ঢাকা: ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেটে কী হচ্ছে এসব? ম্যাচের ফিকশ্চার থেকে শুরু করে ভেন্যু পরিবর্তন, ম্যাচ অফিশিয়ালদের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত, আম্পায়ারদের সাথে খেলোয়াড়দের অসৌজন্যমূলক আচরণ, আবার কোন ম্যাচে দেখা গেছে একটি দলকে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দিতে উইকেটই ভিজিয়ে রাখা হয়েছে!
যে ক্রিকেট নিয়ে আমরা গর্ব করি, যে ক্রিকেট দিয়ে ষোল কোটি মানুষের ছোট এই ভুখন্ড সারা বিশ্বে সমাদৃত সেই ক্রিকেটের এমন নাজুক অবস্থা?
কথা হচ্ছিল দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের সব চাইতে মর্যাদাকর আসর ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগের এবারের আসর নিয়ে।
কেন ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে এমন হচ্ছে? জানতে চাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (কোয়াব)’র সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগের ম্যাচ রেফারি দেবব্রত পালের কাছে।
তার মতে বিসিবির পেশাদারিত্বের অভাব ও নৈতিকতার অবক্ষয়ই মাঠে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনাগুলোর প্রথম ও প্রধান কারণ। এরপরেই যে বিষয়টিকে দেবব্রত কাঠ গড়ায় দাঁড় করালেন সেটি হলো প্রিমিয়ার লিগে প্লেয়ার বাছাইয়ের পদ্ধতি প্লেয়ারস বাই চয়েসকে।
তিনি বলেন, ‘প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগে এসব আপত্তিকর ঘটনার পেছনে দ্বিতীয় প্রধান কারণ হিসেবে যেটা কাজ করছে সেটা হলো প্লেয়ার্স বাই চয়েস পদ্ধতি। ক্রিকেটার বেছে নিতে লটারির মাধ্যমে করা এই পদ্ধতিটি খুবই আপত্তিকর। আপনি জানেন যে, এই পদ্ধতির ব্যাপারে প্লেয়ারদের ভেতরে যথেষ্টই অসন্তোষ আছে। কারণ এই প্রক্রিয়ায় প্লেয়াররা স্বাধীনভাবে দল নির্বাচন করতে পারছেন না। প্রিমিয়ার ডিভিশনে কে কোন দলে খেলবেন সেটা তো প্লেয়ারাই নির্বাচন করবেন। আর স্বাধীনভাবে দল নির্বাচন ঘরোয়া ক্রিকেটে দীর্ঘ দিনের সংস্কৃতি। প্লেয়াররা চায় আগে যেভাবে দল বদল হয়েছে সেভাবেই হোক। কিন্তু বাস্তবে সেটা হয় নি। ’
শুধু নিজের প্লেয়ার বাই চয়েসই নয় প্রিমিয়ার লিগে প্লেয়ারদের পাওনা নিয়েও ব্যাপক অসন্তোষ আছে বলেও বিশ্বাস করেনে এই ম্যাচ রেফারি। সঙ্গে আরও উল্লেখ করেন যে, বোর্ড এখানে যে পরিমাণ টাকা ধার্য করে দিয়েছে সেটা নিয়ে প্লেয়ারদের মধ্যে বিরাজ করছে ক্ষোভ।
যথার্থই বলেছেন দেবব্রত। কেননা আগে যখন প্লেয়াররা ক্লাবগুলার সাথে চুক্তি করতো তখন লিগ শুরুর আগেই ৭০-৭৫ ভাগ টাকা দিয়ে দিত। আর এবছর ক্রিকেট বোর্ড যে চুক্তিপত্র করে দিয়েছে সেখানে প্লেয়াররা সাইনিং মানি ৩০ ভাগ। লিগ পর্ব শেষে সুপার লিগের আগে ৩০ভাগ আর লিগ শেষের এক মাসের মধ্যে বাকি ৪০ ভাগ টাকা পাবে।
মজার ব্যাপার হলো এটা নিয়েও প্লেয়ারদের মধ্যে যথেষ্ট অসন্তোষ আছে। কেননা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের করে দেয়া এই চুক্তিপত্রটি দেশের দুই তিনটি ক্লাব অনুসরণ করছে না। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ক্রিকেট কোচিং স্কুল (সিসিএস) ও ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব।
