চট্টগ্রাম: ধবধবে সাদা ব্যান্ডেজের ওপর লেখা, ‘হাড় নেই, চাপ দেবেন না’। এঁকে দেওয়া হয় বিপজ্জনক চিহ্নও।
২০২১ সালের ৩০ অক্টোবর নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে আহতদের একজন আকিবের মাথায় সেদিনই চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগে অস্ত্রোপচার করে হাড়ের একটি অংশ খুলে তার পেটের চামড়ার নিচে রাখা হয়। ১৮ দিন থাকতে হয় আইসিইউতে। সেই হাড় প্রতিস্থাপনের জন্য আকিবকে ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৮ মার্চ অস্ত্রোপচার শুরু হয় সকাল ৯টায়। সাড়ে ৬ ঘণ্টার অস্ত্রোপচার অবশেষে সফল হয়। অস্ত্রোপচারে নেতৃত্ব দেন নিউরোসার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক নোমান খালেদ চৌধুরী। তাঁকে সহযোগিতা করে নিউরোসার্জারি ও অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী মিলিয়ে ১৫ জনের একটি দল।
গত ২৯ জুলাই মীরসরাইয়ের বড়তাকিয়া রেলস্টেশন এলাকায় চট্টগ্রামমুখী মহানগর প্রভাতী ট্রেনের ধাক্কায় হাটহাজারীর আর অ্যান্ড জে কোচিং সেন্টারের শিক্ষক-শিক্ষার্থী বহনকারী মাইক্রোবাসের আহত ৬ জন যাত্রী চিকিৎসা নেন নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে। পরে সুস্থ হয়ে তারা বাড়ি ফিরেছেন।
চমেক হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগ শুরু হয় ১৯৭৮ সালের ১১ মে। অধ্যাপক ডা. লুৎফুল আনোয়ার কাদেরী এই অঞ্চলে নিউরোসার্জারির একটি নতুন বিভাগ চালুর উদ্যোগ নেন। তিনি জেনারেল সার্জারি বিভাগের সহায়তায় কাজ শুরু করেছিলেন। প্রাথমিকভাবে তাঁকে ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে নিউরোসার্জিক্যাল রোগীদের জন্য ২০টি শয্যা দেওয়া হয়। ১৯৭৯ সালে এখানে পৃথক নিউরোসার্জিক্যাল ওয়ার্ড প্রতিষ্ঠিত হয়।
এটিই একমাত্র নিউরোসার্জিক্যাল সেন্টার যা এ অঞ্চলের মানুষের চিকিৎসা দিচ্ছে। নিউরো ট্রমা (মস্তিষ্ক এবং মেরুদণ্ড), নিউরো অনকোলজি (ব্রেন টিউমার, স্পাইনাল টিউমার), ভাস্কুলার নিউরোসার্জারি (মস্তিষ্ক এবং মেরুদণ্ডের এভিএম, অ্যানিউরিজম, হেমোরেজিক স্ট্রোক), স্পাইনাল নিউরোসার্জারি, পেডিয়াট্রিক এবং জন্মগত নিউরোসার্জারি (হাইড্রোসেফালাস, মেনিনোসেল, মাইলোমেনিনোসেল ইত্যাদি), এন্ট্রাপমেন্ট নিউরোপ্যাথি, মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডের ডিজেনারেটিভ ব্যাধি, নিউরো চক্ষুবিদ্যায় বিভাগটি বিশেষ ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীরাও পাচ্ছেন গবেষণার সুযোগ।
২০১৮ সালের ১৮ জানুয়ারি এই বিভাগের প্রধান হিসাবে যোগদান করেন প্রখ্যাত নিউরোসার্জন প্রফেসর ডা. এম এম নোমান খালেদ চৌধুরী। তিনি নিউরোসার্জারি বিভাগে চালু করেন রাত্রীকালীন ও জরুরি অস্ত্রোপচার। এই বিভাগে সরকার অনুমোদিত শয্যা সংখ্যা ৪৫টি। ৩১ ডিসেম্বর মোট চিকিৎসাধীন রোগী ছিল ২২০ জন, এছাড়া মারা গেছেন ৪ জন।
হাসপাতালের ১৮ নম্বর নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে স্নায়ুরোগ সংক্রান্ত রোগীর চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। আর ২৮ নম্বর নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে স্ট্রোক, হেড ইনজুরি, মেরুদণ্ডের ইনজুরি, নার্ভ ইনজুরি, ব্রেন টিউমার ও শিশুদের জন্মগত ত্রুটির চিকিৎসা দেওয়া হয়।
অধ্যাপক ডা. নোমান খালেদ চৌধুরী বলেন, ‘এ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রোগীর মধ্যে ২০ থেকে ৫০ শতাংশই স্ট্রোকের রোগী। প্রথমে একজন স্ট্রোকের রোগীকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ শেষে ১২ নম্বর সিসিইউতে পাঠানো হয়। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ব্রেন স্ট্রোক নিশ্চিত হলেই রোগীকে নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে পাঠানো হয়’।
সড়ক দুর্ঘটনা, মাথায় আঘাত, ব্রেন টিউমার, স্ট্রোক এর চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচার ব্যয়বহুল হওয়ায় চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলার মানুষের একমাত্র ভরসাস্থল এই ওয়ার্ড। তবে শয্যার তুলনায় বেশি রোগীর চাপ, পুরনো অপারেশন থিয়েটার ও আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব ভুগাচ্ছে এই ওয়ার্ডে কর্মরতদের। নেই অপারেটিং মাইক্রোস্কোপ, নিউরো এন্ডোস্কোপ, নিউমেটিক ড্রিল।
চট্টগ্রামে সম্প্রতি ‘নিউরোস্পাইন সোসাইটি অব বাংলাদেশ’ (এনএসএসবি) এর চতুর্থ জাতীয় সম্মেলনের বৈজ্ঞানিক সেমিনারে উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমানে নিউরো সমস্যায় ভুগতে থাকা রোগীদের চিকিৎসা বাংলাদেশ করতে সক্ষম। তবে প্রয়োজনের তুলনায় দক্ষ লোকবল কম। স্নায়ুবিক রোগের চিকিৎসার জন্য নিউরোসার্জনের সংখ্যা বৃদ্ধি করা দরকার। বাংলাদেশে বর্তমানে ২১২ জন নিউরোসার্জন রয়েছেন। চট্টগ্রামে আছেন ৯৫ জন। কিন্তু দেশে প্রয়োজন ১ হাজার ৬০০ জন নিউরোসার্জন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২২
এসি/টিসি