ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

পাঠ্যবইয়ে চট্টগ্রামের কবিয়াল রমেশ শীল ও দুই তীর্থস্থান

সৈয়দ বাইজিদ ইমন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০২৩
পাঠ্যবইয়ে চট্টগ্রামের কবিয়াল রমেশ শীল ও দুই তীর্থস্থান ...

চট্টগ্রাম: অবিভক্ত বাংলার শ্রেষ্ঠ কবিয়াল রমেশ শীল। বাড়ি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার গোমদণ্ডী ইউনিয়নে।

২০০২ সালে পেয়েছেন গণসঙ্গীতে মরণোত্তর একুশে পদক। বাঙালির এই কৃতি সন্তান সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের জানার সুযোগ করে দিয়েছে সরকার।
২০২৩ সালের ৭ম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন তিনি।

সেই সঙ্গে ৬ষ্ঠ শ্রেণির হিন্দু ধর্ম শিক্ষা বইয়ে স্থান পেয়েছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ ধাম ও সপ্তম শ্রেণির হিন্দু ধর্ম শিক্ষা বইয়ে মহেশখালীর আদিনাথ মন্দিরের বিবরণ। চট্টগ্রামের এই গুণিজন ও তীর্থস্থান দুটির বিশদ বর্ণনা থাকলে শিক্ষার্থীরা বিস্তারিত জানতে পারতো বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনেরা।

দেখা গেছে, মাত্র ৮ লাইনে সীতাকুণ্ডের তীর্থস্থান চন্দ্রনাথ ধাম ও তার আশপাশের আরও কয়েকটি মঠ-মন্দিরের বিবরণ দেওয়া হয়েছে ৬ষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে মন্দির ও তীর্থক্ষেত্র অনুচ্ছেদের ৪৬ পৃষ্ঠায়। চন্দ্রনাথ ধাম নিয়ে আঁকা দুটি ছবিও পাঠ্যবইয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১ হাজার ২০০ ফুট ওপরে পাহাড় চূড়ায় অবস্থিত চন্দ্রনাথ ধাম। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এটি একটি পবিত্র তীর্থস্থান। ফাল্গুন মাসে চন্দ্রনাথ ধামে অনুষ্ঠিত হয় শিবচতুর্দশী পূজা। এ উপলক্ষে বসে মেলা, যেখানে অংশ নেন ১০ লাখের বেশি মানুষ। ভারত, নেপালসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসেন পুণ্যার্থীরা। চন্দ্রনাথ ধাম ছাড়াও পাশের বিরূপাক্ষ মন্দির, স্বয়ম্ভূনাথ মন্দির, ভোলানন্দ গিরি সেবাশ্রম, দোল চত্বর ও শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের নাম উঠে এলেও নেই বিশদ বিবরণ।

৭ম শ্রেণির বইয়ে ১৩ লাইনে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে আরেক তীর্থস্থান মহেশখালীর আদিনাথ মন্দিরের। বাংলাদেশের উপকূলীয় শহর কক্সবাজার থেকে ১২ কিলোমিটার দূরের দ্বীপ মহেশখালীতে অবস্থিত আদিনাথ মন্দির। হিন্দু সম্প্রদায়ের দেবতা দেবাদিদেব মহাদেবের নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত এ মন্দিরে প্রতি বছর শিব চতুর্দশী তিথিতে আসেন দেশ-বিদেশের পুণ্যার্থীরা। ধর্মীয় দিক থেকেও এই তীর্থক্ষেত্রের রয়েছে বিশেষ অবস্থান।  

এছাড়া ৭ম শ্রেণির শিল্প ও সংস্কৃতি পাঠ্যবইয়ের ২২ পৃষ্ঠায় মায়ের মুখের মধুর ভাষা অধ্যায়ে কবিয়াল রমেশ শীল সম্পর্কে মাত্র ২০ লাইন দিয়ে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী বর্ণনা শেষ করা হয়েছে।  