যদিও দল দুটো ইতোমধ্যেই অবনমনে চলে গেছে তাই ওই ক্লাবের প্লেয়াররা তাদের পাওনা কীভাবে পাবেন সে বিষয়টি নিয়েও ধোঁয়াশা আছে। তবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড প্লেয়ারদের পাওনা মিটিয়ে দেবার ব্যাপারে মৌখিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
কিন্তু পাওনা মিটিয়ে দেয়ার ব্যাপারে মৌখিক সিদ্ধান্ত প্লেয়ারদের সমস্যা সমাধানের কোন স্থায়ী পদ্ধতি হতে পারে না।
এদিকে এবারের প্রিমিয়ার লিগে ঘটে যাওয়া আপত্তিকর ঘটনাগুলোকে দু:খজনক অভিহিত করে দেবব্রত বলেন, ‘গণমাধ্যমগুলোতে যে বিষয়গুলো এসেছে এটা কখনওই কাম্য হতে পারে না। কারণ এখানে প্রতিটি ক্লাবেরই বিনিয়োগ আছে। ম্যাচের ফিকশ্চার থেকে শুরু করে ভেন্যু ও ম্যাচ অফিশয়ালসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁরা নিরপেক্ষতা আশা করে। ’
শুধু দেবব্রতই কেন? ক্রিকেট খেলা যারা নিয়মিত দেখেন বা খেলাটি নিয়ে ভাবেন তারাও অকপটে বলবেন যে, ভদ্রলোকের খেলায় কখনওই কোন অনাকাংখিত ঘটনা কাম্য হতে পারে না। এটি আমাদের সামগ্রিক ক্রিকেটের জন্য বিপর্যয়ের কারণ। এটা আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের জন্য একটি অশনি সংকেতও বটে। শুধু তাই নয় বিগত দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আমাদের ক্রিকেটের ভবিষ্যতের জন্য খুবই খারাপ যা নিয়ে বিসিবির একটি নিরপেক্ষ ভূমিকা থাকা উচিত।
ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগের শুরু থেকেই বারবার যে বিষয়টি গণমাধ্যমে উঠে আসছে সেটি হলো নিরপেক্ষ আম্পায়ারিং। এর মধ্যে সব চাইতে উল্লেখযোগ্য ছিল গেল ২৮ মে বিকেএসপির তিন নম্বর মাঠে প্রাইম দোলেশ্বর ও আবাহনীর মধ্যকার ম্যাচটি।
আম্পায়ারের দুটি বিতর্কিত সিদ্ধান্তে ওই ম্যাচে প্রাইম দোলেশ্বরের বিপক্ষে তিন উইকেটে জয় পায় আবাহনী যা এবারের টুর্নামেন্টে আম্পায়দের নিরপেক্ষতাকে করেছে প্রশ্ন বিদ্ধ।
তবে নিরপেক্ষ আম্পায়ারিংয়ের ক্ষেত্রে বিসিবির সঙ্গে চুক্তিভূক্ত আম্পায়ারদের কোন বিকল্প নেই বলে বিশ্বাস করেন দেবব্রত। ‘বিসিবির বেতনভুক্ত ও চুক্তিভূক্ত আম্পায়ার দিয়ে ম্যাচ চালানো উচিত এবং এটা সম্ভব। বর্তমানে যারা ম্যাচ পরিচালনা করছে তারা অভিজ্ঞ হলেও তাদের চাইতেও ভাল আম্পায়ার আছে। ক্রিকেটের বৃহত্তর স্বার্থে আমরা খুব সহজ ভাবেই এমন বিতর্ক এড়াতে পারি। গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলো হাই প্রোফাইল আম্পায়ার দিয়ে চালানো উচিত। ’
সব চাইতে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে প্রিমিয়ার লিগের মত হাই প্রোফাইলের ম্যাচ ক্যামেরায় ধারণ করা হচ্ছে না! একথা অনস্বীকার্য যে এখানকার প্রতিটি ম্যাচই বিসিবি’র ক্যামেরায় রেকর্ড হওয়া উচিত। বিসিবি ও সিসিডিএম যদি এই ম্যাচগুলো রেকর্ড করে রাখতেন তাহলে আম্পায়ারিং নিয়ে আর এই প্রশ্নগুলো আসেতো না। আম্পায়ররার যখন ক্রমাগত ভুল করবে এবং তা রেকর্ডেড থাকবে তখন তাদের যোগ্যতা কতুটুকু সেটা প্রমাণিত হবে।
