ঢাকা, শুক্রবার, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

পিচ্ছিল সড়কে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা 

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৪ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০২৩
পিচ্ছিল সড়কে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা  ...

চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক মৃত্যুকুপে পরিণত হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা।

গত দুই মাসে ছোট-বড় প্রায় শতাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। পিচ্ছিল সড়কে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালানোকে এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপ্রশস্ত সড়ক, লবণ পানিতে মহাসড়ক পিচ্ছিল থাকা, অদক্ষ চালক, বেপরোয়া গতি, বিপজ্জনক বাঁক, ওভারটেকিং, মহাসড়কে নিষিদ্ধ ছোট যানবাহন চলাচল, ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত ওজন নিয়ে চলাচল ও সড়কের দুইপাশে উঁচু-নিচু অংশ থাকাসহ বেশ কয়েকটি কারণে ঘটছে এই সড়ক দুর্ঘটনা।  

গত ১৮ মার্চ রাত ১টার দিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে চুনতি ইউনিয়নের বনপুকুর এলাকায় বাস-লরি ও রাত দেড়টায় আধুনগর ব্রিজ এলাকায় বাস-ট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৯ জন আহত হন। এইদিন ভোর ৫টার দিকে লোহাগাড়া ও চকরিয়া উপজেলা সীমান্তবর্তী আজিজনগর এলাকায় কক্সবাজারগামী সিমেন্ট বোঝাই ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ব্রিজের সঙ্গে ধাক্কা লেগে উল্টে যায়। এতে চালক এরশাদ মন্ডল (৩০) ও হেলপার শিব্বির আহমদ মারুফ (১৯) ঘটনাস্থলে নিহত হন। গত ৫ মার্চ একই স্থানে বিজিবির বাসের সঙ্গে যাত্রীবাহি লেগুনার মুখোমুখি সংঘর্ষে ৫ জন নিহত হন।

লবণবাহী ট্রাক থেকে নিঃসৃত পানিতে পিচ্ছিল হচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক। ফলে বিপজ্জনক এ মহাসড়কে প্রতিদিন দুর্ঘটনায় বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা। লবণবাহী গাড়িতে ত্রিপল ব্যবহারের নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না।  

স্থানীয়রা বলছেন, প্রতিদিন শত শত ট্রাকে লবণ পরিবহন করে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এতে লবনের পানি পড়ে পিচ্ছিল হচ্ছে সড়ক। মহাসড়কটির কক্সবাজারের ঈদগাঁও থেকে চকরিয়া, লোহাগাড়া, চন্দনাইশ ও পটিয়া পর্যন্ত এলাকায় লবণবাহী ট্রাক চলছে অবাধে। বেশিরভাগেরই নেই পর্যাপ্ত লবণ পানি আটকে রাখার ব্যবস্থা।  

সস্প্রতি মহাসড়কটির চকরিয়া উপজেলায় ১৫টি দুর্ঘটনায় ১০ জনের প্রাণহানি ও আহত হয়েছেন অনেকে। ত্রিপল ছাড়া খোলা ট্রাকে লবণ পরিবহনের কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে হাইওয়ে পুলিশ।

দোহাজারী হাইওয়ে পুলিশের ওসি খাঁন মোহাম্মদ এরফান বাংলানিউজকে বলেন, শুধুমাত্র লবণবাহী ট্রাকের কারণেই দুর্ঘটনা বাড়ছে-এমন কিন্তু নয়। বিভিন্ন কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে চালকদের অসতর্কতা, ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে গাড়ি চালানো, ট্রাফিক আইন অমান্য করা, প্রতিযোগিতা দিয়ে গাড়ি চালানো ইত্যাদি কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে।

তিনি আরও বলেন, রাতে ও ভোরে মহাসড়কটির অবস্থা দেখলেই বুঝা যাবে- পরিবহনের সময় ট্রাক থেকে নিঃসৃত লবণ পানিতে পিচ্ছিল হয়ে উঠছে এ মহাসড়ক। ব্রেক কষলেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মহাসড়ক থেকে ছিটকে পড়ছে যানবাহন।  

