চট্টগ্রাম: অতীতের সুনাম, ঐতিহ্য ও গৌরব ফিরিয়ে আনতে চায় বিএনপির ভ্যানগার্ড হিসেবে পরিচিত জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মহানগর,দক্ষিণ ও উত্তর জেলা শাখা।
এরইমধ্যে চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও বিদ্যালয়গুলোতে নানান কর্মসূচি নিয়ে নেমেছেন ছাত্রদলের নেতারা।
তৃণমূল থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত নেতৃত্ব গড়ে তুলতে চট্টগ্রামে ছাত্রদলের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তবে সময়ের ব্যবধানে এখন আর সেইদিন নেই। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে সবচেয়ে বেশি হামলা-মামলা-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা। তাদেরকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, কলেজ ও বিদ্যালয়ে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে দেওয়া হয়নি।
এছাড়া জেলা, উপজেলা, পৌরসভার ও ইউনিয়ন কমিটি থাকলে থাকলেও বেশিরভাগই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। সেইসঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের মারমুখি অবস্থানে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল ছাত্রদল। এতে অনেকটা ভাটা পড়ে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সংগঠনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে নানা কর্মসূচিও পালন করেছে। নতুন করে শিক্ষার্থীদের সংগঠনে ভিড়াতে চট্টগ্রামের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়েছেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় ও চট্টগ্রামের নেতারা। তারা বলেছেন, শিগগিরই ‘নতুন ধারার’ ছাত্র রাজনীতি চট্টগ্রাম থেকে শুরু করবে ছাত্রদল।
ছাত্রদলের চট্টগ্রামের নেতারা জানিয়েছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে নানা কর্মসূচি পালন করেছেন। নতুন করে শিক্ষার্থীদের সংগঠনে টানতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাচ্ছেন নেতারা। এতে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন। নিয়মিতদের নেতৃত্বে আনতে নেওয়া হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মতামত। রাষ্ট্র সংস্কারে বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফার বিষয়েও জনমত তৈরিতে কাজ করছেন ছাত্রনেতারা।
ছাত্রনেতারা জানান, বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের দ্বারে দ্বারে পৌঁছাবেন সংগঠনের নেতারা। নিয়মিত ছাত্রদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা। ক্যাম্পাসগুলোতে নেতৃত্বের ক্ষেত্রেও নিয়মিত শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সাম্যের ধারণার ভিত্তিতে শিগগিরই ছাত্র রাজনীতির রোডম্যাপ প্রকাশ করবে ছাত্রদল। রোডম্যাপে ছাত্রদলের রাজনীতি চর্চা, ক্যাম্পাসের অ্যাকাডেমিক পরিবেশ এবং শিক্ষার্থী বা সংগঠনের বাকস্বাধীনতা স্থান পাবে। আবাসন সংকট দূর করার দাবিকে অগ্রাধিকার দেবেন তারা।
ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও নেতৃত্ব তৈরি করতে ১৯৭৯ সালে ছাত্রদল প্রতিষ্ঠা করেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। তখনকার সময়ে জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তায় তরুণ সমাজ অনুপ্রাণিত হয়ে ছাত্রদলে যোগ দেন। শিক্ষা, ঐক্য, প্রগতি- এই স্লোগানে দ্রুত সময়ে সারাদেশে ছাত্রদলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে যারা সুনাম ও দক্ষতার সঙ্গে বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত আছেন, তাদের অনেকেই ছাত্রদলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে বিভিন্ন সময়ে সরকারে পালাবদল ও পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতির সাংগঠনিক সক্ষমতা হ্রাস পায়। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেকেই রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়েন। এমন পরিস্থিতিতে ছাত্র রাজনীতিতে শিক্ষার্থীদের আস্থা ফেরাতে মাঠে নেমেছে ছাত্রদল।