কবিয়াল সম্রাট রমেশ শীল ১৮৭৭ সালে বোয়ালখালীর পূর্ব গোমদণ্ডীতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালের ৬ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পিতা চণ্ডীচরণ শীল ও মাতা রাজকুমারী শীল। ১৮৮৮ সালে পিতার মৃত্যুর কারণে ৪র্থ শ্রেণিতেই পাঠ চুকাতে হয় তাঁকে। ১৮৯৮ সালে কবিগানের আসরে অংশগ্রহণের মাধ্যমে কবিয়াল হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে। তিনি ১৯০৮ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী ক্ষুদিরামের ফাঁসির খবর নিয়ে, ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ১৯১৯-২০ সালে খেলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলন নিয়ে অসংখ্য গান, কবিতা রচনা করেন। ১৯৪৮ সালে কলকাতার শ্রদ্ধানন্দ পার্কে কবিগানের পর তাঁকে বঙ্গের শ্রেষ্ঠ কবিয়াল উপাধি দেওয়া হয়।

রমেশ শীলের নাতি প্রিয় রঞ্জন শীল জানান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ৫ ডিসেম্বর সকালে পাক হানাদার বাহিনী রমেশ শীলের বাড়িটি গানপাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। সেই সঙ্গে রমেশ শীলের ছনের ছাউনিযুক্ত সমাধিও পুড়িয়ে দেয় হানাদার বাহিনী। সেদিন পাকসেনাদের দেওয়া আগুনে রমেশ শীলের লেখা কবিতা ও গানের ১৮টি পাণ্ডুলিপির মধ্যে ১৭টি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কোনও রকমে একটি পাণ্ডুলিপি মাটির নিচে পুঁতে রেখে রক্ষা করা হয়। বর্তমানে সেই পাণ্ডুলিপিই অসংখ্য গান, কবিতার ভাণ্ডারে পরিণত হয়েছে।

পরিবার বলছে, রমেশ শীলের গান, কবিতার ভাণ্ডার সংরক্ষণে কারও গরজ নেই। অনেক শিল্পী তাঁর লেখা গান নকল করছে, আবার অনেকে বিকৃতও করছে। যদি তাঁর লেখাগুলো সংরক্ষণ করা হতো তাহলে এসব হতো না। পাঠ্যবইয়ে তাঁর জীবনী আরও বৃহৎ পরিসরে আসা দরকার।

লোকসংগীত গবেষক ও সাংবাদিক নাসির উদ্দিন হায়দার বাংলানিউজকে বলেন, কিংবদন্তী ফিরোজ সাঁই, ফকির আলমগীর কিংবা হালের জনপ্রিয় ফকির শাহাবুদ্দিন’ সবাই গাইছেন ‘স্কুল খুইলাছে রে মওলা স্কুল খুইলাছে/গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী স্কুল খুইলাছে’। মাইজভাণ্ডারী ঘরানার অনেক শিল্পীও তেমনটাই গাইছেন। পাঠ্যপুস্তকেও দেখছি তেমনই লেখা হয়েছে। তবে পাঠ্যপুস্তকের বানানটা আরও ভজঘটে। কিন্তু কবিয়াল রমেশ শীল তো ‘স্কুল খুইলাছে’ লিখেননি, লিখেছেন ‘স্কুল খুলেছে’।

কদম মোবারক সিটি করপোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ঝুলন দেব বাংলানিউজকে বলেন, পাঠ্যবইয়ে সব বিষয়ে বিশদ বিবরণ দেওয়ার সুযোগ থাকে না। একটি বিষয়ে ধারণা দেওয়ার জন্য বইয়ে অল্প বর্ণনা থাকে। পরে শিক্ষকরা যখন ক্লাস নেন তখন শিক্ষার্থীদের বিস্তারিত জানান। নতুন কারিকুলামের বইয়ে কিছু ভুল-ত্রুটি থাকতে পরে। পরে তা সংশোধনের সুযোগ রয়েছে।  

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কুশল বরণ চক্রবর্তী বাংলানিউজকে বলেন, পাঠ্যবইয়ে চট্টগ্রামের একজন কৃতি পুরুষ এবং দুটি তীর্থস্থানের বর্ণনা স্থান পেয়েছে। এটি খুবই আনন্দের। এর মাধ্যমে আমাদের শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রামের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারবে। মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির ও সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ ধাম- এ দুটি তীর্থস্থানের নাম পুরাণেও উল্লেখ আছে। কলিযুগের তীর্থক্ষেত্র চন্দ্রনাথ ধামের মাহাত্ম্যের কথা উল্লেখ আছে দেবীপুরাণে। তবে, এখানে যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে সেটি খুবই অপ্রতুল। আরও বিস্তারিত বর্ণনা থাকলে ভালো হতো।  

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০২২
বিই/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।