ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

রাতের চট্টগ্রাম

পাথরে পেতেছে শয্যা…

রমেন দাশগুপ্ত, আবদুল্লাহ আল মামুন, ইসমেত আরা | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৪৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৬, ২০১৫
পাথরে পেতেছে শয্যা… ছবি : সোহেল সরওয়ার/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: রাত সাড়ে বারটা। কর্ণফুলী নদীর তীর।

  আকাশে বিশাল থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদ। ঠাণ্ডা উত্তুরে হাওয়া।
নীরব নিস্তব্ধ।   দুরন্ত গতিতে ছুটছে গাড়ি। সেতুর নিচে  বড় বড় ব্লকের পাথরের উপর ছেঁড়া চটে শুয়ে আছেন ষাটোর্ধ্ব নুর ইসলাম। শরীরে মুড়িয়েছেন ময়লা পাতলা শাল। উপস্থিতি টের পেয়ে মুখের উপর থেকে সরিয়ে নিলেন শাল।

ঠাণ্ডায় এমন খোলা জায়গায় কেন রাত যাপন? জানতে চাইতেই উঠে গুটিসুটি মেরে বসেন।   চেহারায় স্পষ্ট দারিদ্রতার চাপ।   বললেন,‘রাত জেগে ব্লক, পাইপ এসব পাহারা দেই।   অভ্যাস হয়ে গেছে, ঘুম আসে না। মানুষের আনাগোনা হলেই টের পেয়ে যাই। ’

নুর ইসলামের বাড়ি ভোলা জেলার চরফ্যাশন থানায়।   মা-বাবা হারানোর পর ১৯৬২ সালে চট্টগ্রামে আসেন।   ১৯৮৫ সালে ঘর বাঁধেন নদীর পাড়ের শিকলবাহার মেয়ে আয়েশা খানমের সঙ্গে।   চার ছেলে। বড় ছেলে গাড়ি চালান।   থাকেন কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে ভাড়া বাসায়। আগে চাক্তাই এলাকায় শ্রমিকের কাজ করতেন।   বয়সের ভারে নুয়ে পড়ায় শ্রমিকের কাজ ছেড়ে দেন।   কর্ণফুলী ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু হওয়ার পর ঠিকাদারের হয়ে পাহারার চাকরি নেন।   বেতন পান পাঁচ হাজার টাকা।   সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা।

বললেন,‘এ বেতনে সংসার চলে না।   রাত জেগে পাহারার পর সকালে ঘণ্টা দুয়েক বিশ্রাম নিই। বিকালে ছোট খাট কাজ পেলে করি। ’

একাকি রাতে সঙ্গী পেয়ে গল্পের ডালপালা মেলে বসেন। ফিরে যান শৈশবে।   নানা কথার মাঝে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতেও ভুললেন না।   শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন পাক বাহিনীর বেয়নটের চিহ্ন।

বললেন,‘তখন ছোট ছিলাম। মাঝিরঘাট এলাকায় ব্যবসায়ীদের রান্না-বান্নার কাজ করতাম। মুক্তিযুদ্ধ করতে পারিনি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের পানি-সিগারেট খাওয়াতাম। পাক বাহিনীর লোকজন ছিল জল্লাদের মতো।   একদিন ফিরিঙ্গি বাজার থেকে যাচ্ছিলাম নিউমার্কেটের দিকে।   সব দোকানপাট বন্ধ।   পথেই আটকালেন পাক বাহিনীর সৈনিকরা। কোন কথা বার্তা ছাড়ায় অস্ত্রের বেয়নেট দিয়ে পায়ে আঘাত করলেন।   পরে কয়েকজন বড় অফিসার এসে সৈনিকদের বকে দিলেন।   চিকিৎসাও করে দিয়েছিলেন তারা। কিন্তু সেই আঘাতের চিহ্ন এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি। ’

মা-বাবা বা ভাই বোনের কথা মনে পড়ে কি না জানতে চাইতেই বেড়িয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। দরিদ্রের কষাঘাতে জীর্ণ নুর ইসলামের চোখ দুটো হয়ে উঠে আদ্র। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় দু চোখের কোণা চিক চিক করে উঠে।

জানালেন, এক ভাই এক বোন। জীবিকার তাগিদে এসেছিলাম চট্টগ্রামে। ফখরুদ্দিনের আমলে(গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার) একবার গিয়েছিলাম। পয়সার অভাবে আর যাওয়া হয়নি।  

ভরা পূর্ণিমা। নির্জন তীর। নদীর ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ।   কবি কিংবা শিল্পীকে মাতাল করলেও অভাবী নুর ইসলামের জীবনে মধ্যবিত্ত এসব আবেগ নিতান্তই তুচ্ছ।   তার কাছে এসব কবি সুকান্তের ‘পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’র মতোই।

বাংলাদেশ সময়: ০৪৩৪ ঘণ্টা, জানুয়ারী ০৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।