ঢাকা, রবিবার, ১ পৌষ ১৪৩১, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

সীতাকুণ্ডে বন উজাড়ের অভিযোগ বন বিভাগের বিরুদ্ধে!

সৈয়দ বাইজিদ ইমন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩৭ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০২৩
সীতাকুণ্ডে বন উজাড়ের অভিযোগ বন বিভাগের বিরুদ্ধে! ...

চট্টগ্রাম: উপকূল রক্ষায় সীতাকুণ্ড উপজেলার জঙ্গল সলিমপুর মৌজায় বনায়ন শুরু করেছিল বন বিভাগ। কিন্তু কয়েক বছর পর সেই বনায়ন নিয়ে ব্যবসা শুরু করে তারা।

উপকূল রক্ষায় লাগানো গাছ কেটে বিভিন্ন মৌসুমে ইটভাটায় বিক্রি করার অভিযোগ উঠে বন বিভাগের বিরুদ্ধে। তার প্রমাণ মিলেছে গুগল আর্থের স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণে।

ছবিতে দেখা যায়, বন বিভাগ গাছ লাগানোর পর সেই গাছ ইটভাটার মৌসুমে কাটে। শুধু গাছ কেটে ক্ষান্ত হয়নি বন বিভাগ। তারা ইটভাটায় মাটি বিক্রির জন্য খনন করেছে ছোট-বড় ৩৭টি পুকুর, অভিযোগ স্থানীয়দের।  

তারা বলছেন, প্রতিবছর কম বেশি বন বিভাগ গাছ লাগায়। কিন্তু সেটা তারা কাটেও। সেই গাছ ইটভাটায় লাকড়ি হিসেবেও বিক্রি করেছে তারা। স্থানীয় কিছু নেতা বন বিভাগের যোগসাজশে পুকুর খনন করে মাটি বিক্রি করেছে ইট ভাটায়।  

স্থানীয় মোহাম্মদ ইমতিয়াজ বাংলানিউজকে বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমাদের বসবাস এখানেই। স্থানীয় লোকজন বন থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করতে গেলেও তাদের আটকে রাখতো বন বিভাগের কর্মকর্তারা। কিন্তু তারা নিজেরাই বছরের পর বছর গাছ কেটে ইটভাটায় বিক্রি করেছে। ইটভাটায় মাটি বিক্রির সঙ্গে বন বিভাগের কিছু কর্মকর্তা জড়িত। তাদের ছত্রছায়ায় এখানে বিভিন্ন ধরনের অবৈধ ব্যবসা শুরু হয়৷ এ এলাকায় আগে কেউ যাওয়ার সাহস পেত না। প্রশাসনের অভিযানের পর সেখানে মানুষের যাতায়াত বেড়েছে।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার সলিমপুর মৌজার ফৌজদারহাট পোর্ট লিংক রোড সংলগ্ন প্রায় ১৯৪ একর খাস জমি অবৈধ দখলদার ও মাদক ব্যবসায়ীরা ভোগ করে আসছিল। পরে চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি মাদক ব্যবসায়ী ও দখলদারদের বিতাড়িত করে পুরো জায়গা নিয়ন্ত্রণে নেয় জেলা প্রশাসন।  

জানা যায়, ১৯৭৬ সাল থেকে চট্টগ্রামসহ সারাদেশের বিভিন্ন উপকূলীয় জেলাতে নতুন জেগে উঠা চরে সামাজিক বনায়ন শুরু করে বন বিভাগ। কিন্তু গুগল আর্থের স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে এবং স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণাধীন ১৯৪ একর খাসজমিতে ২০০০ সালে মাত্র একটি পুকুর ছিল। কিন্তু সেখানে বর্তমানে পুকুর রয়েছে ১২টি। অবৈধভাবে টনে টনে মাটি কেটে বিক্রি করে নির্মিত হয়েছিল শুকতারা পার্ক ও ইটভাটা যার ভেতরে সন্ধ্যার পরে চলত নানা ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ ও মাদকের ব্যবসা।