চাঁদাবাজি: লবণবাহী গাড়িতে ত্রিপল ব্যবহারের নিয়ম থাকলেও তা মানছেন না চালকেরা। এতে লবণবাহী ট্রাক থেকে নিঃসৃত পানিতে পিচ্ছিল হচ্ছে সড়ক। এসব গাড়ি হাইওয়ে পুলিশ আটক করলেও টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়। যার কারণে চালকেরা ত্রিপল ব্যবহারের অনীহা দেখায়। পুলিশ ধরলেও টাকা দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে তারা। এ বিষয়ে পুলিশকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা।

নতুন চালক ও ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক: চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের বেশিরভাগ যাত্রীই পর্যটন নগরীর। দূর-দূরান্ত থেকে নতুন চালকেরা আসেন এ সড়কে। এ সড়কে রয়েছে বহু ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক। এর মধ্যে শুধু লোহাগাড়ায় রয়েছে প্রায় ১৪টি বাঁক। এছাড়াও পটিয়া, চন্দনাইশের দোহাজারী বাজার, সাতকানিয়ার কেরানীহাট ও লোহাগাড়া, পদুয়া, আধুনগর,  চুনতি, চকরিয়া, ঈদগাঁহ সহ বিভিন্ন এলাকায় বাঁক রয়েছে। মহাসড়কে ঘন ঘন বাঁকের কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা।

ভয়ংকর জাঙ্গালিয়া: চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি ইউনিয়নের জাঙ্গালিয়া এলাকায়। জাঙ্গালিয়া সড়কের দুইপাশে ঘন বনাঞ্চল, বাঁক ও ঢালু রাস্তার কারণে প্রায় সময় দুর্ঘটনা ঘটে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটন নগরী কক্সবাজার আসেন পর্যটকরা। দূর–দূরান্ত থেকে আসা চালকদের এই সড়কের ব্যাপারে অভিজ্ঞতা না থাকাও দুর্ঘটনার অন্যতম একটি কারণ। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি জাঙ্গালিয়া এলাকায় মাইক্রোবাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ১০ জন গুরুতর আহত হয়েছেন। ২০ ফেব্রুয়ারি জাঙ্গালিয়ার পাশেই রাত ১টার দিকে শ্যামলী বাস ও ট্রাকের সংঘর্ষে ৮ জন আহত হয়েছেন। গুরুতর আহত হয়েছে দুই গাড়ির চালক ও হেলপার চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। ১০ ফেব্রুয়ারি এসি বাস ও ট্রাকের সংঘর্ষে ১৫ জন আহত হয়েছেন। গুরুতর আহত অবস্থায় ৭ জনকে চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনার ৫৩ শতাংশ ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে। আর ৩৭ শতাংশ চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে। অর্থাৎ ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও গতির কারণে। আর ১০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য প্রতিযোগিতার মনোভাব ও পথযাত্রীর অসাবধানতা দায়ী। জাতীয় মহাসড়কগুলোয় সড়ক দুর্ঘটনার প্রায় ৫০ শতাংশই ঘটে থাকে। সড়কে ফিটনেসবিহীন অনেক গাড়ি চলমান, যা সড়ক দুর্ঘটনার জন্য অনেকাংশে দায়ী। সড়ক দুর্ঘটনার অন্য কারণগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে- ট্রাফিকবিধি লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত বোঝাই ও চালকদের ওভারটেকিং, বিরতিবিহীন লম্বা সময় ধরে গাড়ি চালানো, ছোট গাড়ির চালক বিশেষ করে মোটরসাইকেল চালকদের মধ্যে সতর্কতার অভাব, দূরপাল্লার সড়ক ও জনবহুল এলাকায় ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন এবং সড়কের বেহাল অবস্থা।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের এই দুরবস্থায় অভিযোগ দিয়েও কোনও কাজ হচ্ছে বলে জানিয়েছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। তারা বলছে, খোলা ট্রাকে পরিবহনের সময় লবণ পানি নিঃসৃত হয়ে সরাসরি মহাসড়কের ওপর গিয়ে পড়ায় বিটুমিনের কার্পেটিংয়ের প্রলেপও উঠে যাচ্ছে। বিটুমিনাসের নিচের স্তর মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সড়কের আয়ুষ্কাল কমে যাচ্ছে। এ নিয়ে সড়ক বিভাগের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে পত্র দেওয়া হলেও কোনও কাজ হচ্ছে না।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩০ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০২৩ 
বিই/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।