চট্টগ্রামে ছাত্রদলে নেতৃত্ব দেওয়া সাবেক কয়েকজন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ছাত্রদল হচ্ছে বিএনপির প্রবেশদ্বার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দেওয়ার পর এই সংগঠনের নেতারা বিএনপিসহ বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনে যোগ দেন। যার মাধ্যমে নেতৃত্বের বিকাশ এবং তরুণ প্রজন্ম রাজনীতিতে আগ্রহী হয়। বিএনপির আন্দোলন সংগ্রামের মূল চালিকাশক্তিও ছাত্রদল। এই সংগঠনের নেতৃত্বেই নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সাফল্য পেয়েছিল বিএনপি। ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে স্বৈরাচার এরশাদ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই সময় ছাত্রদল সর্বস্তরে ব্যাপক আলোচনায় ছিল।
চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রদলের আহ্বায়ক সাইফুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সারাদেশের মতো চট্টগ্রামেও দখলদারিত্বভিত্তিক গতানুগতিক ছাত্র রাজনীতির অবসান হয়েছে। শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে একুশ শতকের উপযোগী একটি মেধাভিত্তিক ছাত্র রাজনীতির ক্ষেত্র বিনির্মাণ করার জন্য আমরা দেশের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ছাত্রদলের রাজনীতির অংশীদার করতে চাই। যাতে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি সুষ্ঠু রাজনীতি চর্চার মধ্য দিয়ে আগামী দিনে পূর্ণাঙ্গ নাগরিকে পরিণত হতে পারেন, দেশপ্রেমিক হয়ে উঠতে পারেন। চট্টগ্রাম থেকে ছাত্রদলের ‘নতুন ধারার’ ছাত্র রাজনীতি নিয়ে কাজ শুরু করবো।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সভাপতি মোহাম্মদ আলাউদ্দিন মহসিন বাংলানিউজকে বলেন, ক্যাম্পাসে কোনও দখলদারিত্ব বা শোডাউন হচ্ছে না। শৃঙ্খলাভঙ্গের ব্যাপারে ছাত্রদলের পক্ষ থেকে জিরো টলারেন্স পলিসির কঠোর বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ক্যাম্পাসে অ্যাকাডেমিক পরিবেশ বজায় রাখতে প্রশাসন ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করছে ছাত্রদল। যারা ছাত্রলীগের হাতে নির্যাতিত হয়েছে, তাদের ছাত্রদলের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ক্যাম্পাসে আমাদের লক্ষ্য সুস্থধারার ছাত্র রাজনীতি। র্যাগিং বন্ধে ছাত্রদল সচেতনতা তৈরি করে যাচ্ছে। ক্যাম্পাসে নিরাপদ পরিবেশ বজায় রাখতে সাধারণ ছাত্রদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এখনও তারা ছাত্র সংগঠনের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে আমাদের মধ্যে অবিশ্বাস সৃষ্টি করার পাঁয়তারা করছে। শান্তিকামী ছাত্র সংগঠনগুলোর মাঝে ছাত্রলীগের এজেন্ট ঢুকিয়ে শিক্ষাঙ্গনকে অস্থির করতে চাচ্ছে। ছাত্রদল তা হতে দেবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল শিগগিরই নতুন ধারার ছাত্র রাজনীতির রোডম্যাপ নিয়ে কাজ শুরু করবে।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের আহ্বায়ক রবিউল হোসেন রবি বাংলানিউজকে বলেন, গত ১৬ বছর ফ্যাসিস্ট হাসিনার ছাত্রলীগ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে ছাত্রদলকে ছাত্র রাজনীতি করতে নানাভাবে বাধা দিয়েছে। কিন্তু আমাদের রাজনীতি আমরা করেছি, ছাত্রদের দাবি আদায়ে মাঠে কাজ করেছি, ভবিষ্যতেও করবো। যারা ছাত্রদলের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছে, তাদের কমিটিতে মূল্যায়ন করা হবে। নিয়মিত ছাত্রদের দিয়ে ছাত্রদলের কমিটি গঠন করা হবে।
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক মনিরুল আলম জনি বাংলানিউজকে বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে ছাত্রদলের রাজনীতিতে সংস্কার শুরু হয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে আমরা এই সংস্কার কাজ করছি। যারা নিয়মিত ছাত্র, আগামীতে তাদের দিয়েই ছাত্রদল তৈরি হবে। কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি থানা-ওয়ার্ড পর্যায়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আমরা গিয়েছিলাম। শিক্ষার্থীরা সমর্থন জানাচ্ছে। এ কার্যক্রমে ব্যাপক সাড়া মিলছে। ছাত্রদল যে পজিটিভ ধারার রাজনীতি করছে-এটা শিক্ষার্থীরা পছন্দ করছে।
তিনি আরও বলেন, ছাত্রলীগ আগে দেশের সব শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম ও ছাত্র রাজনীতিকে কলঙ্কিত করেছে। র্যাগিং ও হল দখলের নামে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে মেরেছে, নির্যাতন করেছে। আমরা সেই রাজনীতি আর চাই না। গতানুগতিক রাজনীতি থেকে বের হয়ে নতুন ধারার রাজনীতি চালু করতে চাই। শিক্ষাঙ্গনে সুস্থধারার ছাত্র রাজনীতি ছাত্রদলের লক্ষ্য।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০১, ২০২৫
এমআই/টিসি