হ্যাঁ, সত্যিই তিনি মাশরাফি বিন মর্তুজা। বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক বীর।
শুরুটা হয়েছিল ২০১৪ সালে। বাংলাদেশের ক্রিকেট যখন হারের দুঃসহ এক একটি যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছিল। ঠিক তখনই বছরটি শেষের দিকে রঙিন পোশাকে অধিনায়কের দায়িত্ব তুলে দেয়া হয় মাশরাফির কাঁধে। এটা অবশ্য নভেম্বরে।
তার আগে আমরা ওই বছরে বাংলাদশের হারের চিত্রটা একটু দেখে নেই। যেহেতু মাশরাফিকে নিয়ে আলোচনা সেহেতু এটা শুধুই ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টির কথাই বলছি।
বছরটির শুরুতেই (ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ সফরে আসে শ্রীলঙ্কা। সিরিজে তিন ম্যাচ ওয়ানডে সহ দুই ম্যাচ সিরিজের টি-টোয়েন্টিতেও হোয়াইটওয়াশ হয় স্বাগতিক বাংলাদেশ। পরের মাসেই ঘরের মাটিতে বসলো টি-২০ বিশ্বকাপের আসর যেখানে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিল আয়োজক দেশটি।
একই বছর জুনে ভারত বাংলাদেশ সফরে এসে ২-০ সিরিজ হারায় টাইগারদের। আগস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গিয়েও তিন ম্যাচ সিরিজের ওয়ানডেতে ৩-০তে হারে সফরকারীরা।
অবস্থা যখন এমন ভঙ্গুর ও নড়বড়ে ঠিক তখন নভেম্বর মাসে মুশফিককে সরিয়ে ওয়ানডে ও টি-২০ ফরম্যাটের অধিনায়কের দায়িত্ব পান ম্যাশ। তার বীরোচিত প্রত্যাবর্তনে শুরু হয়ে গেল বাংলাদেশ ক্রিকেটের আরেকটি স্বর্নালি অধ্যায়ের, যা শুধুই দাপুটে এক একটি জয়ের চাদরে মোড়া।
মাশরাফি দায়িত্ব নেয়ার মাসেই বাংলাদেশ সফরে এসে ৫-০ হোয়াইটওয়াশ হল সফরকারী জিম্বাবুয়ে।
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে বসলো বিশ্বকাপের আসর। সেখানেও এক গৌরবের অধ্যায় রচনা করলেন ম্যাশ। প্রথমবারের মত দলকে নিয়ে গেলেন কোয়ার্টার ফাইনালে। সে বছরের এপ্রিলে বাংলাদেশ সফরে আবার এলো পাকিস্তান।
১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানোর পর ক্রিকেটের কোন ফরম্যোটে আর একটিও জয়ের দেখা না পাওয়া বাংলাদেশ ওই সিরিজে পাকিস্তানকে ওয়াডেতে দিল ৩-০তে হোয়াইটওয়াশের লজ্জা। একমাত্র টি-২০ও শহীদ আফ্রিদিদের নাস্তানাবুদ করে ছাড়লো টাইগাররা।
এরপর জুনে শক্তিশালী ভারতকে ২-১ এ ওয়ানডে সিরিজ হারিয়ে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে বাংলাদেশ।
বাদ যায়নি পরাশক্তি দক্ষিণ আফ্রিকাও। জুলাইয়ে সফকারীদের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো ২-১ এ সিরিজে জয়ের অমরগাঁথা রচনা করে স্বাগতিক বাংলাদেশ। আর এর সব কিছুই এসেছে ওই মাশরাফির নেতৃত্বে।