গুগল আর্থের ছবিতে দেখা যায়, ১৯৪ একর খাস জায়গায় ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে গাছ থাকলেও ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে তার মাত্র ২০ ভাগ গাছ দেখা যায়। ২০০৮ থেকে ২০০৯ সালের শীত মৌসুমে সেখান থেকে প্রচুর গাছ কাটা হয়। পরে সেখানে আবারও গাছ রোপণ করে বন বিভাগ। প্রাকৃতিক কারণে কিছুটা বন সৃষ্টি হয়। এরপর ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে গাছপালায় আচ্ছাদিত হয় ওই স্থান। পরে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসে প্রায় সম্পূর্ণ বন নিধন করা হয়। এরপর ২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসে পুনরায় গাছ রোপণ করা হয়। ২০১৬ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে আবারো ফাঁকা হয়েছে এ বনভূমি। প্রায় প্রতি শীতেই বন বিভাগ বনাঞ্চলের গাছ কেটে উজাড় করেছে।  

২০২২ সালের শীতকাল পর্যন্ত গাছ কেটে উজাড় করে ইটভাটায় বিক্রি করা হয়। পরে ইট তৈরির মাটির জন্য খনন করা হয় বেশ কিছু পুকুর। সেখানে করা হয় মাছ চাষ। তৈরি হয় শুকতারা পার্ক। যেখানে চলে অসামাজিক সব কার্যকলাপ।  

২০১৯ সালের দিয়ারা জরিপে ১৯৪ একর জমি সম্পূর্ণ সরকারের অধীনে অর্থাৎ ১ নম্বর খাস খতিয়ানে লিপিবদ্ধ রয়েছে। ১ নম্বর খাস খতিয়ানের জমির এখতিয়ার জেলা প্রশাসকের।

বন নিধনের বিষয়টি অস্বীকার করে চট্টগ্রাম বন বিভাগের সদর রেঞ্জ অফিসার রাশেদুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, চট্টগ্রামের সলিমপুর মৌজায় ১৯৯৮-৯৯ সালে আমরা সেখানে ১০০ হেক্টর জায়গায় বনায়ন করেছি। এরপর ১৯৯০-৯১ সালে ৭৫ হেক্টর করেছি। ২০০৭-০৮ সালে ১০০ হেক্টর, ২০০২-০৩ সালে ২৫ হেক্টর জায়গায় বনায়ন করেছি৷ এরপর থেকে আমরা বনায়ন করে যাচ্ছি। আমাদের কাজ বনায়ন করা, নিধন করা নয়। কারা বনের কাঠ কেটে নিধন করেছে সেটা আমরা জানি না। তবে, আমরা সবসময় চেয়েছি বন রক্ষা করতে। কিন্তু বিভিন্ন সময় কিছু প্রভাবশালীর কারণে তা সম্ভব হয়ে ওঠে না।

২০১৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের এক চিঠির বরাত দিয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মো. তৌহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘২০১০ সালের ১৮ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদের সভায় উপকূলে ব্যাপক বনায়নের জন্য ১৯৭৬ সালে বন বিভাগের কাছে সমুদ্র বক্ষ থেকে জেগে ওঠা চরভূমির মধ্যে ১২ লাখ ৩০ হাজার একর জমি থেকে একটা সুনির্দিষ্ট অংশ কৃষিকাজের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ে ফেরত দিতে বলা হয়। যার মধ্যে চট্টগ্রামে চাষাবাদযোগ্য বনভূমির পরিমাণ ৯ হাজার ৮৩৪ একর। '

তিনি বলেন, ‘এই ৯ হাজার ৮৩৪ একরের মধ্যে সদর রেঞ্জে জমির পরিমাণ ১ হাজার ৩৫১ দশমিক ৩২ একর এবং সীতাকুণ্ড রেঞ্জে ৯৬৭ দশমিক ৫০ একর। এ ছাড়া, ২০২০ সালের ১১ নভেম্বর ভূমি মন্ত্রণালয়ে সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা প্রশাসকদের জমি বুঝে নিতে চিঠি দেন ভূমি সচিব। ’

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, সীতাকুণ্ড মৌজায় উপকূলীয় বন রক্ষায় আমাদের নানা পরিকল্পনা রয়েছে। ইতিমধ্যে আমরা সেখান থেকে চারটি ইটভাটা উচ্ছেদ করেছি। সেই সঙ্গে অবৈধ দখল হওয়া জলাধারও উদ্ধার করেছি। সংশ্লিষ্ট বনাঞ্চল রক্ষা ও সরকারি খাসজমি তদারকি করতে ওয়াচ টাওয়ার স্থাপন করছি।  

বাংলাদেশ সময়: ২০৩০ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০২৩ 
বিই/পিডি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।