকে তখন মোটামুটি একটা কনসিসটেনসি নিয়ে লাইন-লেন্থ ঠিক রেখে বল করতে পারে। কিন্তু ম্যাচের কঠিন পরিস্থিতিতে সেটা মাঝে মাঝে হয়তো ধরে রাখতে পারে না। এর মূল কারণ হলো যথেষ্ট ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা তার নেই। সিরিয়াস ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা তার কম। কঠিন মোমেন্টে বল করার অভিজ্ঞতা কম। তার সবচেয়ে বড় ঘাটতি লংগার ভার্সন ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা।
 
ফাহিমের প্রেসক্রিপশন: লংগার ভার্সনে ধারবাবাহিকভাবে অনেক ওভার বল করার সুযোগ থাকে। নিয়মিত বল করে যাওয়াটা জুবায়েরের খুব দরকার এখন। এটা কেবল লংগার ভার্সনেই সম্ভব। সকালে খারাপ করলেও, বিকেলে ফিরে আসার সুযোগ থাকে।   এক স্পেলে ১০-১৫ ওভার করার সুযোগ থাকে। তাছাড়া জুবায়ের যদি কিছু পারফরম্যান্স বের করে নিয়ে আসতে পারে, তা হবে দলের জন্য বেশ ভালো একটি সংবাদ। সে খুব ইউসফুল বোলার। বয়সটা এখনো কম। তার জন্য যেমন পরিবেশ দরকার সেটা সে খুব কমই পাচ্ছে। মাঝে মাঝে লংগার ভার্সন পাচ্ছে, কিন্তু ওরকম পারফরম্যান্স হয়তো করতে পারছে না। এজন্য দলে হয়তো তার অবস্থানটাই শক্ত নয়। এটা টেনশনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বোলিং নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ে এজন্য অনেক সময় বোলিং খারাপ হয়। জুবায়ের যাতে নিরবিচ্ছিন্নভাবে বল করতে পারে, কম্পিটিশনে ম্যাচ খেলতে পারে-এমন একটা পরিবেশ তৈরি করে দেয়া দরকার। তাহলে ভালো জায়গায় বল করার যে আত্মবিশ্বাস তার আছে, সেটা পাবে। এটার জন্য পরিবেশ তৈরি করাটা খুব দরকার। এজন্য তাকে একাডেমিতে থাকার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। হয়তো সামনে কিছু ম্যাচ খেলার সুযোগও পাবে।
 
জুবায়ের হোসেনের বিশেষ গুন: একটা জিনিস সবারই চোখে পড়ে যে কারণে তাকে জাতীয় দলে  সুযাগ দেয়া হয়। আর তার ব্যাপারে কোচও (হাথুরুসিংহে) খুব দূর্বল ছিলেন। জুবায়ের প্রচুর বল ঘুরাতে পারেন, গুগলির উপর ভালো কন্ট্রোল আছে। এ দুটিই লেগস্পিনারের জন্য সবচেয়ে বড় সম্পদ। আমরা অনেক সময়ই তাকে নেটে দেখি তিনি জোরের উপর ঘুরাতে পারেন, যেটা ব্যটাসম্যানদের জন্য কঠিন। তিনি যে টাইপের লেগস্পিনার সেটা কন্ট্রোল করা আসলে আরও কঠিন।   কঠিন সময়ে জুবায়ের যদি আরও বল করেন, কিছু পারফরম্যান্স বের করে আনতে পারেন তাহলে তার ভবিষ্যত খুব ভালো হবে-একথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

বাংলাদেশ সময়: ০১৪৪ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০১৬
এসকে/এমআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।