পরের বছর বাংলাদেশে বসলো এশিয়া কাপের আসর। যেখানেও তার বলিষ্ট নেতৃত্ব ভক্তদের আপ্লুত করলো। কেননা দ্বিতীয়বারের মতো এশিয়া কাপের ফাইনালে উঠলো বাংলাদেশ। লাল-সবুজের ক্রিকেটের এই গৌরবটিও এলো মাশরাফির যোগ্য নেতৃত্বেই।
সঙ্গত কারণেই তাকে দিন বদলের অধিনায়ক তকমা দিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সহ-সভাপতি মাহবুব আনাম। ‘বাংলাদেশ ক্রিকেট আজকের যে অবস্থানে এসেছে সেখানে মাশরাফির অবদান অনেক। তার সমতুল্য খেলোয়াড় আমি আজ অবদি বাংলাদেশ ক্রিকেটে দেখিনি। তাকে পূরণ করা বাংলাদেশদলের পক্ষে সহজ হবে না। ওর মতো খেলোয়াড় এক যুগে একটার বেশি আসে না। তার থেকে যা চেয়েছি তার থেকে বেশি পেয়েছি। সে যেভাবে জুনিয়র ক্রিকেটারদের ইনকারেজ করছে সেটা অভাবনীয়। অতীতে কিন্তু আমাদের ড্রেসিং রুমে এরকম পরিবেশ ছিলো না। সে যে শারিরীক অবস্থা নিয়ে মাঠে থাকে আমি মনে করি না বিশ্বের অন্য কোনো স্পোর্টসম্যান এটা করত’।
বাংলাদেশের জার্সিতে গত দুই বছরে সবচেয়ে বেশি ওয়ানডে উইকেট মাশরাফির। টি-টোয়েন্টিতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেটেরও মালিক তিনি। বাংলাদেশ টি-২০তে সবচাইতে বেশি (৯ টি) জিতেছে মাশরাফির নেতৃত্বে। আবার সবচেয়ে বেশি (১৭টি) হারও তার হাত ধরেই এসেছে। টি-২০তে বাংলাদেশের অধিনায়কদের মধ্যে মাশরাফিই সবচেয়ে বেশি ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছেন (২৮টি)।
বাংলাদেশি খেলোয়াড়দের মধ্যে টি-২০তে চতুর্থ সর্বোচ্চ ছক্কার অধিকারী কিন্তু তিনিই (২৩টি)। সবচাইতে বেশি ২৯টির মালিক মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। দ্বিতীয় তামিম (২৮) ও তৃতীয় সাকিব (২৭টি)।
টি-২০তে উইকেট দখলের দিক থেকে তিনে মাশরাফি (৪১টি)। ৪৪টি নিয়ে দুইয়ে আব্দুর রাজ্জাক ও ৬৭টি উইকেট থলিতে পুড়ে শীর্ষে সাকিব আল হাসান। শুধু বলেই নয়, ব্যাট হাতেও তিনি কতটা বিষ্ফোরক ছিলেন তার প্রমান দিতে একটি পরিসংখ্যানই যথেষ্ট। বাংলাদেশে ১০টির বেশি ম্যাচ খেলা ক্রিকেটারদের মধ্যে সবাচাইতে ভাল স্ট্রাইক রেট ম্যাশরাফির। ৫৩ ম্যাচে তিনি রান তুলেছেন ১৩৬.৫৯ স্ট্রাইকরেটে।
সেই মাশরাফিই টি-২০কে বিদায় জানিয়ে দিলেন! কাজটি কতটা আগে হয়েছে, কতটা ঠিক হয়েছে সেটা অনুধাবন করার সক্ষমতা বাংলাদেশ ক্রিকেটের ম্যানেজমেন্টের হয়তো নেই। থাকলে এ দেশের ক্রিকেটের বর্তমান উন্নয়নের ধারার কথা বিবেচনা করে তাকেই রাখা হতো। অথবা তাকে বিদায় জানানোর কাজটি আরও সুন্দর হতে পারতো। যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করে তাকে টি-২০ ছাড়া করা হল, সেটা দুঃখজনক।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৬ ঘণ্টা, ৫ এপ্রিল, ২০১৭
এইচএল/এমএমএস