বিপত্তি শুধু প্লেয়ার্স বাই চয়েস কিংবা নিরপেক্ষ আম্পায়ারিং নিয়েই নয়। আছে ভেজা উইকেট নিয়েও। কেননা গেল ৮ নভেম্বর বিকেএসপির ওই তিন নম্বর মাঠেই অনুষ্ঠিত হওয়া কথা ছিল লিজেন্ড অব রুপগঞ্জ ও ব্রাদার্স ইউনিয়নের মধ্যকার একাদশ রাউন্ডের শেষ ম্যাচটি। কিন্তু উইকেট ভেজা থাকায় রিজার্ভ ডেতে পর্যন্ত ম্যাচটি মাঠে গড়ায়নি।
ফলে পয়েন্ট ভাগাভাগি করে ১৪ পয়েন্ট নিয়ে সুপার লিগে যায় রুপগঞ্জ আর মূল্যবান ১ পয়েন্ট নিয়ে প্রথম বিভাগে নেমে যাওয়া থেকে বেঁচে গেল ব্রাদার্স ইউনিয়ন। আর অবনমনে চলে গেল কলাবাগান ক্রিকেট একাডেমি ও ক্রিকেট কোচিং স্কুল (সিসিএস)।
এমন অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়াতে কিউরেটরের অবশ্যই জবাবদিহিতা থাকা উচিত বলে মনে করেন দেবব্রত। ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ অবশ্যই থাকবে। কিন্তু গ্রাউন্ডস কমিটি কিউরেটরদের পর্যাপ্ত পরিমাণ ইকুয়েপমেন্ট দিতে হবে। আমরা যদি পেশাদারিত্ব ও নৈতিকতার জায়গায় স্বচ্ছ থাকি তাহলে উইকেটে পানি ঢেলে রাখার মত অনৈতীক ঘটনাগুলো ঘটবে না। নৈতিকতার জায়গাটা অনেক বেশি দুর্বল হয়ে গেছে। ’
তবে ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগকে আরও সুন্দর, পেশাদার, নিরপেক্ষ ও নৈতিকতা পূর্ণ হতে সিসিডিএমের পুনর্গঠনের উপর গুরুত্ব দিচ্ছেন এই কোয়াব সাধারণ সম্পাদক। সিসিডিএম যদি আরও পেশাদার হয় তাহলে প্রিমিয়ার লিগে এমন অপ্রীতিকার ঘটনা আর ঘটবে না বলে বিশ্বাস করেন তিনি।
‘এত বড় একটি টুর্নামেন্ট সিসিডিএম আয়োজন করছে কিন্তু এখানে তাদের পেশাদারিত্বের অভাব আছে। সিসিডিএমের অবকাঠামো কীভাবে পুনর্গঠন করা যায় সেটা নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। আমরা দেখছি অনেক আগে থেকেই একজন বোর্ড পরিচালক সিসিডিএমের সভাপতি হবেন, মেম্বার হবেন চেয়ারম্যান, একজন মেম্বার সেক্রেটারী তিনিও ক্লাব অফিশিয়াল। ওনারাই আবার বিভিন্ন ক্লাবের সাথে যুক্ত আছে। তাই সিসিডিএম ও ক্লাবগুলোকে নিয়ে বসে একটি পূর্ণ পেশাদরিত্বপূর্ণ একটি অ্যাসোসিয়েশন দাঁড় করানোর কথা এখনই ভাবতে হবে। সিসিডিএমকে আরও পেশাদিরেত্বর পরিচয় দিতে হবে। সিসিডিএম সভাপতি কোন ক্লাবের হলে সেই ক্লাবকে তিনি একটি বাড়তি সুবিধা দিবেনই। ’
দেবব্রত’র কথার অর্থ এই দাঁড়ায় যে যিনি সিসিডিএমের প্রধান থাকবেন তাঁর সঙ্গে ক্লাবের কোন সম্পর্ক থাকবেনা। সিসিডিএমের কমিটির সদস্যরা নিরপেক্ষ থাকতে হবে যেন কোন ক্লাব কোন অনুকম্পা নিতে না পরে। সিসিডিএম এমন একটি প্রতিষ্ঠান হবে যেখানে ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে যে ক্লাব অফিসিয়ালরা যুক্ত আছেন তাদের কোন চাপের কাছে কেউ নত শিকার না করে। এমন ব্যক্তি নিয়েই সিসিডিএম গঠিত হবে। এবং এই ক্ষেত্রে ক্লাব অফিশিয়ালদেরই অগ্রনী ভূমিকা পালন করতে হবে।
সব শেষ এই ক্রিকেট সংগঠক বললেন, ‘এবারের প্রিমিয়ার লিগে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে একটি সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে কী ধরনের অসঙ্গতি আছে সেগুলো সমাধান করতে হবে যদি আমরা ভবিষ্যতে একটি ভালো প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগ দেখতে পারি। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৭ ঘণ্টা, ১৫ জুন, ২০১৬
এইচএল/এমএমএস